নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১১ এপ্রিল, ২০১৯

বৈশাখ রাঙাবে মৃৎশিল্প

সব ভুলে যাই, সব ভুলে যাই/তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল। টাকঢুম টাকঢুুম বাজাই/আমি টাকঢুম টাকঢুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল...। বাংলাদেশের ঢোলটি এখন খুব বাজছে। সারা বছর অন্যের আচারে ব্যস্ত থাকতে থাকতে শেকড়ে ফেরারও সাধ জাগে। আসছে শেকড়ে ফেরানোর বৈশাখ। লোকজীবনে ফেরার চির আকাক্সক্ষাকে নতুন করে জাগিয়ে দিচ্ছে।

সারা দেশের মতো ঢাকায়ও জোরেশোরে চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। রাজধানীর যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই বৈশাখ। নতুন বছরের আগমনী বার্তা। বাংলা নববর্ষ বরণের এই অনুষ্ঠান সবার জন্য উন্মুক্ত। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তাদের মধ্যেও এক ধরনের প্রস্তুতি চলছে। বাংলা নববর্ষের দিন শহর ও গ্রামে বসবে মেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ মাটির তৈরি নান্দনিক পণ্য। যদিও কালের পরিক্রমায় আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বৈচিত্র্য এসেছে, তবে এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি মাটির পণ্যের সেই ঐতিহ্য।

একসময় মাটির জিনিস তৈরিতে চৈত্রমাস জুড়ে মৃৎশিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করতেন। আর ব্যবসায়ীরাও বৈশাখ উপলক্ষে সেই পণ্য বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করতেন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো মাটির পণ্যের চাহিদা ফুরিয়ে যায়নি। যদিও আগের মতো ব্যবসা আর নেই।

রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাটির তৈরি নান্দনিক হাঁড়ি-পাতিল, গ্লাস, কংকাল, টিয়া পাখি, সিংহ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মাছ, মুরগি, ছানা, হাঁস, হাতিসহ নানা পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা। মূলত পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এসব পণ্য গ্রামাঞ্চল থেকে নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। মাটির তৈরি অনেক পণ্যে কারুকাজ নিয়েও ব্যস্ত দোকানিরা। তারা যেমন মাটির তৈরি পণ্যের মজুদ বাড়াচ্ছেন, সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্রেতাদের আনাগোনা।

দোয়েল মৃৎশিল্প অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফটের স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মাটির তৈরি বৈশাখী পণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিকিকিনি খুব বেশি হচ্ছে না। তবে পহেলা বৈশাখ ঘনিয়ে এলে বিক্রি বাড়বে।

শান্ত মৃৎশিল্পের স্বত্বাধিকারী টিটু আহমেদ বলেন, গাজীপুর থেকে মাটির তৈরি পণ্য নিয়ে এসেছি। আমি নিজেই কারুকাজ করছি। ১২০ আইটেমের পণ্য রয়েছে দোকানে। বিকিকিনি মোটামুটি ভালোই চলছে।

ধামরাই (ঢাকা) থেকে আবদুর রউফ জানান, ধামরাইয়ের পালপাড়াগুলোতে বেড়েছে ব্যস্ততা। মাটির তৈরি পশু-পাখি ও জীবজন্তুসহ নানা তৈজসপত্র তৈরিতে দিন-রাত পরিশ্রম করছেন মৃৎশিল্পীরা। তবে, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের কারণে মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বাঁচাতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার দাবি বিশেষজ্ঞদের।

নলাম কুমারপাড়ার সুচিন্দ্র পাল, নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলছেন কুমিরের অবয়ব। বৈশাখে বাড়তি উপার্জনের আশায়, দিন-রাত পরিশ্রম করে, মাটির তৈরি জীবজন্তু ও পশুপাখি তৈরি করছেন তিনি।

একই চিত্র শিমুলিয়া, হাজিপাড়া, বানিয়াপাড়া, কাঁকরানসহ বিভিন্ন পালপাড়ার। বাংলা নতুন বছর উপলক্ষে মাটির তৈরি নানা শৌখিন উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ততা বেড়েছে মৃৎশিল্পীদের। বৈশাখের বাজার ধরতে মাটির তৈরি পণ্যগুলো বুঝে নিতে, ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছেন পাইকাররা। ক্রেতার চাহিদা মোতাবেক পণ্য পেলে বাড়তি লাভের আশা তাদের।

