দিলরুবা খাতুন, মেহেরপুর

  ১২ নভেম্বর, ২০১৮

আ.লীগে প্রার্থীর ছড়াছড়ি বিএনপি চায় পুনরুদ্ধার

মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর উপজেলা নিয়ে মেহেরপুর-১ আসন। এই আসনে আওয়ামী লীগে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ছড়াছড়ি। বিএনপিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা একাধিক হলেও সাবেক এমপি মাসুদ অরুণের পাল্লাই ভারী।

মেহেরপুর সদরে একটি পৌরসভা, ৫টি ইউনিয়ন এবং মুজিবনগর উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মেহেরপুর-১ আসন। ২ লাখ ৬৬ হাজার ১৯২ ভোটারের নির্বাচনী এলাকায় পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩২ হাজার ৩ জন। মহিলা ভোটার ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৮৯ জন। এ আসনে ৯০ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ থেকে একটি উপনির্বাচন নিয়ে চারবার এবং বিএনপি থেকে ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিসহ তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় পার্টির নামফলকটি জেলার কোথাও দেখা যায় না। তবে ১৯৮৮ সালে এই আসনে জাতীয় পার্টি থেকে একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর লিখিত নির্দেশে মুজিবনগরকে মূল্যায়িত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ আসনটি ধরে রাখার। বিএনপি চায় আসনটি পুনরুদ্ধারে।

জেলায় প্রশাসনের ‘অনুমতি সাপেক্ষে’ রাজনীতি করতে হচ্ছে বিএনপিকে। অনেক দিন থেকেই তাদের কর্মসূচি ঘরবন্দি। তাদের আন্দোলনের সাথী জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা একেবারে নড়বড়ে। গত পাঁচ বছরে তারা কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। তারপরও আবার জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে একক প্রার্থী দিতে পারলে এ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাবেক এমপি মাসুদ অরুণ।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশীরা উঠান বৈঠক করছেন। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ছোট-খাটো কর্মসূচি পালন করছেন। বিভিন্ন দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার ফেস্টুনে ছেয়ে যাচ্ছে জেলা শহর থেকে প্রান্তিক জনপদগুলো।

বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগে মতানৈক্য থেকে কোন্দল দলকে বিপর্যস্ত করছে। ভেতরে ভেতরে তিন ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগ। কোন্দল ভুলে ঐক্যবদ্ধ হলে এ আসনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। কিন্তু ঐক্য কতটুকু হতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে দলের ভেতর দ্বন্দ্ব সম্প্রসারিত হয়েছে। বিভক্ত নেতাকর্মীদের এক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান এমপি ফরহাদ হোসেন দোদুল। সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদীন রয়েছেন আরেক পক্ষের নেতৃত্বে। যদিও কোনোপক্ষই স্বীকার করতে চাচ্ছেন না দলে বিভক্তি থাকার বিষয়টি। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলীও একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

এ বছর এমপি ফরহাদ হোসেন দোদুল ও জয়নাল আবেদীন দুজনই চাচ্ছেন দলের মনোনয়ন পেতে। একইভাবে মনোনয়নপ্রত্যাশা করছেন দুইবারের সাবেক এমপি প্রফেসর আবদুল মান্নান। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও মেহেরপুর জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম এ এস ইমন, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ইয়ারুল ইসলাম প্রমুখ। এসব সম্ভাব্য প্রার্থীদের কেউ কেউ স্পষ্টতই দলের গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছেন।

বর্তমানে মেহেরপুর-১ আসনে কোথাও সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্বৃত্তায়ন নেই দাবি করে এমপি ফরহাদ হোসেন দোদুল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দল অতীতের তুলনায় এখন অনেক সংগঠিত। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়েছেন। ফলে তিনি আশাবাদী এবারও তাকে দলের মনোনয়ন দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

এদিকে সাবেক এমপি জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, প্রান্তিক জনপদের নেতাকর্মীরা তৃণলতার মতো তাকে জড়িয়েই অবস্থান করছেন। দলীয় মনোনয়ন পেলে তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ ও ১৯৯৯ সালের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, তার সময়ে মেধার মূল্যায়ন করে চাকরি হয়েছে। জেলার উন্নয়ন এখনো মানুষ স্মরণ করেন। শুধু তৃণমূলের নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষও তাকে এমপি হিসেবে পেতে চাচ্ছেন। তাই দলের মনোনয়ন চাইবেন।

অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলীর মতে, জেলা পরিষদের প্রশাসক থাকার সময় এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছেন। আগামীতে দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তার ওপর আস্থা রাখবেন।

দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশাবাদী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম জানান, তৃণমূলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই কাজ করছেন। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তরুণ প্রজন্মর সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে। এজন্য নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিতে আসতে হবে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম এ এস ইমন বর্তমানে মেহেরপুরে স্থল বন্দর বাস্তবায়ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কয়েক হাজার নারী-পুরুষ নিয়ে স্থলবন্দর বাস্তবায়নের দাবিতে রাজপথে মানববন্ধন ও মিছিল করেছেন। এলাকায় পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে জনসংযোগও তিনি করছেন।

অ্যাডভোকেট ইয়ারুল ইসলামসহ তরুণ প্রার্থীরা আলাদা আলাদাভাবে জানাচ্ছেন, স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। তারা বলছেন, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্বের পুরোভাগে তরুণদের দেখতে চাচ্ছেন। এসব কারণে মনোনয়ন চাইতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন তারা। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাই জানিয়েছেন যে দলীয় প্রতীক আনতে পারবে তার হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।

বিএনপি মিছিল মিটিং করতে না পারলেও প্রযুক্তির মাধ্যমে জনসংযোগে মাঠে আছে। দেশের বর্তমান অবস্থায় মূল দল থেকে শুরু করে সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভয়ে ভয়ে থাকেন। জেলা শহরের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না জেলায়। জেলা পর্যায়ের নেতারা বলছেন, একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে সরকারি দল, হামলা-মামলায় চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির এক নেতা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ঢাকার মতো জায়গায় যেখানে গা বাঁচিয়ে সভা-সমাবেশ হচ্ছে, মেহেরপুরেও সেভাবে গা বাঁচানো কর্মসূচি করা হচ্ছে। এই নেতা আরো বলেন, শরিক দল দিয়ে কেবল নামের তালিকা ভারি করা যায় কিন্তু তেমন কাজ হয় না। মেহেরপুর জেলা বিএনপির যে জনসমর্থন আছে, সুষ্ঠু রাজনীতির পরিবেশ পেলে আন্দোলন সংগ্রাম করতে কোনো শরিক দলের প্রয়োজন নেই। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তর বাইরে তাদের কিছুই করণীয় নেই।

বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনার পুরোভাগে রয়েছেন জেলা সভাপতি সাবেক এমপি মাসুদ অরুণ ও বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের অতিরিক্ত মহাসচিব জাকির হোসেন, ইলিয়াস হোসেন, হাফিজুর রহমান হাফি ও আলমগীর খান ছাতু।

জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি মাসুদ অরুণ দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সরকার যাতে সঠিকভাবে চলে সেজন্য শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। দরকার সুষ্ঠু রাজনীতি করার পরিবেশ। কিন্তু এখন সে পরিবেশ নেই। অনুমতি সাপেক্ষে রাজনীতি হয় না। অনুমতি ছাড়া কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। দলের পক্ষে মিলাদ মাহফিল করতে গেলেও ঘরোয়া পরিবেশে এবং মানুষের উপস্থিতির সংখ্যাও নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার শিউলে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ‘বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা’ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রেখেছেন মেহেরপুর জেলা বিএনপির সদস্য জাকির হোসেন। যেখানে ১২টি দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ শতাধিক দেশের প্রতিনিধি ছিলেন। দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী এই নেতা বলেন, দলে গ্রুপিং আছে।

এ আসনে জামায়াতেরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার রয়েছে। বিগত সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হয়েছিলেন জেলা জামায়াতের আমির হাজী ছমির উদ্দীন। যুদ্ধাপরাধী বিচারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখা তারই বড় ছেলে তারিকুল ইসলাম পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়। তার কিছুদিন আগে তিনি সপরিবারে আমেরিকা চলে যান। বর্তমান জামায়াতের প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় না। তবে জেলা আমির মওলানা তাজউদ্দীন খান এ আসনে জামায়াতের দলীয় প্রার্থী বলে জানা যায়।

মেহেরপুর জেলা জাতীয় পার্টির একসময় প্রাণ ছিল সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার আমিরুল ইসলাম পালু। দলের ভাঙাগড়া এবং নিজের শারীরিক অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করায় দল এখন নিষ্ক্রিয়, কেউ অন্য দলে ভিড়েছেন। জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবদুল হামিদ। তিনি জানিয়েছেন, জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে তিনি জোটের পক্ষে দলের মনোনয়ন চাইবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close