কাইয়ুম আহমেদ

  ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আজ সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি

দীপালীকে মনে রাখেনি কেউ

ভালোবাসা দিবসের আড়ালে কেউ মনে রাখে না সেই দীপালী-জয়নাল আর কাঞ্চনদের কথা। জনগণের ন্যায়সংগত আন্দোলনেও দেখা যায় না কোনো ছাত্র সংগঠনকে। তবে গেল বছরে সড়কে তা-বের বিরুদ্ধে নেমে যেন আবার সেই ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিল জাতিকে। সেদিন ছোট্ট দীপালী এসেছিল শিশু একাডেমিতে। স্বপ্ন একটা গানের কোকিল হয়ে ওঠার। কিন্তু ওর স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল পুলিশের বুলেট। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সব। ‘দীপালীদের’ স্বপ্ন আরো সুসংহত করতে সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় সব ছাত্র সংগঠন নিয়ে। আর গেল বছরে ৩০ জুলাই ঢাকাতেই আরেক ‘ঘাতক’ থামিয়ে দিয়েছিল দুই শিক্ষার্থীর সবকিছু। সেদিন দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার পথে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক শাখার দ্বাদশ শ্রেণির আবদুল করিম এবং একাদশ শ্রেণির দিয়া খানম। সেই ঘটনায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আন্দোলনে নেমেছিল ঢাকার সব স্কুলের শিক্ষার্থীরা, নাড়িয়ে দিয়েছিল পুরো জাতিকে। সড়কে কিছুটা হলেও ফিরেছিল শৃঙ্খলা; যদিও তা টেকেনি বেশিদিন।

৮৩ সালের এই দিন অবৈতনিক বৈষম্যহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতির দাবিতে ওই দিন রাজপথে নেমেছিল কয়েক শ শিক্ষার্থী। সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচনকে ভিত্তি ধরে প্রণীত ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’র বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছাত্রসমাজ সেøাগানে মুখর। মিছিলের অগ্রভাগে মেয়েরা। রাস্তায় পুলিশের বাধা। হাইকোর্টের গেট এবং কার্জন হলসংলগ্ন এলাকায় কাঁটাতারের সামনে এসে ছাত্রীরা বসে পড়ে। নেতারা কাঁটাতারের ওপর দাঁড়িয়ে জানাতে থাকে বিক্ষোভ। এ সময় বিনা উসকানিতে অতর্কিত পুলিশ হামলা চালায় সভায়। গরম পানি ছিটিয়ে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। সভার একাংশে ছাত্রদের ওপর তুলে দেওয়া হয় ট্রাক। নিহত হয় জয়নাল, দীপালী, কাঞ্চনসহ অনেকে। শিশু একাডেমির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দীপালী মারা গেল পুলিশের গুলিতে। তার লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ। জয়নালের গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তবে শান্ত হয় তৎকালীন এরশাদ সরকারের এই বাহিনী। রাজনৈতিক নেতারা কেউ কেউ কলাভবনে আসতে শুরু করেন সমবেদনা ও সংহতি জানাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে অবস্থান নিয়ে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালায়। পুলিশের প্রথম লক্ষ্য, মরদেহগুলো উদ্ধার, যাতে লাশ নিয়ে কোনো মিছিল বেরোতে না পারে। এরই মধ্যে অন্তত একজনের লাশ নিয়ে একদল ছাত্র উপাচার্যের দফতর যে ভবনে, সেই রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ে। শীতের বিকেলে দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে সেনা সদস্যরা অবস্থান নিতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বেরোনোর সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর শহরেও কারফিউ জারি করা হয়।

এখন দৈনিকের শিরোনাম থেকেও খসে গেছে দীপালিদের নাম। আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’র কথাও। বসুনিয়া, রউফন, সেলিম, দেলোয়ার, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল বা কাঞ্চনদের কথা কেউ বলি না। সারা শহর মাতিয়ে মিছিল করার সেই সোনালি ছাত্র আন্দোলনের দিন না থাকলেও শাহবাগ এখনো মুখ ফেরায়নি। যদি শাহবাগের সব ফুলের দোকানের নাম দীপালি, বসুনিয়া, রউফুন, সেলিম, দেলোয়ার, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চন বা আইয়ুব করা হলেও রক্তঋণ শোধ হবে না, কিন্তু নামগুলো অন্তত হারাবে না।

প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালের ১৪ মার্চ, সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। সামরিক আইন জারি করে মৌলিক অধিকারের ভূ-লুণ্ঠন এবং বিরোধীদলীয় কর্মী ধরপাকড়, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এরশাদ আমল। সেই সময় ছাত্র আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগায় ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি।’ সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা-বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচনকে ভিত্তি ধরে প্রণিত ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’র বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০% বহন করতে পারবে, তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় ওই শিক্ষানীতিতে। গণবিরোধী ওই শিক্ষানীতির প্রতিবাদে, তিলে তিলে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন ফুঁসে ওঠে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওই আন্দোলন পরেও আগায় আরো। ১৫ তারিখ আন্দোলন আরো ছড়িয়ে পড়লে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রামে প্রতিবাদী কাঞ্চন নিহত হয় ১৫ তারিখ। কয়েক শ ছাত্রকে নির্বিচারে আটক করা হয়, অত্যাচার চালানো হয়। বর্তমানে যেখানে শাহবাগ থানা সেখানটায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ঘণ্টার ঘণ্টা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close