আব্দুর রহমান রাসেল, রংপুর

  ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯

রংপুরে হারিয়ে যাচ্ছে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ

শুধু শহরে নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। এতে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ সমাজের বহু পুরানো চিত্র। দিন দিন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সারাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির চিরচেনা সেই গরু-লাঙল দিয়ে জমি চাষের চিত্র।

দেশের কৃষিপ্রধান অন্যান্য অঞ্চলের মতো গোটা রংপুর অঞ্চলে একসময় গরু-লাঙল দিয়ে জমি চাষ আর মই দেওয়ার দৃশ্য সবার নজর কাড়তো। বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে নজর পড়তেই দেখা যেত শত শত কৃষক লোহার ফলা ও কাঠের হাতলের তৈরি লাঙ্গল আর জোয়ালের সঙ্গে একজোড়া গরু জুড়ে দিয়ে জমি চাষ করছেন। সে সময় গরু-লাঙ্গলই ছিল জমি চাষের একমাত্র উপায়। অথচ গরু-লাঙ্গলের পেছনে কৃষকের সেই দৃশ্য এখন বিরল। যুগের পরিবর্তনে গরু-লাঙ্গলের স্থান দখল করে নিয়েছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি। এখন আর কৃষক কাক ডাকা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে জমি চাষ করতে মাঠে যায় না। কৃষক এখন তার সুবিধামতো দিনের যে কোনো সময় ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নিয়ে মাঠে গিয়ে অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় জমি চাষ এবং মই দিয়ে ফসল আবাদ করছেন। তবে ওই ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষে পরিশ্রম এবং সময় দুটিই কমে গেছে।

প্রবীণ কৃষকরা জানান, একসময় রংপুর অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গরু লালন-পালন করা হতো। সেই গরুগুলো ছিল যেন পরিবারের এক একটা সদস্যের মতো। যাদের গরু কিংবা হাল ছিল না তারা জমি চাষের জন্য ‘প্রশিক্ষিত’ জোড়া বলদের মালিককে সিরিয়াল দিত জমি চাষ করে নেওয়ার জন্য। হাল মালিকেরা সময়মতো জমি চাষ করে দিতেন। এতে করে চাষের মৌসুমে তাদের উপরি আয়ের ব্যবস্থা হতো।

পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের প্রবীণ কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, জীবনের সিংহ ভাগ সময় কেটেছে তার লাঙ্গল-জোয়াল আর গরুর পালের সঙ্গে। হালচাষের দীর্ঘ স্মৃতি হাতড়ে এ বয়োবৃদ্ধ কৃষক বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১০ থেকে ১২ বছর হবে, তখন থেকেই চাচাদের সঙ্গে হাল চাষের কাজ করতাম। বাড়িতে হালের বলদ ছিল দুই জোড়া। একজোড়া বলদ, লাঙ্গল-জোয়াল, মই, ছড়ি (বাঁশের তৈরি গরু তাড়ানোর লাঠি), গরুর মুখের টোনা (কামইর) লাগতো আমাদের হাল চাষ করার জন্য। তিনি বলেন, এখন প্রায় কয়েক বছর হলো, বয়স আর অসুস্থতার জন্য হাল চাষ ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো আর গরু দিয়ে হালচাষ হয় না। তাই সেই পুরানো স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে করে সময় পার করছি।

গরু দিয়ে হাল চাষের উপকারিতার কথা বর্ণনা করে রংপুুরের কাউনিয়া এলাকার চাষি আলী আকবর বলেন, ‘গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো, হাল চাষ করার সময় গরুর গোবর সেই জমিতেই পড়তো। এতে করে জমিতে জৈবসার হতো, এজন্য ফসলও ভালো হতো। ট্রাক্টর কিংবা পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ পদ্ধতি দূষণের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, হালের গরুর গোবর আমরা বাড়ি থেকে জমিতে দিতাম। সার কেনা লাগতো কম। এছাড়া পরিবেশ দূষণ কম হতো। তিনি আরো বলেন, লাঙ্গল দিয়ে চাষ করলে জমিতে অনেকখানি মাটির গভীরে গিয়ে মাটি তুলে উল্টিয়ে রাখতো। ওপরের মাটি নিচে পড়তো আর নিচের মাটি ওপরে। এখন ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে গভীর থেকে মাটি তোলা হয় না।

প্রবীণ কৃষক জানান, যারা কৃষক গরু দিয়ে হাল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো কালক্রমে তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে এখনো গ্রামের কিছু কৃষক জমি চাষের জন্য লাঙ্গল-জোয়াল, গরু আর মই দিয়ে চাষ পদ্ধতি টিকিয়ে রেখেছেন।

পীরগাছা উজেলার কাশিয়াবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গরু দিয়ে হাল চাষের গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখা প্রায় দুরূহ। কারণ মানুষ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close