বিবিসি বাংলা

  ১৭ অক্টোবর, ২০১৮

যে কারণে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বি. চৌধুরীকে সরে যেতে হয়

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির সঙ্গে যোগ না দেওয়ায় আবারও আলোচনায় এসেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ২০০২ সালের জুনে রাষ্ট্রপতি থেকে পদত্যাগ করে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। ওই সময় কী ঘটেছিল, তা নিয়েই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।

সেখানে বলা হয়েছে, ২০০২ সালের ২০ জুন বিভিন্ন খবরের কাগজে বড় বড় হরফেÑ কোথাও লাল কালি দিয়েÑ শিরোনাম হয়েছিল। লেখা ছিল, রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপর আস্থা নেই খোদ তার দল বিএনপির সংসদ সদস্যদের। ঘটনা শুধু তাই নয়, বিএনপির সংসদীয় দলের বৈঠকে অনেক সংসদ সদস্য দাবি তোলেন যে রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী পদত্যাগ করুন। অন্যথায় তাকে ইমপিচমেন্ট করার হুমকি দেন তারা। বিএনপি সংসদীয় দলের সভা শুরু হয়েছিল ১৯ জুন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই সভায় তাদের ক্ষোভের বিষয় ছিল মূলত দুটি। প্রথমত, রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না যাওয়া, আর দ্বিতীয়ত, জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।

সংসদীয় দলের সভায় বিএনপির একজন সংসদ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের পুত্র বিরোধীদলীয় নেত্রীর জন্য তোরণ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু আমরা যদি এ ধরনের তোরণ নির্মাণ শুরু করি তাহলে কেমন হবে?’ পরদিন বিএনপির সংসদীয় দলের সভা শেষে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে সর্বসম্মতিক্রমে আহ্বান জানানো হয়। সেদিন তৎকালীন চিফ হুইপ খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘বিএনপি সংসদীয় দল মাননীয় প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপরে আস্থা হারিয়েছে বিধায় তাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অবিলম্বে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হচ্ছে।’

সংসদীয় দলের সভা চলাকালে মাহী বি. চৌধুরী বৈঠক থেকে বেরিয়ে টেলিফোনে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সভার মনোভাব সম্পর্কে জানিয়ে পদত্যাগের পরামর্শ দেন।

একই দিন দলের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি দলের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছেন, তা ক্ষমাহীন ব্যাপার। ভুলেরও একটা মাত্রা আছে। তিনি সে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন।’

বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপর বিএনপির ক্ষোভের নেপথ্যে

মাত্র সাত মাস সাত দিনের মাথায় রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিদায় নেওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে: জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন না করা। রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।

বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সীগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতির ছেলে এবং সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরীর তোরণ নির্মাণ। রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তব্যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ব্যবহার না করা। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুমোদন সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফতাব আহমদকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ-সংক্রান্ত ফাইলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর না করা। ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনে’ রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বেশি সময় পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তোলেন বিএনপির কিছু নেতা। এমন খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।

তাছাড়া অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য এক মাস আমেরিকায় অবস্থান করে দেশে ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি কোনো খোঁজ-খবর নেননি। দল মনোনীত হয়েও রাষ্ট্রপতির নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যয় বাড়ানো। সেনাবাহিনীসহ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরে অধিক সংখ্যক জাতীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে সরকারের একটি মহল থেকে উঠা আপত্তি পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তোলে।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং বিএনপির সিনিয়র নেতা সাইফুর রহমান বলেন, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। কিন্তু তিনি (বদরুদ্দোজা চৌধুরী) জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ মন্তব্য করেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যেতে হবে, নইলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিএনপির নেতা আবদুল মতিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম তাকে প্রেসিডেন্ট বানানো ঠিক হবে না। আমার কথা ফলেছে।’

এ ছাড়া বিএনপি নেতা ও তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদাও রাষ্ট্রপতির সমালোচনায় সরব ছিলেন।

বঙ্গভবন থেকে বিদায় নেওয়ার পর বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, সরকারের সঙ্গে তার একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে কেউ কোনো ব্যাখ্যা নেয়নি।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে তো পাঠানো যেত আসল ঘটনা জানার জন্য। আমি নিজেও দুবার প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছিলাম। কিন্তু কোনো কথা হয়নি।’ বিএনপির সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন বলে বদরুদ্দোজা চৌধুরী উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, যদি তিনি পদত্যাগ না করতেন, তাহলে তাকে সংসদে ইমপিচ বা অভিশংসনের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করা যেত না। কিন্তু তিনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলেন।

২০০৬ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘প্রথম কথা আমি দলের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করি নাই, আর দ্বিতীয়ত, আমি তো দলে ছিলামই না! আমি তো নির্বাচনের আগেই পদত্যাগ করে এসেছি, সুতরাং আমি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেভাবে কাজ করা উচিত ছিল সেভাবেই কাজ করেছি।’

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা প্রসঙ্গে অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, ‘মরহুম জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা সম্পর্কে আমি আমার বাণীতে বলেছিলাম। এক কথা বারবার বলতে হবে কেন?’

বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করতে চাননি খালেদা জিয়া

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। কিন্তু তিনি এতে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। চৌধুরী অনেকটা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং আরো কিছু সিনিয়র নেতা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তার বিষয়ে অনাগ্রহী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জুতসই প্রার্থী না পাওয়ায় অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বেছে নিতে বাধ্য হন খালেদা জিয়াÑ এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে অধ্যাপক চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন কোনো কোনো বিএনপি নেতা।

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিদায়ের পর ২০০২ সালের ২৯ জুন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যে যত বড়ই হোক না কেন, ষড়যন্ত্র করে কেউ পার পাবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের শেকড় কেটে দেওয়া হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close