হাসানুজ্জামান তুহিন, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ)

  ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

বহু প্রার্থীর মনোনয়ন দ্বন্দ্বে বড় দুই দল

ভূমিকা রাখতে চায় ছোট দলগুলো

দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতিতে যখন শীতের আগমনীয় বার্তা, তখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে স্থানীয় রাজনীতি। সারা দেশের মতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরে বইছে নির্বাচনী হাওয়া।

তাঁতশিল্প ও দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ শাহজাদপুরে ১টি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন গঠিত সিরাজগঞ্জ-৬ আসন। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসায় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এলাকা সফর ও দলীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। নির্বাচনী এলাকা ছেয়ে গেছে শুভেচ্ছা পোস্টার-ফেস্টুনে। ধর্মীয় ও সামাজিক নানান আয়োজনে তাদের সরব উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। উপজেলা শহর থেকে গ্রামের চায়ের দোকানে চলছে প্রার্থী নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। চলতি বছরের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী, মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৪২ ও নারী ভোটার ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬২২ জন।

স্থানীয় নির্বাচনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম নির্বাচনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল রাজ্জাক মুকুল মিয়া ও ১৯৭৯ সালে বিএনপির সৈয়দ হোসেন মুনছুর নির্বাচিত হন। ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ২০০১ তিনবার এমপি হন

জাতীয় পার্টির ড. এম এ মতিন। ১৯৯১ সালের ৫ম ও মধ্যবর্তী ৬ষ্ঠ সংসদীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী কামরুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৬ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী মো. হাসিবুর রহমান স্বপন নির্বাচিত হলেও ‘ফ্লোর ক্রস’ করে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হন। উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চয়ন ইসলাম এমপি নির্বাচিত হন, তবে ২০০৮ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। সর্র্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাসিবুর রহমান স্বপন।

শাহজাদপুর আসনটি রাজনৈতিকভাবে উত্তরবঙ্গসহ সিরাজগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। বিগত সময়ে এখান থেকে নির্বাচিত হয়ে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন সরকার পরিচালনায়। আওয়ামী লীগ থেকে এ পর্যন্ত ৪ মনোনয়ন প্রত্যাশীর নাম শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমান এমপি হাসিবুর রহমান স্বপন এবং সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য চয়ন ইসলমের নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন মিল্কভিটার ভাইস চেয়ারম্যান, জেলা আইনজীবীর সমিতির নেতা ও পিপি (নারীশিশু) এড. শেখ আবদুল হামিদ লাভলু ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. সাজ্জাদ হায়দার লিটন। নির্বাচনী সভায় একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও, তবে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছেন সবাই।

বর্তমান এমপি হাসিবুর রহমান স্বপন জানিয়েছেন, ‘আমি এমপি থাকাকালীন ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী করেছি, পাশাপাশি দলের উপজেলা সভাপতি হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ের সকল কমিটিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করেছি। আগামীতেও দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমি শতভাগ আশাবাদী।’ সাবেক এমপি চয়ন ইসলাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চয়ন ইসলাম দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষোভে উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘদিন এলাকায় দলীয় ও রাজনৈতিক সকল কর্মকা-ে অনুপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন এসেছে তাই আবার তিনি এলাকায় গণসংযোগে নেমেছেন। সে কারণেই তিনি উপজেলা কমিটির উল্লেখযোগ্য কোনো নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে পাচ্ছেন না।’

‘দলকে বিভাজন না করার জন্যই’ দলীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন দাবি করে সাবেক এমপি চয়ন ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘এমপি থাকাকালীন আমি ছিলাম কর্মীবান্ধব। কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের কর্মকা-কে বাস্তবায়ন করতাম। কিন্তু হাসিবুর রহমান স্বপন নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি একমুখো রাজনীতি শুরু করেন। যা থেকে দ্বন্দ্বের শুরু হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার গণসংযোগ কখনই থেমে ছিল না। আমি মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ আশাবাদী।’

আইনজীবী পেশায় নিয়োজিত অ্যাড. শেখ আবদুল হামিদ লাভলু আওয়ামী লীগের পক্ষে পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় থাকলেও মাঠ পর্যায়ে রাজনীতিতে তেমন দেখা যায়নি। তবে বড় ভাই আইন সচিব হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচনে মাঠে সরব আছেন তিনি। রাজনীতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সক্রীয় অংশগ্রহণ করছেন, আগামী নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। প্রতিদিনের সংবাদকে আবদুল হামিদ লাভলু বলেন, ‘আমি মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আশাবাদী।’ অপরদিকে, আগামী নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. সাজ্জাদ হায়দার লিটন প্রার্থী হিসেবে এলাকায় ব্যানার-পোস্টারে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ফলে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের ভেতর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে দলটির গৃহদ্বন্দ্ব নানাভাবে প্রভাবিত করে।

