নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ নভেম্বর, ২০১৮

মাংস-দুধ বাজারজাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চায় সরকার

এবার মাংস ও দুধ উৎপাদনে শৃঙ্খলা ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে এ দুটি পণ্যের বাজারজাতকরণেও জটিলতা রয়েছে। রয়েছে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবও। সরকার সেখানেও শৃঙ্খলা ফেরাতে চায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে গবাদিপশুর উৎপাদন কমে যাওয়া, প্রাণিসম্পদ-জাত পণ্যের ভ্যালু চেইনের অভাব, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ সুবিধার অভাব, দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতার অভাব এবং সর্বোপরি যুগোপযোগী পরিকল্পনার অভাবে ডেইরি ও গবাদিপশু খাত পোলটির খাতের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত দুধের মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে, বাকি ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ দুধ যায় ট্রাডিশনাল মিষ্টি বা দই প্রক্রিয়াকারী এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাসা-বাড়িতে প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। অন্যদিকে, গবাদিপশু যেখানে সেখানে জবাই করে দূষিত করা হচ্ছে পরিবেশ। যথাযথ প্রযুক্তিগত ও কারিগরি সুবিধা না থাকায় উৎপাদিত দুধ ও মাংস উৎপাদন পয়েন্ট থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত সম্পূর্ণ চেইনে ফুড সেফটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানে একটি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে চায় সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে (জিওবি) ৩৯৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য বাবদ পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রকল্প সাহায্য দেবে বিশ্বব্যাংকের আওতাধীন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ)। প্রকল্পটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালে শুরু হবে এবং শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। দেশের ৮টি বিভাগের ৬১টি জেলার সব উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় পরিচালিত হবে এ প্রকল্পের কার্যক্রম।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া প্রকল্পের পটভূমিতে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ ছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে সরকারের। কিন্তু দেশে এখনও ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪১ শতাংশ ক্রনিক অপুষ্টির শিকার এবং প্রায় ২২ শতাংশ শিশু জন্ম নেয় স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন নিয়ে। এ সমস্যা দূর করতে প্রয়োজন নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের বাড়তি উৎপাদন ও পদক্ষেপ গ্রহণ। এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি,আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও প্রাণিসম্পদ খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের মোট জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে শেয়ার ১৭ শতাংশেরও বেশি।

সূত্র আরো জানায়, গবাদিপশুর খামার ও হাঁস, মুরগির খামারের ঘনত্বের দিক থেকে এদেশের অবস্থান বিশ্বে সবচেয়ে ওপরে। এর মধ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বেসরকারি খাতের আগ্রহ ও বিনিয়োগের কারণে পোলট্রি বাণিজ্যিক শিল্প হিসেবে ইতোমধ্যেই বিকাশ লাভ করেছে। কিন্তু এদেশের গবাদিপশুর কম উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ-জাত পণ্যের ভ্যালু চেইনের অভাব, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ সুবিধার অভাব, দুর্বল বাজার ব্যবস্থা ও জনসচেতনতার অভাব এবং সর্বোপরি যুগোপযোগী পরিকল্পনার অভাবে ডেইরি ও গবাদিপশু খাত পোলট্রির খাতের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

ওই পটভূমি অনুযায়ী, যথাযথ প্রযুক্তিগত ও কারিগরি সুবিধা না থাকায় উৎপাদিত দুধ ও মাংস উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত সম্পূর্ণ চেইনে ফুড সেফটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এসব সমস্যা উত্তরণের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি খাতের জন্য একটি সমন্বিত উন্নয়নই এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ জন্য চারটি কৌশলকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এগুলো হচ্ছে উৎপাদশীলতা বৃদ্ধি এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রাণিসম্পদ-জাত পণ্যের মার্কেট লিংকেজ এবং ভ্যালু চেইন উন্নয়ন, প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও খাপ খাওয়ানোর কৌশল উদ্ভাবন এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। এই পরিস্থিতিতেই বিশ্বব্যাংক ও জিওবির আর্থিক সহায়তায় মোট ৪ হাজার ৭৯৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি খাতের উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পটি প্রস্তাব করেছে যা এ বছরের ১৪ অক্টোবর ১৭ অক্টোবর তারিখে অনুষ্ঠিত দুটি পিইসি সভায় প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ধরে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর এই পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নির্দিষ্ট প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও ভ্যালু-চেইন পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র খামারি ও কৃষি-উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা, বাজার অংশীদারিত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে। পাশাপাশি সুষম খাদ্য এবং উন্নত স্বাস্থ্য ও প্রজনন সেবা দেওয়ার মাধ্যমে পারিবারিক পর্যায়ে গবাদিপশুর স্বতন্ত্র উৎপাদনশীলতা বাড়বে। ৫ হাজার ৫০০ উৎপাদক সংগঠনকে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করার মাধ্যমে ভ্যালু চেইন এবং মার্কেট-লিংকেজ উন্নয়ন সংগঠিত হবে। এ ছাড়াও নিরাপদ প্রাণিজ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রবর্তন হবে, টেকসই উন্নয়নের নিমিত্ত পরিবেশ বান্ধব প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন হবে, জ্ঞান প্লাটফর্ম এবং প্রাণিসম্পদ বিমা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করা হবে। এতে দক্ষতা বাড়বে। পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সক্ষমতা বাড়বে। লজিস্টিকস্ সহায়তার মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়ন ঘটবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close