শরণখোলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি

  ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯

সুন্দরবনে হুমকিতে হরিণের অস্তিত্ব

* ১৩ অভিযানে ৫১০ কেজি মাংস উদ্ধার

পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবি চিত্রল হরিণ। কিন্তু চোরা শিকারি ও পাচারকারীদের অপতৎপরতায় এদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। চোরা শিকারীদের কবলে পড়ে মারা পড়ছে অসংখ্য হরিণ। বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চক্রটি নানা কৌশলে বনে ঢুকে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। এরপর সেই হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা পাচার করছে।

গত প্রায় দেড় বছরে পূর্ব সুন্দরবন ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, পুলিশ ১৩টি অভিযানে প্রায় ৫১০ কেজি হরিণের মাংস, তিনটি চামড়া, ছয়টি মাথা, আটটি নৌকাসহ বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করেছে। এ সময় হরিণ শিকার ও পাচারের অভিযোগে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।

৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বখ্যাত এ সুন্দবনের স্থলভাগ রয়েছে ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার। তবে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের পর্যটক স্পট হিসেবে খ্যাত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী কটকা, কচিখালী এবং দুবলারচর, আলোর কোল, হিরণ পয়েন্টসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বিশেষ করে সকাল ও বিকালে মায়াবি চিত্রল হরিণের পাল দেখা যায়। ১৯৯৫ সালের এফএও এবং ইউএনডিসি’র কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত পশু শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। ১৯৯৬-৯৭ সালের ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বন্য প্রাণীর ওপর এক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল ১ লাখ থেকে দেড় লাখ। ২০০১ সালের আরেক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল একই।

একটি সূত্র জানায়, লন্ডনভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ ও জুলজিক্যাল সোসাইটির তথ্য মতে, সুন্দরবনে বছরে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি হরিণ শিকারিদের হাতে মারা পড়ে। অপরদিকে বাঘের হামলায়ও প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য হরিণ।

চোরা শিকারিদের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে, জাল পেতে স্প্রি বসানো ফাঁদে, বিষটোপে, কলার মধ্যে বরশি ঝুলিয়ে রাখা এবং চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে নিধন করা হয় বিপুল সংখ্যক হরিণ। এসব হরিণের মাংস, চামড়ার ক্রেতা এক শ্রেণির উচ্চাভিলাসী মানুষ ও সমাজপতিরা। কেজিপ্রতি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে মাংস বিক্রি হচ্ছে। আবার হরিণের মাংস দিয়ে করা হয়েছে নানা কাজের তদবির। হরিণের একটি চামড়া ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে বলে সূত্র জানায়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পূর্ব সুন্দরবনের পশুর নদীর চিলা এলাকা থেকে ৭ জানুয়ারি বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে ৩০ কেজি হরিণের মাংস ও পাচারকারীদের ফেলে যাওয়া একটি নৌকা উদ্ধার করে। ৩ জানুয়ারি শরণখোলা রেঞ্জের চরখালী টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা চরখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৪০০ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করে। ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি হরিণের মাংস ও একটি নৌকা এবং ৮ ডিসেম্বর দুপুরে শরণখোলা রেঞ্জের শাপলা টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা সিন্দুরবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ১০ কেজি হরিণের মাংস ও একটি নৌকা উদ্ধার করে। ২২ নভেম্বর রাতে ও ২৩ নভেম্বর বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিম দুবলারচরের রাসমেলায় আসা ৫৭ জনকে হরিণ শিকার করার অভিযোগে আটক করে। এদের দুটি ট্রলারের তল্লাশি চালিয়ে হরিণের মাথা, চামড়া, ৫০ মিটার হরিণ শিকার করার ফাঁদ উদ্ধার করে। তাদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা করা হয়েছে।

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের হারবাড়িয়া টহল দল গত বছরের ১১ নভেম্বর বনসংলগ্ন মিরগামারি খালসংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি হরিণের মাংস, একটি চামড়া, একটি মাথা উদ্ধার করে চাঁদপাই ফরেস্ট অফিসে হস্তান্তর করে। গত বছরের ৮ জুন ভোরে চরদুয়ানী এলাকার বলেশ্বর নদীর শাখা নাপিতখালী খাল থেকে শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি কোস্টগার্ড অভিযান চালিয়ে ২৪০ কেজি হরিণের মাংস, একটি নৌকা উদ্ধার করে। গত ১২ মে সন্ধ্যায় ও গভীর রাতে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের স্মার্ট টিমের টহল ও জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা শেলার চরের মানিকখালী খাল ও চরদুয়ানীর বলেশ্বর নদীতে অভিযান চালিয়ে হরিণ শিকারে ব্যবহৃত এম.বি আল মদিনা-১ নামের একটি কার্গো জাহাজ, ৩০ কেজি হরিণের মাংস, ২৩০টি হরিণ ধরার ফাঁদ ও একটি নৌকা জব্দ করে। এ সময় হরিণ শিকারের দায়ে দাকোপ উপজেলার আমতলা গ্রামের বিশ্বজিৎ মৃধা, বাউফল উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের আল আমিন, গলাচিপা উপজেলার চরকাজল গ্রামের মো. হাসান, একই গ্রামের মো. সুমন, আসাশুনি উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের সাইদ সরকারের বিরুদ্ধে বন বিভাগীয় মামলা হয়েছে।

২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোরে শরণখোলা থানা পুলিশ উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন বকুলতলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি হরিণের মাংস সহ জাফর তালুকদার (৫০) ও সামছুল ইসলাম রিপন (৪৫) নামে দুজনকে আটক করে। এ ঘটনায় শরণখোলা থানায় মামলা হয়েছে। একই দিন একই সময় কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন অভিযান চালিয়ে ৪০ কেজি হরিণের মাংস, চারটি মাথা ও একটি নৌকা জব্দ করে। একই সালের ১৮ আগস্ট শরণখোলা থানা পুলিশ রায়েন্দা-তাফালবাড়ী সড়কের উত্তর কদমতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি হরিণের চামড়া সহ সাদ্দাম (২২) নামের এক পাচারকারীকে আটক করে। এ ব্যাপারে শরণখোলা থানায় দুজনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। একই বছরের ৬ জুলাই সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কাতলার খাল এলাকায় কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৮০ কেজি হরিণের মাংস, একটি চামড়া ও দুটি মাথা এবং একটি নৌকা উদ্ধার করে। অপরদিকে একই সালের ৪ জুলাই ভোরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড ও বনবিভাগের একটি টহল দল সুন্দরবনসংলগ্ন মানিকখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬০ কেজি হরিণের মাংস ও একটি কাঠের নৌকা উদ্ধার করে।

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় কোস্টগার্ডের পাঁচটি স্টেশনের কর্মকর্তা ও সদস্যরা তাদের আওতাধীন এলাকায় তাদের টহল অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে শিকারি চক্র শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। চোরা শিকারি ও পাচারকারীরা মাছের পাস নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে। তাই চোরা শিকারিদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের পাস বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষাসহ আইনি বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ভূমিকায় রয়েছে বন বিভাগ। আমরা তাদের সহায়তা করছি মাত্র।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, শিকারি ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের দায়ের মামলায় সম্প্রতি দুজন হরিণ শিকারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। হরিণসহ বন্যপ্রাণি ও বনজসম্পদ রক্ষায় বনরক্ষীদের পাশাপাশি বন বিভাগের চারটি স্মার্ট টিম পর্যায়ক্রমে পূর্ব সুন্দরবনে কাজ করছে। হরিণ শিকারের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close