রফিকুল ইসলাম নান্টু, নাটোর, অমর ডি কস্তা, বড়াইগ্রাম
নির্বাচনী হাওয়া : নাটোর-৪
আওয়ামী লীগে বহু প্রার্থী, দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি
নিজ এলাকায় অবাঞ্ছিত এমপি
জেলার বড় দুইটি উপজেলা গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম নিয়ে নাটোর-৪ আসন। আসনটি আওয়ামী লীগের দুর্গ হলেও এবার দলটির মধ্যে দেখা দিয়েছে কোন্দল। আর এই কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে এবার আসনটিতে জিততে চায় বিএনপি। আর ভোটাররা চান এলাকার উন্নয়ন ও মাদকমুক্ত সমাজ। এদিকে সংসদীয় আসনের দুইটি উপজেলার ওপর দিয়ে গ্যাসের লাইন গেলেও এখনো সেখানে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়নি। ফলে এখানে গড়ে ওঠেনি কোনো শিল্প। বেকারত্ব এখানে গুরুতর সমস্যা। তাছাড়া জেলার বাইরে গিয়ে কাজ করা ছাড়া তেমন কর্মসংস্থান নেই এই দুই উপজেলার। এই সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি ভোটাররা চান মাদক ও সন্ত্রাস মুক্ত এলাকা। ভোটাররা বলেন, রাস্তাঘাটের আরো উন্নয়ন আমাদের দরকার। মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত দুই উপজেলা চাই আমরা। নির্বাচনী আসন ঘুরে দেখা যায়, বিলবোর্ড, পোস্টারিং, ব্যানারে শোভা পাচ্ছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মুখ।
মোবাইলে মেসেজ ও ফেসবুকের মাধ্যমে চলছে প্রচারণা। তবে দুই উপজেলায় মনোনয়নপ্রত্যাশী নতুন মুখ প্রায় দেড় ডজন। বড় দুই দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রায় সমানে সমান। আলোচিত-অনালোচিত মিলিয়ে আ.লীগের মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন ৯ জন। অপরদিকে বিএনপি মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক। এছাড়া জাতীয় পার্টি, জাসদের প্রার্থী আছে।
স্থানীয় নির্বাচনী ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রফিক উদ্দিন সরকার বিজয়ী হন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুসকে প্রথমে বিজয়ী ঘোষণা করলেও পরে জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম সরকার বিজয়ী হন বলে জানান হয়। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নাটোর-৪ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি আসনটি পেলেও ২০০৮ সাল ও ২০১৪ সালে আবারো নিজেদের দখলে আনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল কুদ্দুস বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সরকারের শেষ দিকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বিজয়ী হন। সেবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এশারত আলীর কারণেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল কুদ্দুস পরাজিত হন বলে জানা যায়। সেই সময়ের মতো আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে এবারও জয়লাভ করতে চাচ্ছে বিএনপি। তবে বিএনপির মধ্যেও গৃহদ্বন্দ্বের অভাব নেই। তবে অস্তিত্ব আর ভিত্তি শক্ত করার জন্য তারা নিজের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে।
নাটোর-৪ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭১৬। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৮৪ হাজার ১৩৬ ও মহিলা ভোটার ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৮০।
আওয়ামী লীগ
গত সংসদ নির্বাচনে এ আসনে অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এই আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অন্ত নেই। সংসদ সদস্যের সাথে উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব, মেয়রের সাথে উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব। আর দলের নেতাদের মধ্যে তো প্রতিনিয়ত হচ্ছে সমঝোতা, আর লড়াই।
অভিযোগ রয়েছে, বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী প্রার্থী হলে সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুস তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। এসব দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দুইটি উপজেলার বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা সম্মিলিতভাবে গুরুদাসপুরে মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও সমাবেশ করে সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুসকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। আর এসব দ্বন্দ্বের জেরে স্বয়ং সংসদ সদস্য নিজ উপজেলা গুরুদাসপুরে দলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা অবাঞ্ছিত হয়ে বাস করেন বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের রেস্ট হাউসে। এসব বিষয়ে বর্তমান সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘দলের নেতাকর্মীদের মাঝে বিরোধ থাকতেই পারে। তবে আসলে এলাকার ভোটাররা যা চায় সেটাই হয়।’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ আসনটিতে তার বিরুদ্ধে প্রতিবারই দলের নেতাকর্মীরা বিরুদ্ধাচারণ করার পরও শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচিত হন এবং তিনি বারবার নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনেও এ আসন আওয়ামী লীগের দখলেই থাকবে।
তবে এলাকার দলীয় অনেক নেতাকর্মী মনে করেন দলের মধ্যে থাকা বিরোধ নিষ্পত্তি না করলে আগামীতে দলের জন্য আসনটি হাতে রাখা কষ্ট সাধ্য হবে। কারণ এবার অন্যবারের চেয়ে এবার দলের নেতাকর্মীদের মাঝে বিশৃঙ্খলা ও বিরোধ অনেক বেশি।
বর্তমানে গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম আসন থেকে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস। তার অবর্তমানে এই পরিবারেই মনোনয়ন ধরে রাখতে এখনই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তার মেয়ে কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি। এছাড়া গুরুদাসপুর পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আহাম্মদ আলী মোল্লা, বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রতন সাহা, দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত সাবেক এমপি রফিক উদ্দিন সরকারের ছেলে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আরিফ উদ্দিন সরকার, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমদাদুল হক মোহাম্মাদ আলী এই আসনে মনোনয়ন লাভের জন্য লবিং গ্রুপিং এবং জনসংযোগ করে যাচ্ছেন।
বিএনপি
নাটোর-২ আসন ছাড়া অবশিষ্ট তিনটি আসনেই বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক বেশি। নাটোর-২ আসনটিতে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকলেও তা দৃশ্যমান নয়। তবে নাটোর-০৪ আসনে বিএনপিতে রয়েছে ব্যাপক কোন্দল। ফলে এ আসনেও বিএনপির কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। অপরদিকে ১২ বছর ক্ষমতায় নেই বিএনপি।
এ আসনে প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হচ্ছেন সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগাঠনিক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু অন্যতম। বিগত সময়ে তিনি নাটোর-২ আসনে নির্বাচনের অংশ নিলেও হামলা-মামলার কারণ গত ১০ বছরে এলাকায় স্থায়ী হতে পারেননি তিনি। ফলে পূর্বের আসনে নির্বাচনের অংশ নিতে না পারলে নাটোর-৪ আসনে দলীয় প্রার্থিতা প্রদানের দাবি আছে দুই উপজেলাতেই। তবে মনোনয়ন দৌড়ে মাঠে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হোসেন, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক ও বর্তমানে গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ।
জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য
নাটোর-০৪ আসনে জাতীয় পার্টি জেলা কমিটির সম্পাদক ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন মৃধা দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি ব্যবসায়ী আবুল কাশেম সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ডিএম রনি পারভেজ আলম জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি কেন্দ্রীয় ভাবে মহাজোট থেকে এই আসনের জন্য মনোনীত হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দীর্ঘ দিন ধরে দলের কোনো কার্যক্রম নাটোরে না থাকায় দলের পক্ষ থেকে কোনো নেতার নাম এখনো শোনা যাচ্ছে না। তবে দলের নিবন্ধন নিয়ে জটিলতার কারণে নির্বাচন করলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে হবে।
"