হাসানুজ্জামান তুহিন, শাহজাদপুর

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

শাহজাদপুরে ত্রিমুখী দূষণের কবলে ধুঁকছে করতোয়া

শাহজাদপুরের বুকচিরে বয়ে চলা খরস্রোতা করতোয়া নদীটি কারখানার বর্জ্য, শহরের নর্দমার পানি এবং দখল ভরাট ও বালু উত্তোলনের ফলে এখন মৃতপ্রায়, ধুঁকছে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

হিমালয় থেকে জন্ম, নানা জনপদ ঘুরে, রূপ লাবণ্য আর মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে শাহজাদপুরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে করতোয়া। নদীটি এ অঞ্চলের কৃষি ও জীব বৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নদীটি ছিল উত্তাল স্রোতস্বিনী। দুকূল ছাপিয়ে উত্তাল করতোয়া ধুয়ে দিত এ অঞ্চলের প্রকৃতিকে। নদীর বুকে রাজহাঁসের মতো ভাসত বড় বড় নৌকা, ছোট বড় জাহাজ।

এখন সেসব ইতিহাস। নদীটি দখল, দূষণ ও চর পড়ে হারিয়ে ফেলেছে যৌবন। নদীটির অতিশয় সরু নালায় পরিণত হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে সেখান দিয়ে কালো দূষিত পানি নালা নর্দমার মতো বয়ে যায়। সেই যৌবনা নদী এখন খাঁ খাঁ মরুভূমি। প্রাণহীন নদীর রেখার উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সরু নালা। নদীর ওপর চাষ করা হচ্ছে ধান।

প্রাচীন কাল থেকেই করতোয়া ছিল বাণিজ্যিকভাবে এবং উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ১১ শতকের শেষের দিকে সাহিত্যে কর্মে রয়েছে এর রূপ লাবণ্য ও বাণিজ্যিক বর্ণনা। প্রাচীন বাংলার সাহিত্যিক সত্যনারায়ণ। তার সত্যনারায়ণের পাঁচালি গ্রন্থে করতোয়ার বর্ণনা আছে। এছাড়া পৌ-্রবর্ধন রাজা পরশুরাম সংস্কৃত ভাষায় ধর্মীয় ভাবাবেগপূর্ণ একটি উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যার নাম ‘করতোয়ার মাহাত্ম্য’। তাঁতশিল্প প্রধান শাহজাদপুরে প্রায় অর্ধশত প্রসেস মিলের বর্জ্য পড়ছে নদীতে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কালো সুতা সাদা করার জন্য এক ধরনের মেশিনে পানি বয়েল করে মেশানো হয় এসিড, নাইটিক এসিড, পটাশিয়াম, ব্লিচিংসহ বিষাক্ত কেমিক্যাল পাইপ দিয়ে নদীতে ফেলছে।

রূপপুর গ্রামের রাজু আহম্মেদ জানান, করতোয়া ব্রিজ বিনোদনের অন্যতম একটি স্থান। এখন বিষাক্ত পানিতে নদীর মাছ মরে ভেসে উঠছে। পরিবেশ অধিদফতর থাকলেও দূষণ বন্ধ নেই।

স্থানীয় সবুজ বিপ্লবের উদ্যোক্তা কামরুল হাসান হিরোক জানান, পরিবেশ অধিদফতরের কাউকে কোনো প্রকার পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। আমরা বিভিন্ন সময় পোস্টার ও সরকারি মহলে লিখিতভাবে জানিয়েছি, ফল হয়নি।

অপরদিকে, করতোয়ার দুই পাড়ে প্রাকৃতিকভাবে ভরাট হয়ে গেছে, দখল ও যত্রতত্রভাবে মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলণের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে করতোয়া। নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। বর্ষাতে স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে পারছে না। সামান্য বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে। ১৯৮৮ সনের বন্যার পর বহু বাড়িঘর ভেঙে যায় ও নদী পাড়ে অবস্থিত ইসলাম ধর্মের সাধক হযরত মখদুম শাহদৌলা (রঃ)’র মাজার শরিফ হুমকির সম্মুখীন হয়। তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি মাজার রক্ষার নামে প্রকল্প গ্রহণ করে এবং অতিসম্প্রতি হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নের বাদলবাড়ী নামক স্থানে শাহ হাবিবুল্লাহ ইয়ামেনী (রঃ)’র মাজার রক্ষার জন্য সিসি ব্লক দ্বারা বাঁধ নির্মাণ করে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সিরাজগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে জানান, বর্তমান সরকারের নদী-নালা, খালবিল, হাওর-বাওর সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। করতোয়া, বাঙালি ও হুরাসাগর নিয়ে একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে করতোয়া আবারও তার পূর্বের যৌবন ফিরে পাবে।

এ ব্যাপারে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, করতোয়া নদীতে ত্রিমুখী এই দূষণের বিরুদ্ধে আমরা খুব শিগগিরই পদক্ষেপ গ্রহণ করব। এরই মধ্যে শাহজাদপুর শহরের সরকারি খালখন্দ ও করতোয়া নদীর শাখার খোনকারের জোলা অবৈধ দখলমুক্ত কাজ শুরু করেছি। আশা রাখি এর মধ্যে করতোয়া আবারও প্রাণ ফিরে পাবে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ হাসিবুর রহমান স্বপন জানান, বর্তমান সরকার পরিবেশ রক্ষায় নদ-নদী, হাওর-বাওরসহ পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে যমুনা নদীভাঙন প্রতিরক্ষায় এরই মধ্যে ১১ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে।

করতোয়াসহ বিল নদী-নালায় প্রায় দেশীয় ৪০ প্রজাতির ছোট মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মিঠা পানির মাছের প্রায় ২০ শতাংশ প্রজাতির বিপন্ন। সরকার বিভিন্ন নদ-নদী দখলমুক্ত করতে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে করতোয়ার পাড়ের মানুষেরা আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে নতুন করে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close