মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ১৫ অক্টোবর, ২০১৮

দলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ তুঙ্গে, এমপি হতে চান ১০ জন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যশোর-১ (শার্শা) আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী সবুজ সংকেতের আশায় কেন্দ্রে জোর লবিং তদবিরে ব্যস্ত সময় পার করছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় প্রধানের এবং স্থানীয় নেতাদের ছবি সংবলিত ব্যানার ফেস্টুন পোস্টার সেঁটে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নড়ে-চড়ে বসতে শুরু করেছে এরই মধ্যে।

যশোরের শার্শা উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে যশোর-১ আসন গঠিত। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল এই আসনে অবস্থিত। এই নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪৮১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার ১৮১ জন। আর নারী ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ২৭ হাজার ৩০০ জন। বিগত ১০টি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৫ বার, বিএনপি ৩ বার, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত একবার করে বিজয়ী হয়েছে।

নির্বাচনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে এই আসনে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার। তবে ১৯৭৯ সালে বিএনপির আলী তারেক, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির ডা. নজরুল ইসলাম, ১৯৮৮ সালে জামায়াতের অ্যাডভোকেট নূর হোসেন, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির মফিকুল হাসান তৃপ্তি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন আওয়ামী লীগের তবিবর রহমান সরদার, ২০০১ সালে বিএনপির আলী কদর, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের শেখ আফিল উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালে শেখ আফিল উদ্দিন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

দেশের সীমান্তবর্তী যশোর-১ আসনে নাম শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন দলের ১০ জন প্রার্থীর। এদিকে ক্ষমতা আর অর্থের দ্বন্দ্বে শার্শা আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন দ্বিধাবিভক্ত। দুই ধারায় ভাগ হয়ে এখানকার নেতাকর্মীরা নিজস্ব ভাব-ভঙ্গিমায় দল পরিচালনা করে আসছে। এখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তিনজন। নির্বাচনী আসনটিতে একক ভোটের হিসাবে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ কিছুটা এগিয়ে। মাঠ পর্যায়ের তথ্য ও বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত ভোটের হিসাব-নিকাশে দেখা যায় একক রাজনৈতিক দল হিসেবে এই আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রিজার্ভ ভোটের সংখ্যা গড়ে ৪০ শতাংশ। বাদ বাকি অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কার্যকর উপস্থিতি নেই।

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত যশোর-১ আসন নৌকার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। শক্ত হাতে বৈঠা ধরে সেই আসনে নৌকাকে মজবুত করেছিলেন আকিজ পরিবারের সন্তান বিশিষ্ট শিল্পপতি, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ আফিল উদ্দিন। নৌকার টিকিট পেয়ে তিনি ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। এবারও তিনি শক্ত প্রার্থী। কিন্তু এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে এখন আওয়ামী লীগের ‘ঘরের মধ্যেই ঘর’ হয়ে গেছে। এবারের সংসদ নির্বাচনে তাই তিনজন নৌকার মাঝি হতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আফিল উদ্দিনের নৌকার টিকিট এবার ছিনিয়ে নিতে সচেষ্ট বেনাপোলের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন ও সাবেক এডিশনাল আইজিপি ও ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্টের সাবেক মহাপরিচালক মো. আবদুল মাবুদ (পিপিএম)।

আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শার্শার তৃণমূলের রাজনীতিতে শেখ আফিল উদ্দিনের অবস্থান অত্যন্ত সুসংহত। ২০০১ সালে রাজনীতিতে এসে শার্শা আওয়ামী লীগের ভাঙা সংসার মজবুত করে গড়ে তোলেন। এ কারণে বেনাপোল পৌরসভা নির্বাচন, ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হয়। ২০০১ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আসা বিশিষ্ট শিল্পপতি শেখ আফিল উদ্দিন প্রথম নির্বাচনে পরাজিত হলেও এলাকায় থেকে দল পুনর্গঠন ও সুসংহত করেন। এজন্য প্রথম দিকের এক দশক ধরে শার্শা ও বেনাপোলে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্ব দেন। ২০০৮ সালে তাই ঝামেলা ছাড়াই তিনি নৌকার মাঝি হয়েছিলেন। কিন্তু এরপরই দলে বিভক্তি শুরু হয়। দলের একাংশ আফিলের বিপক্ষে চলে গিয়ে বেনাপোলের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটনের অনুসারী হন। প্রথম দিকে এটা তীব্র ছিল না। তাই ১০ম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই নৌকার টিকিট পেয়ে এমপি হয়েছিলেন আফিল উদ্দিন। কিন্তু বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দিনে দিনে প্রকট হয়েছে।