তারা বলেন, যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় সে অনুযায়ী দাম পাওয়া যায় না। সিলভার মার্কেটে আসার পর থেকে মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা কমে গেছে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের আরো প্রসার ঘটবে বলে মনে করে এই বিশেষজ্ঞ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ময়েজ উদ্দিন বলেন, এসব শিল্পকর্ম জায়গাগুলোকে সমৃদ্ধ করছে, দেশের ঐতিহ্যকে যদি আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করি, তাহলে দেশের বাইরেও এই শিল্পকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

বংশী নদীর তীরে গড়ে ওঠা পালপাড়ার ২০-২৫টি গ্রামে অন্তত ১০ হাজার পরিবার বাস করেন। এর মধ্যে শুধু বংশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে প্রায় ১০০ পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত।

দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) থেকে কে এম বেলাল জানান, এবার বৈশাখ রাঙাবে গুড়ার দুপচাঁচিয়ার পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তাই তো দুপচাঁচিয়ার মৃৎশিল্পীরা বৈশাখ ঘিরে মহাব্যস্ত।

গ্রামঞ্চলে বৈশাখী মেলার কদর সবচেয়ে বেশি। গ্রামের মেলাগুলোয় নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ের সমাগম ঘটে। আর এই মেলার আকর্ষণ হচ্ছে মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা ও জিনিসপত্র। এসব খেলনা তৈরিতে তাই এখন ব্যস্ত উপজেলার পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তারা কাদা মাটিকে পুঁজি করে নিজেদের আদি শিল্পকে ধরে রেখেছেন। একসময় এই শিল্পীরা মাটির তৈরি থালা, হাঁড়ি পাতিল, বাসন-কোসন তৈরির মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, আসছে নতুন প্রযুক্তি। মৃৎশিল্পীরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।

উপজেলা সদরের চেঙ্গা পালপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বৈশাখী মেলায় বিক্রির জন্য বিভিন্ন খেলনা বানানো হচ্ছে। তাদের মধ্যে সিংহভাগই নারী। অনেক বাড়িতে একাধিক শ্রমিকও কাজ করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কাদা ঘুটছেন, কেউ চাকতি ঘুরাছেন, কেউ কেউ আবার তৈরি করছেন নানা খেলনা, ফলমূল পুতুলসহ বিভিন্ন পণ্য।

কেউবা রংতুলিতে শেষ আঁচড় দিচ্ছেন। কেউ ব্যস্ত রং নিয়ে। কোনো কেমিক্যাল ছাড়াই এ খেলনা ও পণ্যগুলোতে যে রং করা হচ্ছে, তাও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা এবং প্রকৃতির সব উপাদানে তৈরি।

কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পী চন্দন কুমার পাল, তার স্ত্রী পুথি রানি পাল, স্বপন চন্দ্র পাল তার স্ত্রী সরস্বতি পাল, তারাপদ পাল ও সত্যেন্দ্রনাথ পালসহ অনেকে জানান, তারা ৫০ ধরনের ক্রোকারিজসহ বিভিন্ন খেলনাসামগ্রী তৈরি করে থাকেন। এর মধ্যে গ্লাস, মগ, তরকারির বাটি, প্লেট, মিষ্টির হাঁড়ি, জগ, ফুলদানিসহ খেলনাসমগ্রীর মধ্যে আম, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, কমলা, তাল, পটোল, লিচু, কলা, তরমুজ, বেগুন, মাটির ব্যাঙ, হাতি, বাঘ, সিংহ, মাটির তৈরি ব্যাংক, কুমির, মূর্তি, গণেশ উল্লেখযোগ্য। মেলায় নিজেরা এসব জিনিসের পসরা সাজিয়ে বিক্রির পাশাপাশি পাইকারি মহাজনদের (অর্ডার নেওয়া) সরবরাহ দিয়ে থাকেন। পরিশ্রম বাদ দিয়ে প্রতিটি খেলনায় তারা এক টাকা থেকে দেড় টাকা লাভ করে থাকেন। কুমাররা এ সময়াকে মৌসুম হিসেবে ধরে কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়। বৈশাখ যত এগিয়ে আসে, তাদের ব্যস্ততা তত বাড়ে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে কুমারপল্লী। এ যেন তাদের কাছে আরেক মহোৎসব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close