ফরিদপুর প্রতিনিধি

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পাটকাঠি ও ছাইয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পাটশিল্প!

অর্থকরী পণ্য হয়ে উঠেছে একসময়ের হেলাফেলার পাটকাঠি। পানের বরজ, পার্টিকেল বোর্ড ও চারকোল কারখানায় পাটখড়ির ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে চারকোল বা পাটকাঠির ছাই রফতানিও হচ্ছে। মূলত গত এক দশক ধরেই এই জ্বালানি বস্তুটির বাজার বাড়ছে। শুধু তাই নয়, দেশে উদীয়মান রফতানিপণ্য হিসেবে শিল্পের মর্যাদাও পাচ্ছে পাটকাঠির ছাই। কৃষকরা বলছেন, বাজারে পাট বিক্রি করে কোনো রকম উৎপাদন খরচ ওঠে। কিন্তু পাটকাঠি বিক্রির পুরো টাকাটাই লাভ! অনেকেই পাটকাঠি কেনাবেচাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। এতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থানও। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের পাটশিল্প।

পাটখড়ি এক সময় গ্রামে-গঞ্জে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকত। শুধু রান্নার কাজে লাগত। তাও সবসময় নয়। পাটের উপজাত এই পাটখড়ি বা পাটকাঠি গ্রামের গৃহিণীদের কাছে বেশ কদরও ছিল। যেমন কদর ছিল বাঁশ, ধানের তুষ কিংবা কাঠ-খড়। তবে অবহেলায় অনেক পাটখড়ি নষ্ট হয়ে যেত। কখনো পুকুরে আবার কখনো ঝিলের পাড়ে। এখন আর সেই দিন নেই। সময়ের পরিক্রমায় বেড়েছে এর বহুমুখী ব্যবহার। পাটখড়ির কদর বেড়েছে বহু গুণ। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে পাটকাঠি। বলা যেতে পারে, এই পাটখড়ি সোনালী আঁশ পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে চমক সৃষ্টি করেছে। কারণ এই পাটখড়ি বিশেষ এক চুল্লিতে পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে কার্বন বা চারকোল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এই কার্বন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কার্বন পাউডার বা চারকোল এখন কিনে নিচ্ছে চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশ। তারা এই পাটখড়ির কার্বন থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, প্রসাধন পণ্য, মোবাইল ব্যাটারি, দাঁত মাজার ওষুধ, খেতের সারসহ অনেক ধরনের পণ্য তৈরি করছে।

ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৮২ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে বেশি। এ থেকে বিপুল পরিমাণ পাটকাঠি পাওয়া যাবে। এক সময় রান্নার জ্বালানি, বেড়া দেওয়াসহ কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে পাটকাঠির ব্যবহার ছিল। আর এখন এই পণ্যের বেশ বড় বাজার তৈরি হয়েছে। ফরিদপুর জেলার পাট চাষিরা জানান, এ বছর জেলার পাটের দাম ভালো থাকলেও মৌসুমের শুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। তাছাড়া জলাশয়ের অভাবে পাট পচাতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের। ফলে অনেকের পাটেই ভালো রং আসেনি। তাই লাভের অঙ্ক হিসাব করতে গিয়ে পাটকাঠিতেই ভরসা করছেন তারা।

কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র চলছে পাট পচানো, আঁশ ছাড়ানো ও শুকানোর কাজ। কৃষকরা এখন পাটকাঠিও বেশ যতেœর সঙ্গে শুকাচ্ছেন। জেলার সদর, বোয়ালমারী, মধুখালী, সালথা, নগরকান্দাসহ বিভিন্ন উপজেলার কৃষক পরিবারগুলো পাট ও পাটকাঠি শুকিয়ে ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত। বোয়ালমারীর সাতৈর এলাকার সিদ্দিক শেখ, তবিবুর মাতুব্বর, ছরোয়ার বেপারী জানান, রান্নার জ্বালানি, ঘরের বেড়া, পানের বরজের ছাউনি ছাড়া আর অন্য কোনো কাজে লাগত না পাটকাঠি। কিন্তু এখন পাটকাঠির ছাই (চারকোল) বিদেশে রফতানি হচ্ছে। সদর উপজেলার আলিয়াবাদ এলাকার পাট চাষিরা জানান, দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে পাটকাঠি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, দামও দিচ্ছেন ভালো। ১০০ মোঠা পাটকাঠি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়, যা এক সময় ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হতো। তারা জানান, পাট আবাদের খরচ পাট বিক্রি করে উঠে আসে। আর পাটকাঠি তাদের লাভের মুখ দেখিয়েছে।

কৃষকদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন ফরিদপুর কৃষি সম্পসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি বলেন, এখন ফরিদপুর থেকে বরিশাল, দাউদকান্দি, ভোলাসহ বিভিন্ন পারটেক্স বোর্ড কারখানা ও আকিজ গ্রুপের মতো বড় বড় কোম্পানিতে এ পাটকাঠি ব্যবহৃত হচ্ছে। সোনালি আঁশ ও পাটকাঠিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, পাটের রুপালি কাঠি এখন কৃষককে আশার আলো দেখাচ্ছে। পাটকাঠির ব্যবসায় অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। প্রায় ছয় বছর ধরে পাটকাঠির ব্যবসা করেন জেলার বোয়ালমারী ঘোষপুর ইউনিয়নের লংকারচর গ্রামের মো. দেলোয়ার শেখ। তার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই এখন এই ব্যবসা শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, চীন ছাড়াও মেক্সিকো, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, ব্রাজিল, তাইওয়ান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে চাহিদা তৈরি হয়েছে। ইউরোপে ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্টে রয়েছে পাটখড়ির কার্বনের ব্যাপক ব্যবহার। আমাদের দেশেও পাটখড়ি থেকে চারকোল তৈরির কারখানার চাহিদা বাড়ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ২৫টির বেশি কারখানা গড়ে উঠেছে। ছাই রফতানি করে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

সোনালি আঁশের দেশে সম্ভাবনাময় নতুন এ রফতানি পণ্যটির বিকাশে একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় পাটকাঠির ছাই শিল্পকে একটি উদীয়মান শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ বিষয়ে তথ্য জানতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে সকল জেলা প্রশাসককে পাটকাঠি পুড়িয়ে ছাই উৎপাদন ও রফতানি বিষয়ে তথ্য পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পাট অধিদফতর বলছে, দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে পাটকাঠির ছাইয়ের বার্ষিক উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বিদেশে রফতানি করে এ খাতে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close