শাহরাস্তি (চাঁদপুর) প্রতিনিধি

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

শাহরাস্তিতে আর্সেনিক

৩ ভাইয়ের মৃত্যু ঝুঁকিতে আরো ৭

চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে একই পরিবারের তিন ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে, এবার মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন আরো সাতজন। শুধু ওই পরিবারটি নয়, উপজেলার অধিকাংশ মানুষ আর্সেনিকজনিত রোগে আক্রান্ত কিংবা আর্সেনিকঝুঁকিতে বসবাস করছেন।

জানা যায়, জেলার মধ্যে শাহরাস্তি উপজেলায় আর্সেনিকের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এরপরেই রয়েছে হাজীগঞ্জ উপজেলা। শাহরাস্তিতে রয়েছে ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা। ২১ বছর আগে দেশের সর্বোচ্চ আর্সেনিক কবল অঞ্চল হিসেবে এ উপজেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারপর থেকে আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির ভাই হাবিবুর রহমান জানায়, এরই মধ্যে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে তাদের পরিবারের পাঁচ সহোদরের তিনজনই প্রাণ হারিয়েছেন। এখন পাঁচ ভাইয়ের সংসারের শুধু বেদনাই সম্বল। জীবিত বাকি দুই ভাইয়ের প্রাণও আজ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। এমন করুণ বাস্তবতা তাড়া করছে শাহরাস্তি উপজেলার পৌরশহরের ৭নং ওয়ার্ডের তালুকদারবাড়ী মৃত মমতাজ উদ্দিনের পরিবার।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা জানান, মমতাজ উদ্দিনের তিন মেয়ে, পাঁচ ছেলে। বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর বাড়িতে চলে যান মেয়েরা। ১৯৭৬ সালে তাদের বাড়ির নিকট মসজিদের পাশে স্থাপিত একটি টিউবওয়েলের পানি পান করত তারা। ১৯৮৬ সালে নিজ পরিবারের আঙ্গিনায় একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে। পরিবারটির বড় সন্তান রহুল আমিন মানিক (৫৫) শাহরাস্তি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৯১ সালে প্রথম শনাক্ত হয় তিনি আর্সেনিকে আক্রান্ত। ২০০৪ সালে ঢাকার আইসিডিডিআরবি’তে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শতভাগ নিশ্চিত হন। ২০০৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি আর্সেনিকজনিত রোগে মারা যান। তৃতীয় ভাই মো. মজিবুর রহমান (৪৮) একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করতেন। তিনিও যে আর্সেনিকজনিত রোগে আক্রান্ত, তা জানতেন না। যখন জানলেন তখন আর ফেরানোর সময় ছিল না। এরই মধ্যে তার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি মারা যান। দ্বিতীয় ভাই নুরুল আমিন (৫৫) বাড়ির পার্শ্বে তালতলা নামক স্থানে একটি চায়ের দোকান ছিল। দুই ভাইয়ের অকালমৃত্যুর পর স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে ওঠেন। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন, তিনিও আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। ঢাকার মহাখালীতে ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারেন, তার শরীরেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে চা স্টলে দিন কাটাতেন। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল মঙ্গলবার তারও জীবনপ্রদীপ নিভে যায়।

তাদের বেঁচে থাকা আর্সেনিকে আক্রান্ত ছোট ভাই হাবিবুর রহমান (৪৩) জানান, সবাইকে তো হারালাম, এখন এ রোগের দহন নিয়ে আমার চতুর্থ ভাই মফিজুর রহমান (৪৫) আর আমি কোনোমতে বেঁচে আছি। এমন পরিস্থিতি শুধু এ পরিবার নয়, অনেক পরিবারের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। পার্শ্ববর্তী কচুয়া উপজেলার জনৈক গৃহবধূ নাহিদা (৩৩) ইউনিডোর এনজিওতে আর্সেনিক চিকিৎসা করিয়েও স্বামী ও সংসার টিকাতে পারেনি। বর্তমানে শাহরাস্তির আয়নাতলী গ্রামের গণমাধ্যমকর্মী হেলাল উদ্দিন আর্সেনিকে আক্রান্ত। তার দুটি কিডনি বিকল হওয়ার পথে। এছাড়াও রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নের শাহেদা বেগম ও তার স্বামী এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখী। অনেকের শরীরে বাসা বেঁধেছে আর্সেনিকজনিত নানা অসুখ-বিসুখ। এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তারা।

শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. অচিন্ত্য চক্রবর্ত্তী জানান, ২০১২ সালের পর থেকে সরকারিভাবে কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে না। আমরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছি। তারা বাইরে থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। ২০১৭ ডিসেম্বরে ৫ হাজার ৬৫৫ রোগী শনাক্ত করার হিসাব পাওয়া যায়। সর্বশেষ হিসাবে ২০১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো ১৪ জন রোগী শনাক্ত করা হয়।

শাহরাস্তি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস সিসিটি অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব আ. হালিম জানান, ১৯৯৬ সালে প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত শাহরাস্তি উপজেলায় ১ হাজার ৭৮৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে সচল রয়েছে ১ হাজার ৭৪৫টি এবং বিকল রয়েছে ৪০টি। তিনি জানান চলতি অর্থবছরে আরো ৬৫টি গভীর নলকূপ বসানোর টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এ ব্যাপারে পৌর মেয়র হাজী আ. লতিফ জানান, সম্প্রতি দেশের ৪০টি পৌরসভার সঙ্গে শাহরাস্তি পৌরসভায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করার লক্ষ্যে ও গ্রোথ সেন্টারে অবস্থিত পানি সরবরাহ ও এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্পের আওতায় এ পৌরসভায় ভূপৃষ্ঠস্ত পানি শোধনাগার ও উচ্চজলাধার নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close