তবে ‘আফিল উদ্দিনের বিকল্প নেই’ দাবি করে শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক আলহাজ নুরুজ্জামান দাবি করেন, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে এমপি শেখ আফিল উদ্দিন নজিরবিহীন উন্নয়ন করেছেন। নিজ অর্থে রাস্তা, স্কুল-কলেজ নির্মাণ করেছেন। জুট মিল স্থাপন করে প্রায় ১০ হাজার নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। গত ইউপি নির্বাচনে ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়নে তার সমর্থক চেয়ারম্যান প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। এসব ইউনিয়নে তার ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। তার জয়লাভে যা ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আশরাফুল আলম লিটন এই আসন থেকে নিজেকে দলীয় প্রার্থী হিসাবে প্রচার করে মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকে ইঙ্গিত করে আশরাফুল আলম লিটনের দাবি, শার্শার বিশেষ এক ব্যক্তি দলের গঠনতন্ত্র মানেন না। জেলা কমিটি উপজেলা সংগঠনের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কমিটি দিয়েছে। উনি বিপক্ষে পাল্টা কমিটি দিয়ে দলে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তৃণমূলের কর্মীরা চায় নতুন মুখ।

এই অবস্থায় আওয়ামী ঘরানার বহু কর্মী-সমর্থকরা মনে করছে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নতুন করে নৌকার হাল ধরুক। সেই হিসেবে মাঠে নামেন সাবেক এডিশনাল আইজিপি ও ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্টের সাবেক মহাপরিচালক মো. আবদুল মাবুদ। তবে যে মহলটি তাকে নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন তাদের গ্রহণ যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আর আফিল ও লিটনের দ্বন্দ্বের অবসান না হলে এই আসনে নৌকা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৃণমূল আওয়ামী লীগের। স্থানীয় কয়েকজন নেতা জানান, আফিলের লোকজন লিটনের লোকজনকে সহ্য করতে পারেন না। ঠিক লিটনের সমর্থক নেতাকর্মীরাও আফিলের নেতাদের দেখতে পারেন না। দুই নেতার সমর্থকদের বিবাদে এই আসন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।

অপরদিকে বিএনপির ৪ প্রার্থীও ধানের শীষ মার্কা পেতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানেও রয়েছে দলের মধ্যে বিবাদ। বিএনপির কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ মহসিন কবির, শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ খায়রুজ্জামান মধু, সাধারণ সম্পাদক ও শার্শা সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হাসান জহির প্রার্থী হওয়ার নাম শোনা যাচ্ছে। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত সাবেক কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে দলে নেওয়ায় মনোনয়ন ঠেকাতে মরিয়া একটি পক্ষ। আবার জামায়াতের অস্তিত্ব নিয়েও রয়েছে বিএনপিতে ভয়।

মনোনয়নপ্রত্যাশী মফিকুল হাসান তৃপ্তির ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, বিএনপির এক অংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে মফিকুল হাসান তৃপ্তির রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। অন্য অংশটি তার বিরোধিতা করে আসছে অনেক আগে থেকে। তারপরও তিনি এলাকায় এলে শত শত নেতাকর্মীরা তার পাশে থাকেন। এরই মধ্যে তৃপ্তির বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে দলে। দলীয় নেতাকর্মীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দলীয় চেয়ারপারসন তাকেই মনোনয়ন দেবেন। এদিকে মনোনয়নপ্রত্যাশী শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুজ্জামান মধুর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, মধু ১৯৮৮ সালে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসাবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। দলের দুর্দিনে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত উপজেলা নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন। আগামী দিনে দল তাকেই মূল্যায়ন করবে।

দলের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান জহিরের লোকজনের ভাষ্য, অনেক হামলা-মামলার শিকার, অনেক নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাবরণও করেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি নতুন উদ্দীপনা। শার্শা বিএনপি টিকিয়ে রেখেছেন হাসান জহির। তাই তার বাইরে দলের মনোনয়ন যাওয়ার কারণ নেই। প্রায় একই কথা বলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মহসীন কবীর।

এদিকে, জোটগত নির্বাচন হলে বিএনপির অবস্থান কি হবে তা নিয়েও তৃণমূলে নানা প্রশ্ন ঘুরছে। কারণ ইতোপূর্বে এখানে জোটগতভাবে জামায়াত বিজয়ী হয়েছে। তবে এবার জামায়াতের নিজের ব্যানারে ভোট করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে ভর করে ধানের শীষ মার্কা নিয়ে মনোনয়ন চাইতে পারে। সাধারণ ভোটারদের ধারণা সর্বশেষ জোটগত নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য যশোর জেলার সাবেক আমীর মাওলানা আজিজুর রহমান। তিনি সামান্য ভোটে পরাজিত হন। ফলে জোটের প্রার্থী হিসেবে আজিজুর রহমানকে ভাবছেন তৃণমূলের অনেকে।

জাতীয় পার্টির যশোর জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ও শার্শা উপজেলা সভাপতি ডা. আক্তারুজ্জামান জাতীয় পার্টির একমাত্র কান্ডারী হিসাবে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি এ পর্যন্ত শার্শায় জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে কয়েক দিন ধরে জাতীয় পার্টির ব্যানারে আরেক প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। তিনি হলেন চলচ্চিত্র নায়িকা শাবনূর। শার্শার নাভারণে তার মামার বাড়ি। তবে তার এলাকায় রাজনীতিতে পরিচিতি নেই। তবে প্রার্থী হিসেবে এখানে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারেন সেটাই ভাববার বিষয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'WHERE news_id=144313' at line 3
Error!: SQLSTATE[23000]: Integrity constraint violation: 1062 Duplicate entry '144313' for key 'news_hits_counter.news_id'