মহানগর (সিলেট) প্রতিনিধি

  ১৭ জুলাই, ২০১৯

টিলায় ঝুঁকিতে বসবাস ১০ হাজার লোকের

সিলেটে গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বেড়ে তলিয়ে গেছে নিচু এলাকা। টানা বর্ষণের কারণে ঝুঁকি বেড়েছে টিলাধসের। ইতোমধ্যে ভারী বর্ষণের কারণে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি স্থানে পাহাড়ধসে নিহতের ঘটনাও ঘটেছে। এমতাবস্থায় সিলেটে ঝুঁকি নিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাস করছে ২ হাজার পরিবারের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এদের পুনর্বাসনে সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, সারা বছর কোনো নজরদারি না থাকলেও বর্ষা এলেই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। সিলেটে প্রায় প্রতি বছরই টিলাধসে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। গত কয়েক বছরে সিলেটের গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার নগরের শাহী ঈদগাহ, ফেঞ্চুগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় টিলাধসে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে এমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিলেটে পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে কতটি পরিবার বসবাস করছেÑ এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তবে সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ২০১৭ সালের জরিপে দেখা গেছে, সিলেটে টিলার পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করায় প্রায় ১০ হাজার লোক ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এ সংখ্যা বর্তমানে ২০ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানান সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই।

সিলেট নগর, নগরের উপকণ্ঠ ও সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ও পাহাড় কেটে কাঁচা-আধাপাকা বাড়ি নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে হাজারের অধিক পরিবার। একশ্রেণির ভূমিখেকোরা টিলা কেটে ভূমি দখল করে টিলার পাদদেশে ঘর নির্মাণ করে ভূমিহীন দরিদ্রদের ভাড়া দিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে।

সরেজমিন নগরের জাহাঙ্গীরনগর, গোয়াবাড়ি ও হাওলাধার পাড়া ঘুরে দেখা গেছে, টিলার পাদদেশে ও টিলার ওপরে কয়েকশ পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে টিলার বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।

জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে সাত মাস যাবত বসবাস করছেন গৃহিণী হনুফা বেগম। স্বামী রুপন আহমেদসহ ৩ সন্তান নিয়ে টিলার একাংশ ঘর বানিয়ে থাকছেন। হনুফা বেগম বলেন, স্বামী এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। টিলার নিচে বৃষ্টির সময় থাকা অনেক ঝুঁকির, এটা জানি। তার পরও আমাদের কিছু করার নেই এখানেই থাকতে হবে। বৃষ্টি হলে আতঙ্কে থাকি। জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় আলীবাহার চা বাগানের টিলার নিচে বসবাস করে ১০ পরিবার। এই খানেতে ১২ জন শিশুসহ প্রায় ৪০ জন মানুষ থাকে। এখানে বসবাসরত সবাই দরিদ্র ও ভূমিহীন। বেশির ভাগ মানুষই দিনমজুর। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলীবাহার বাগান কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তারা ঘর বানিয়ে এখানে বসবাস করছে। একই এলাকার আরেকজন বসবাসকারী লিজা বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ, কোথায় যাব। জানি বেশি বৃষ্টি হলে টিলাধস হয়, কিন্তু আমাদের তো আর যাওয়ার জায়গা নেই। তাই ঝুঁকি নিয়ে এখানেই থাকতে হবে।

এ ছাড়া নগরীর উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। এ ছাড়া জৈন্তাপুর উপজেলার নয়াখেল, আঞ্জাগ্রাম ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বিভিন্ন টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে আরো কয়েক সহস্রাধিক লোক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র টিলার পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করে ভূমিহীনদের কাছে ভাড়ার দিয়ে থাকেন। অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ভাড়া পাওয়ায় মৃত্যুঝুঁকি সত্ত্বেও এসব বাড়ি ভাড়া নেন অসহায় লোকজন। স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী ভূমিখেকোরা অবৈধভাবে টিলা কাটার ফলে বর্ষা মৌসুমে ধসের আশঙ্কা আরো বেড়ে গেছে।

এ ব্যাপারে সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ টিলার ওপর সেভ দ্য হেরিটেজের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। এতে দেখা গেছে, সিলেট শহরতলি ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলা কেটে এর পাদদেশে অন্তত ১০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। তবে বর্তমানে এ সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। খবর পেয়েছি শুধু সিলেটের জৈন্তপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নেই টিলার পাদদেশে বসবাসকারী বেড়েছে ৫ হাজার। এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই বর্ষা মৌসুমে টিলাগুলো ধসে পড়ে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, প্রতি বছর বর্ষা এলেই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়, কিন্তু বছরজুড়ে কোনো নজরদারি থাকে না। সিলেট মহানগর ও বিভাগজুড়েই পাহাড়-টিলার নিচে ঝুঁকির সঙ্গে বাস করে কয়েক হাজার মানুষ। মূলত পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বস্তি তৈরির অসংখ্য নজির আছে সিলেট মহানগরের ভেতরই। মানুষের বসতি রেখে এক ঠেলা, দুই ঠেলা করে টিলা কাটা মাটি বিক্রি ওপেন সিক্রেট। হতদরিদ্র মানুষ কোনো কিছু চিন্তা না করেই ঝুঁকির সঙ্গে বসবাস করে এসব এলাকায়। আর উপকারভোগী হন প্রভাবশালীরা।

সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল হক বলেন, টিলার নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তার পরও বৃষ্টি হলে আমরা ওইসব এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য বলছি। এখন কারো ব্যক্তিমালিকানা টিলায় আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না। তার পরও সচেতনতা বাড়াতে আমরা কাজ করছি।

প্রশাসনের অভিযান : সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনে অভিযান চালিয়েছে সিলেট সদর উপজেলা প্রশাসন। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে সিলেটে টিলাধসের শঙ্কা দেখা দেওয়ায় এ অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দুটি পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

গত সোমবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মহুয়া মমতাজের নেতৃত্বে অভিযানে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট সুনন্দা রায় ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রোজিনা আক্তার।

তারা সদর উপজেলার বহর, টুকের বাজার ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অভিযান চালান। এ সময় বসবাসকারীদের কয়েক দিনের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানান তারা।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মহুয়া মমতাজ জানান, সিলেটে টিলাধসের শঙ্কা থাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের জন্য প্রশাসন নিরাপদ দুটি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। এসব এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close