আশরাফুল আলম, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)

  ২০ জুলাই, ২০১৯

সোনারগাঁ

জ্যোতি বসুর বাড়ি এখন গ্রন্থাগার

ভারতের প্রখ্যাত বাম রাজনীতিক ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কমরেড জ্যোতি বসু, উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। রাজধানী ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদী চৌধুরীপাড়ায় তার পৈতৃক বাড়ি। জ্যোতি বসুর জন্ম কলকাতায় হলেও, বারদী চৌধুরীপাড়ায় কেটেছে তার শৈশবের অনেকটা সময়।

জ্যোতি বসুর জন্ম ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতায়। তার বাবা ডা. নিসিকান্ত বসু নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদী চৌধুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। তিনি জ্যোতি বসুর জন্মের আগেই বারদী থেকে ভারতের কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি চিকিৎসা পেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুযোগ পেলেই নিশিকান্ত বসু সপরিবারে বেড়াতে আসতেন বারদীর চৌধুরীপাড়ায়। সেই কারণে সোনারগাঁয়ের বারদীতে ছড়িয়ে আছে জ্যোতি বসুর শৈশবের অনেক স্মৃতি।

১৩২৯ বাংলা সালের ১৩ অগ্রহায়ণ পাচু ওস্তাগারের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বাড়িটি। ২ একর ৪ শতাংশ জমিতে জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়িতে রয়েছে ৮৮ বছরের পুরোনো একটি দ্বিতল ভবন, দুটি পুকুর, একটি কুয়া, এছাড়া আম, জাম, কাঁঠাল ও তালসহ রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ গাছ। কুয়াটি জরাজীর্ণ অবস্থায় এখনো টিকে রয়েছে।

জ্যোতি বসুর এই বাড়িটি মূলত তার নানার ছিল। জ্যোতি বসুর নানা শরৎ চন্দ্র দাস ও নানি খিরদা সুন্দরীর সংসারে জ্যোতি বসুর মা হেমলতা বসুই ছিলেন তাদের একমাত্র সন্তান। সেই সূত্রে এই বাড়ির মালিক হন হেমলতা বসু। ডা. নিশিকান্ত বসুর সঙ্গে হেমলতা বসুর বিয়ের পর স্ত্রীর সুবাদে এই বাড়ির মালিক হন জ্যোতি বসুর বাবা।

ডা. নিশিকান্ত বসু ও হেমলতা বসুর সংসারে তাদের তিন সন্তান সুরেন্দ্র কিরণ বসু, জ্যোতি বসু ও মেয়ে সুধা বসু। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসু ১৯৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি এবং ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর স্ত্রী বাসন্তি ঘোষ ওরফে কমলা বসু ও তার ছেলে চন্দন বসুকে সঙ্গে নিয়ে বারদীতে তার পৈতৃক বাড়িটি দেখতে আসেন। ১৯৮৭ সালে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বারদীতে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বারদীতে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। সে সময় ভারত থেকে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আসেন পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুর বড় ভাই ডা. সুরেন্দ্র কিরণ বসু এবং বোন সুধা বসুও।

১৯৪৬ সালে জ্যোতি বসু রাজ্য পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে জ্যোতি বসু ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর সাফল্যের সঙ্গে একটানা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

জ্যোতি বসু ১৯৬৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। ২০০০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তার দলের অন্যতম সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় জ্যোতি বসু তার এই পৈতৃক বাড়িটি গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করার ঘোষণা দিয়ে জ্যোতি বসুর ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১১ সালের ৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ ১ কোটি ৪৭ লাখ ব্যয়ে গ্রন্থাগারের নির্মাণকাজ শুরু করে। যার প্রথমতলায় রয়েছে পাঠাগার কক্ষ, মহাফেজখানা ও শৌচাগার। দ্বিতীয়তলায় স্মৃতি জাদুঘর ও সেমিনার হল। নির্মাণকাজ শেষ হলে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোতি বসু স্মৃতি পাঠাগার ও জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এটি গ্রন্থাগার, জাদুঘর ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পুরাকীর্তি বিভাগের তত্ত্বাবধানে বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হয়। এখানে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, জ্যোতি বসুর ব্যবহƒত সামগ্রী দিয়ে একটি জাদুঘরসহ দর্শনীয় একটি ভবন তৈরি করে তার স্মৃতি চির জাগরুক রাখা হচ্ছে।

ছোটবেলায় জ্যোতি বসু তার পৈতৃক বাড়িতে থাকাকালীন তার দেখাশোনা করতেন আয়াতুন নেছা নামে এক মহিলা। পরবর্তী সময়ে বাড়িটির দেখাশোনার দায়িত্ব পান আয়াতুন নেছা ও তার ছেলে হাবিবুল্লা। বর্তমানে বাড়িটি দেখাশোনা করছেন আয়াতুন নেছার নাতি ইউসুফ আলী ও ফকির মাহামুদ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close