শাহজাদপুরেও বিএনপি রাজনৈতিক কর্মকা- অনেকটাই স্থবির। তবে নির্বাচনের মাঠে একাধিক প্রার্থী প্রচারণা চালানো নিয়ে বিড়ম্বনায় এই দলটি, ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ভিতরে দ্বন্দ্ব। এ পর্যন্ত সাতজন প্রার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি কামরুউদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ সারোয়ার সম্প্রতি কারামুক্তির পর প্রার্থী হিসেবে কোমর বেঁধে নেমেছেন। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, ‘আমার সময় এ এলাকায় সর্বোচ্চ উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে, যার রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। তাই আমি মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী।’

এই আসনে জাতীয় পার্টির তিনবারের এমপি প্রয়াত ড. এম এ মতিনের ছেলে ও জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ড. এম এ মুহিতের দলীয় কোনো পদ-পদবিতে না থাকলেও দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাত থেকে সাধারণ সদস্য পদ নেওয়ায় সূত্র ধরে নিজেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা শুরু করেছেন। এ নিয়ে বিএনপির মধ্যে বিভক্তিতাও রয়েছে। এ ব্যাপারে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি। তবে তার সমর্থকরা মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ় আশাবাদী।

’৭০-এর নির্বাচন থেকে শুরু করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বহুবার নির্বাচন করেছেন বর্তমান উপজেলা বিএনপির সভাপতি হোসাইন শহিদ মাহমুদ গ্যাদন। প্রচারণায় এবারও মাঠে আছেন তিনি। মনোনয়ন প্রসঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি জানান, ‘কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আমার ব্যাপক যোগাযোগ রয়েছে। আগামী নির্বাচনে আমি মনোনয়ন পাব ইনশাআল্লাহ্।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম সংগঠনের সাবেক ছাত্রনেতা বর্তমানে পৌর বিএনপির সভাপতি বিশিষ্ট গার্র্র্মেন্টস ব্যবসায়ী কে এম তারিকুল ইসলাম আরিফ সম্প্রতি কারামুক্তির পর নির্বাচনী মাঠে দারুণ সক্রীয়। দলীয় প্রার্থিতার আসায় দীর্ঘদিন যাবৎ দলকে পৃষ্ঠপোষকতাসহ মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন তিনি। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, ‘দলের দুর্দিনে দলের নেতাকর্মীর পাশে থেকে আর্থিক ও সার্বিক সকল ক্ষেত্রে আমি দলের সহযোগিতায় রয়েছি। দলীয় কর্মকা-ের বিষয়ে বিবেচনা করলে আমি মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য।’ স্থানীয়ভাবে নাম সর্বস্ব প্রচারণায় রয়েছেন আরো কয়েকজন নেতা। তারা হলেন সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা গোলাম সরোয়ার; সাবেক ছাত্রনেতা ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান মনির ও শফিকুল ইসলাম ছালাম।

যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে ‘ট্রেন পোড়ানো মামলায়’ জেল থেকে ফিরেছেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন হিরু। তিনিসহ উপজেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা তৃণমূলে মনোনয়ন প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিএনপির ওপরে একঘেয়েমি জুলুম নির্যাতন চালিয়ে রাজনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে সরকার। তাই এই স্থবির রাজনীতি থেকে দলকে চাঙ্গা রাখতে এবারের নির্বাচনে তরুণ নেতৃত্ব ও আর্থিক সক্ষমতাপূর্ণ প্রার্থী আমরা আশা করি।’

মহাজোটের শরিক দল হিসেবে নির্বাচনের মাঠে রয়েছে উপজেলা জাসদের সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিকুজ্জামান শফি কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় তিনিও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে সাংগঠনিক এলাকায় সাধ্যমতো প্রচারণা চালাচ্ছেন। অপরদিকে, বামমোর্চার আরেক প্রার্থী রয়েছেন বাসদ (খালেকুজ্জামান) নেতা অ্যাডভোকেট আনোয়োর হোসেন। বাম সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো থাকলেও ভোটের মাঠে দুর্বলতা রয়েছে অনেক। বাম নেতারা বলেন, ‘বিভিন্ন শিল্পপতি, নব্যধনী ও কালো টাকার মালিকদের এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার খায়েশে দান-দাক্ষিণ্য ও অকাতরে অর্থ ব্যয় রাজনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দুই দলই মরিয়া হয়ে ছুটছে কার দখলে যাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফসল। কেউ ভাবছে না সাধারণ মানুষের ভাগ্যের দুরবস্থায়। ব্যবসার মতো তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে নির্বাচনের মাঠে। তাই সাধারণ শ্রেণির ভাগ্য উন্নয়নের রাজনীতি কঠিন হয়ে পড়ছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close