প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৩ এপ্রিল, ২০১৯

বরগুনায় স্কুল ভবনধস

উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা চার কক্ষ সিলগালা

বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী পিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিম ধসে মানসুরা নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ওই স্কুলের শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ভবনটির চারটি কক্ষে সিলগালা করা হয়েছে। এদিকে ছাদ ধসের আতঙ্কে উপজেলার অন্যান্য স্কুলের এবং পিরোজপুরের কাউখালীর জরাজীর্ণ ভবনেও ক্লাস নেওয়া বন্ধ করার খবর পাওয়া গেছে। আলোচনায় এসেছে স্কুল ভবনের নিরাপত্তার বিষয়টি। স্থানীয়রা অনেকেই এখন উদ্বিগ্ন তাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে। তাদের মধ্যে একজন বলছিলেন, ‘আমরা শিশুদের স্কুলে মানুষ হওয়ার জন্য পাঠাই, লাশ হওয়ার জন্য নয়। লাশ হওয়ার ভয়ে আমরা শিশুদের পাঠাই না স্কুলে।

তালতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, ছাদের বিম ধসে যখন মানসুরা নিহত হয়, তখন ওই ক্লাসেই বাংলা পড়াচ্ছিলেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কুলসুম আক্তার। তিনি নিজেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, সব বাচ্চারাই সন্তানের মতো। যেহেতু এ হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা আমার চোখের সামনেই ঘটেছে, অন্য কেউ ভুলতে পারলেও আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারব না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাকেরিন জাহান দুই মাস হয়েছে এ স্কুলে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্কুলের মোট ছাত্রছাত্রী ১৬৩ জন। ঘটনার পর থেকে কেউ স্কুলে আসেনি। ছেলেমেয়েদের আবার স্কুলে নিয়ে আসার জন্য আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝাব- বলছিলেন তিনি।

প্রধান শিক্ষক বলেন, ভবনটির বয়স মাত্র ১৫ বছর। ধসে পড়ার আগে ভবনের বিমে ফাটল ছিল কিন্তু এতটা ঝুঁকিপূর্ণ ধারণা করা যায়নি। এ ভবনে জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার সেন্টার। এ বছরও এখানে এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে।

বরগুনার এ দুর্ঘটনায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে অন্যান্য স্কুল নিয়েও। প্রাথমিক বিদ্যালয় লাগোয়া হাইস্কুলেরও একটি ভবনে শিক্ষার্থীরা এখন ক্লাস করা বন্ধ করে দিয়েছে।

উপজেলার আরেকটি উত্তর গেন্ডামারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখা যায় অস্থায়ী টিনশেডে ক্লাস করছে।

ওই স্কুলের পরিত্যক্ত ভবনের ছাদ ধসে গত বছর দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্র মারা যায়। বিদ্যালয়ের জন্য যে নতুন ভবন উঠছে সেটির নির্মাণে সমস্যা আছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

এছাড়া বরগুনা পৌর শহরের আমতলার পাড় ১৬নং মধ্য বরগুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিম ধস আতঙ্কে রয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার সেখানে বিম ধসে অল্পের জন্য বেঁচে যান এক শিশু শিক্ষার্থী। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামিম আরা নিপা জানান, ১৯৯৪ সালে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকায় এলজিইডি এ বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করে। এরপর বিদ্যালয়ে আর কোনো রিপেয়ারিংয়ের কাজ হয়নি। বিদ্যালয়টির চারটি কক্ষের তিনটি রুমের ছাদের ও দেয়ালের বিমে ফাটল রয়েছে। বিষয়টি লিখিতভাবে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগকে জানানো হয়েছে। বর্তমানে ঝুঁকি নিয়েই পাঠদান কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।

সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান এ প্রতিবেদককে মুঠোফোনে জানান, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি।

এদিকে তালতলি উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী মনিরুজ্জামান রিপন জানান এলাকার বেশির ভাগ স্কুল জরাজীর্ণ। উপজেলার ৭৯টি স্কুল তার মধ্যে ৬৭টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। মেরামতের ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি গিয়ে দেখি, তদারকিও করতে পারি। আর নতুন ভবনে আমাদের তদারকি অতটা জোরালো নয় এটা প্রকৌশলী দেখেন।

তবে ঠিকাদারের দাবি তিনি নিয়ম মেনেই কাজ করছেন। কিন্তু ভবন নির্মাণে ২০ মিলিমিটার রডের পরিবর্তে ১৬ মিলিমিটার রড ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সেখানে দায়িত্বরত উপজেলা প্রকৌশলী আহাম্মদ আলী বলেন, এ অঞ্চলে লবণাক্ততা ভবনের স্থায়িত্বের ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু মাত্র ১৫ বছরে একটি ভবন এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভেঙে পড়ল কীভাবেÑ সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে। শুধু বরগুনা নয়, সারা দেশে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়েরই ভবনগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ ।

কাউখালী (পিরোজপুর) প্রতিনিধি জানান, কাউখালীর ৪২নং পূর্ব শিয়ালকাঠি হাজীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিয়ালকাঠি মোল্লারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনে ঝুঁকি নিয়ে চলছে পাঠদান কার্যক্রম। অভিভাবকদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে, কাজ হয়নি। ঝুঁকি জেনেও ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে হচ্ছে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় স্কুলে বন্ধ করে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এসব কথা জানিয়েছেন পূর্ব শিয়ালকাঠি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহেল হোসেন তালুকদার। অপর দিকে মোল্লারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানেও ভয়ে স্কুলে আসছে না শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, উপজেলায় ৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পূর্ব শিয়ালকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোল্লারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দত্তেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শীর্ষা আবদুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চিরাপাড়া কেএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

বরগুনার দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৫ দিনের মধ্যে সারা দেশের অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্কুলভবনের চিহ্নিত করে জানানোর নির্দেশনা দিয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্কুলগুলো চিহ্নিত করে এরই মধ্যে সেখানে পাঠদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। দেশের ৬২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে কাঁচা পাকা মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার স্কুল আমাদের নতুন করে নির্মাণ করে দিতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close