দিলরুবা খাতুন, মেহেরপুর

  ১১ নভেম্বর, ২০১৮

আওয়ামী লীগে প্রার্থী বেশি বিএনপির চেষ্টা পুনরুদ্ধার

একসময়ের চরমপন্থি আর হত্যার জনপদখ্যাত মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় শুরু হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। দলের হাইকমান্ডকে নিজের অবস্থান জানান দিতে মহেরপুর-২ (গাংনী) আসনের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্ব পর্যায়ের অনেক নেতাই জনসংযোগে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। তবে জেলার ১ নম্বর আসনের তুলনায় ২ নম্বর আসনটি সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ থেকেছে। এবার আওয়ামী লীগ মাঠে নেমেছে আসনটি ধরে রাখার জন্য। অন্যদিকে দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি হামলা-মামলায় অনেকটা কাবু। তারপরও বিএনপির ‘ভোটব্যাংক’খ্যাত এই আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে দলটি। ফলে এবার আরো ঝুঁকিপূর্ণ হবে নির্বাচন।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে জাতীয় সংসদের ৭৪ নম্বর আসন গঠিত। ২ লাখ ২৪ হাজার ৭৩১ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮০৮ নারী ভোটার।

স্বাধীনতা-পরবর্তী গাংনী ছিল চরমপন্থিদের অভয়ারণ্য। রাত নামলেই মানুষ আতঙ্কিত থাকত। ডাবল মার্ডার, ট্রিপল মার্ডার, সেভেন মার্ডারের ঘটনা আছে এ এলাকায়। এখানে একজন পৌর মেয়র ও তিনজন ইউপি চেয়ারম্যান খুনের ঘটনা ঘটেছে। একটা সময় রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ চরমপন্থিদের ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে চরমপন্থিদের তৎপরতা থেমেছে। তবে উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুদলের মধ্যেই আছে কোন্দল।

বিএনপি নিজেদের কোন্দল ও ক্ষমতাসীন দলের হামলা-মামলায় দল গোছাতে পারছে না। আবার আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের একপক্ষের বিরুদ্ধে আরেকপক্ষ মিছিল-সমাবেশ করার ঘটনা আছে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, অনেক দিন ধরেই গাংনী আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক ও অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বর্তমান সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন। দল থেকে এম এ খালেককে দুবার মনোনয়ন দেওয়া হলেও তিনি আসনটি দলনেত্রীকে উপহার দিতে পারেননি। তাই দলটি দুই ধারায় বিভক্তের কারণে প্রান্তিক নেতাকর্মীরাও দুই ভাগ হয়ে গেছেন। ফলে দল শক্তিশালী হতে না পারাটা অন্যতম কারণ। দলীয় কোন্দল নিরসন না হলে মনোনয়ন যাকেই দেওয়া হোক, তার পক্ষে জয় পাওয়া দুঃসাধ্য হবে বলে জানান তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

এদিকে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগে দলীয় মনোনয়ন পান মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক। কিন্তু সাবেক এমপি মকবুল হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। তার আগে ১৯৯৬ সালেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ৯০-পরবর্তী সময়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মকবুল ছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হতে পারেননি।

বর্তমানে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি কাড়তে আওয়ামী লীগ থেকে জনসংযোগ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক, বর্তমান সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সেলিনা আখতার বানু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজ্জামান খোকন ও সাবেক পৌর মেয়র আহমেদ আলী।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে দুবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন তিনি। এমপি মকবুল হোসেন বলেন, ‘দলের মনোনয়নের মালিক জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার আশাই দলীয় নেতাকর্মী নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’ তবে মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তবে সময়ই বলে দেবে সবকিছু।’

দলে কোন্দল থাকার কথা স্বীকার করেও জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম এ খালেক দাবি করেন, ‘দলের অবস্থান এখন ভালো। মনোনয়ন চাইতে হলে দলের জন্য নিবেদিত হতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় এলেই গাংনীতে নতুন মুখের কথা শোনা যায়। এখানে আওয়ামী লীগের এমন কেউ নেই যে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করেন। তবে সভানেত্রীই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা যে-ই মনোনয়ন পাই না কেন, এ আসনটি নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করব।’

সংরক্ষিত মহিলা আসনের (৩০৭) বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিনা আখতার বানু নির্বাচন করার লক্ষ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘দলকে সুসংগঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। এলাকার উন্নয়নে কাজ করছি। দলীয় সভানেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই নির্বাচন করব।’

এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজ্জামান খোকন বলেন, ‘তৃণমূল এবার তাকে চাচ্ছে। তৃণমূলের চাওয়া এবার তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি এ আসনটি দলকে উপহার দিতে পারবেন। তা ছাড়া বর্তমান সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন বারবার দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে দলকে হারিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। তাই তৃণমূল নেতাকর্মীরাও তাকে চান না।’

প্রতিদিনের সংবাদকে গাংনী পৌরসভার সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আহমেদ আলী বলেন, ‘গাংনীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আজ দিশাহারা। জামায়াত-বিএনপির লোকজনকে পকেট কমিটি করে বাণিজ্য চালানো হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীরা দলকে রক্ষার জন্য বারবার আমাকে বলেন। আমি কেন্দ্রকে জানিয়েছি।’

গাংনী বিএনপিতে বিরোধ নিয়েই সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনসংযোগ করে ফিরছেন। আসনটি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করছে দলটি। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ করছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি জাভেদ মাসুদ মিল্টন, গাংনী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু। এ ছাড়া এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বিএনপি থেকে এ আসনের তিনবারের এমপি আবদুল গনিও বিএনপি জোটের প্রার্থী হতে আগ্রাহী। জোটগতভাবে নির্বাচন হলে তিনি জোটের প্রার্থী হতে পারেন। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু, গাংনী উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর বিএনপির সভাপতি মোরাদ আলীও মনোনয়নপ্রত্যাশী।

দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের হামলা-মামলায় অনেকটাই বিপর্যস্ত বিএনপি। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের বাধায় কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারার দুঃখ আছে বিএনপিসহ শরিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের। সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন এবং জেলা বিএনপি সহসভাপতি জাভেদ মাসুদ মিল্টন পৃথকভাবে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করেন। তাদের বিরোধ দৃশ্যমান। কোনেপক্ষই কারো পক্ষের কর্মসূচিতে উপস্থিত হয় না।

বিএনপি নেতাকর্মীরা মামলা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়। বর্তমানে মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা ওইসব মামলার আসামি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মামলাগুলোর রায়ে সাজা হলে বিপাকে পড়তে পারেন নেতাকর্মীরা। গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের যদি জেলে যেতে হয়, তাহলে ভোটের মাঠে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে বিএনপি।

মেহেরপুর জেলা বিএনপির সম্পাদক ও সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন কাকে দেবে এটা হাইকমান্ডের ব্যাপার। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন সময় থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের দায়ের করা আটটি মামলার আসামি হয়ে বারবার জেলে যেতে হয়েছে। মামলা মোকাবিলা করে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দলীয় মনোনয়ন পেলে অবশ্যই মানুষ তার মূল্যায়ন করবেন।’

স্থানীয়ভাবে দলে কোনো বিরোধ না থাকার দাবি করে জেলা বিএনপির সহসভাপতি, ঢাকায় মুদ্রণশিল্প ব্যবসায়ী জাভেদ মাসুদ মিল্টন বলেন, ‘যেটুকু বিভেদ-বিভাজন তা নেতৃত্বের প্রয়োজনে। মনোনয়নের ব্যাপারে দলের চেয়ারপারসন সব থেকে ভালো জানেন। গাংনীর সাধারণ মানুষ ও বিএনপি নেতাকর্মীরা গাংনীতে কাকে চাচ্ছেন, সেটাই বড় বিষয়। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী কর্মকা-ের মোকাবিলা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল করে যাচ্ছে। আর এটা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের অনেক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন, জেল খাটছেন। এলাকার মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করছেন। ব্যালটের মাধ্যমেই জবাব দিতে চাই।’

এদিকে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) থেকে সাবেক বিএনপি নেতা ও গাংনী আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবদুল গনি। এবারও তিনি বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। যদি দলীয় মনোনয়ন না পান তাহলে তিনবারের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলডিপি থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বলে তার সমর্থকদের সূত্রে জানা গেছে। তিনি জোর দিয়েই বলেছেন, তার সময়ে এলাকায় দৃশ্যমান যে উন্নয়ন হয়েছে, তারপর আর উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। প্রান্তিক জনপদের নির্দলীয় মানুষও তাকে ভোট দেন বলে জানান।

জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল্লাহ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য নূর আহমেদ বকুল দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করে নির্বাচনী এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close