রাকিবুল রাকিব, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)

  ২১ অক্টোবর, ২০১৮

অভাব-অনটনের কষাঘাত

রাস্তার আলোয় চলে শিক্ষার্থী জালালের পরীক্ষার প্রস্তুতি

‘তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বয়স বড়জোর দশ কিংবা এগারো। বৃদ্ধ বাবা কাজকর্ম করতে পারেন না। পেটের দায়ে কাজ নিলাম প্রতিবেশী জবর আলীর বাড়িতে। থাকা-খাওয়াসহ মাসে বেতন ২৫০ টাকা। সারা দিন কাজ শেষে রাতের বেলা বই নিয়ে বসতাম। কিন্তু জবর আলী বলত ‘আমার বাড়িত থাকলে কাম কইর‌্যা খাইতে হইবো, তুই লেহাপড়া করতে পারবি না।’ কিন্তু আমি রাতে লুকিয়ে পড়তাম। এক রাতে বিষয়টি টের পেয়ে তিনি আমার বই-খাতা ছিঁড়ে ফেলেন। তাড়িয়ে দেন বাড়ি থেকে। তখন রিকশা চালানো শুরু করি। এই আয়ের টাকায় চলতে থাকে সংসার ও পড়াশোনা। এভাবে কেটে যায় দশ বছর। নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিকের গ-ি পেরিয়ে আমি এখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছি। অভাব-অনটনের নির্মম কষাঘাতে আমি রিকশাচালক। এই কথাগুলো মাদ্্রাসাশিক্ষার্থী মো. শাহজালালের। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বোকাইনগর গ্রামে। ওই গ্রামের কিল্লা বোকাইনগর ফাজিল মাদ্্রাসার উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র সে। তার বাবার নাম তারা মিয়া (৭০)। মা আল্পনা বেগম গৃহিণী (৫০)। শুক্রবার রাতে জালালের দেখা মিলে শহরের বঙ্গবন্ধু চত্বরে। ল্যামপোস্টের বাতির নিচে রিকশায় বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলে বই রেখে সে বলে উঠে কোথায় যাবেন ভাই, ওঠেন রিকশায়? সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভুল ভাঙে তার। এ প্রতিনিধিকে সে বলে, সামনে আলিম পরীক্ষা। তাই ভাড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু পড়াশোনা করি। এতটুকু কথা বলেই বইয়ে মনোযোগ দেয় সে। কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ চলে গেলে পড়াশোনায় ছন্দপতন ঘটে। আলোর অপেক্ষায় থেকে থেকে অন্ধকারেই বসে জীবনের গল্প জুড়ে দেয় জালাল। সে জানায়, দিনমজুর বাবা রোগাক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে যাওয়ায় চার ভাই রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতাম। তবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে দুই ভাই হালিম, আল-আমিন ও বোন তানিয়া বিয়ের পর আলাদা হয়ে যায়। এরপর থেকে বাবা-মা ও চার ভাই-বোন একসঙ্গেই আছি। ছোটবোন সোনিয়া সপ্তম ও মুক্তামণি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তবে অভাবের কারণে ছোট ভাই জয়নালও পড়াশোনা বাদ দিয়ে রিকশা চালানো শুরু করেছে।

একসময় প্যাডেলচালিত রিকশা চালালেও কয়েক মাস আগে ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত নতুন রিকশা কিনেছে জালাল। প্রতিদিন তার আয় হয় ৫ থেকে ৬০০ টাকা। এ টাকায় চলে সংসার, বাবার চিকিৎসা ও নিজেদের পড়াশোনার খরচ। এদিকে রিকশা চালায় বলে মাদ্্রাসার কিছু সহপাঠী জালালকে কটূক্তি করে। তার সঙ্গে এক বেঞ্চে বসতে চায় না। এসব বিষয় নিয়ে জালাল কষ্ট পায়, তবে কোনো অভিযোগ নেই। তার যত অভিযোগ, তার সবটাই জবর আলীর দিকে। দশ বছর আগে জবর তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তিন মাসের বেতন ৭৫০ টাকাও আটকে দেয়। জীবনের প্রথম উপার্জিত ওই টাকার মায়াটা দশ বছরেও ছাড়তে পারেনি জালাল। টাকার জন্য সে এখনো জবিরকে তাগিদা দেয়। তবে জবির বলেন, ‘এই টেকার আশা তুই ছাইর‌্যা দে।’ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জালাল বলে, ওই টাকা দিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি ও বাবার জন্য লুঙ্গি কেনার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু প্রথম উপার্জনের টাকাটা আত্মসাৎ হওয়ায় কতটা কষ্ট পেয়েছি সেটা কেউ বুঝবে না?

জালাল জানায়, আমার স্বপ্ন পড়াশোনা করে শিক্ষক হব। কিন্তু যে টাকা আয় করি সেটা সংসারেই চলে যায়। পড়াশোনার টাকাটা পাব কোথায়? এরই মধ্যে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। জালাল বই খুলতেই এক যাত্রী রিকশায় উঠে বলে মামা স্টেশন যান দ্রুত, ট্রেন ধরব। জালালও বই গুটিয়ে রিকশা নিয়ে ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে। গতকাল শনিবার সকালে কিল্লা বোকাইনগর ফাজিল মাদ্্রাসার অধ্যক্ষ ছায়েদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শাহজালাল আগামী বছর অইলম পরীক্ষা দেবে। সে রিকশা চালিয়ে সংসার ও পড়াশোনার খরচ জোগায়। বিষয়টি অবগত হওয়ায় তাকে বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাকে সহযোগিতা করে আসছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close