মো. শাকিল আহমেদ, ঠাকুরগাঁও

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

স্ত্রীকে ভালোবেসে ‘মোহিনী তাজ’ বানালেন জুয়েল

ভালোবেসে তাজমহল গড়ে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। কিন্তু যারা ভালোবেসে মহামূল্যবান মুক্তাখচিত স্থাপনা গড়তে পারেননি, তাদের ভালোবাসা কি কম? মোটেই নয়। সেটাই প্রমাণ করলেন ঠাকুরগাঁওয়ের চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েল। তিনি স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তৈরি করেছেন দৃষ্টিনন্দন ‘মোহিনী তাজ’। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও স্ত্রীর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবেই তৈরি করেছেন তার স্বপ্নের এই স্থাপনা।

‘মোহিনী তাজ’-এর অবস্থান ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আখানগর ইউনিয়নের চতুরাখোর গ্রামের মাধবীকুঞ্জে। নিজেই

আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ার ও ডিজাইনারের ভূমিকা পালন করেন। ফিরোজ জামান জুয়েলের স্ত্রী জেসমিন রহিমও একজন চিকিৎসক। ফিরোজ জামান জুয়েল একজন কবি, সম্প্রতি ‘স্বপ্নের প্রাবন্ধিক কাব্য’ ও ‘চিঠিহীন খাম’ নামের দুটি কবিতার বইও বের হয়েছে।

গত বছরের ২৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে মোহিনী তাজ। দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজ দেখার জন্য প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী ভিড় জমান। তারা ‘মোহিনী তাজ’ এর কারুকাজ দেখে মুগ্ধ।

মোহিনী তাজ দূর থেকে দেখে মনে হবে তিন তলা বাড়ি। কিন্তু জুয়েলের কাছে এটা একটা ভাস্কর্য শিল্প। মোহিনী তাজের কারুকাজে জুয়েল তুলে ধরেছেন তার জীবনের ইতিহাস, গুরত্বপূর্ণ কিছু সময়, জীবনবোধ, পরিবার, দেশ ও মানুষের মননশীলতা। মোহিনী তাজ নির্মাণের কারণ জানতে চাইলে চিকিৎসক জুয়েল বলেন, আমার বিয়ের ১২ বছর চলে গেলে আমি বাবা হতে পারিনি। আর কোনোদিন বাবা হতে পারব কি না, এ নিয়ে মানুষের মুখে চলছিল গুঞ্জন।

একদিন ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের এমারজেন্সিতে নাইট ডিউটি করার সময় অল্প ঘুমের মাঝে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম। তিন মাস পর আকস্মিকভাবে জানতে পারলাম আমি বাবা হচ্ছি। সেইদিন স্বপ্নে একটি ঘর দেখেছিলাম। স্বপ্নে দেখা ঘরটি হচ্ছে এই মোহিনী তাজ। মোহিনী তাজ তৈরিতে স্ত্রীর অনুপ্রেরণা প্রসঙ্গে জুয়েল বলেন, জেসমিন শুধু আমার স্ত্রী এটুকু বললে ভুল হবে। আমার প্রতিটি কাজে তার অনুপ্রেরণা রয়েছে।

মোহিনী তাজের ডিজাইন সম্পর্কে তিনি বলেন, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ চার হাজার মাইলের পরিবর্তে ৪০ ফুট ব্যাসার্ধে বৃত্ত আঁকা হয়েছে এটি। পৃথিবীর নকশা, প্রণয়ন, বিন্যাস, সাজসজ্জা, সমন্বয় ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছি। বৃত্তের মাঝে জল ও স্থলের মোটামুটি আনুপাতিকহারে মূল ভবনের চারপাশে জলকে দেখিয়েছি নদীর আকারে। আর স্থলকে চিহ্নিত করেছি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ছায়ার আদলে। দুটি বলের ওপরে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যে ছায়া তৈরি হয় সেই ছায়ার আদলে কাটা হয়েছে ঘরের মেঝে।

তিনি আরো বলেন, দুটি বলের ওপর দ-ায়মান দৃশ্যটি কল্পনা করা হয়েছে। এটি স্মরণ করার জন্য মানুষ যেমন দুটি বলের ওপর দীর্ঘস্থায়ী হয়ে দাঁড়াতে পারে না তেমনি ক্ষণস্থায়ী মানুষের জীবন। পরিবার হল রাষ্ট্রের একক। সে পরিবারকে পূর্বদিকে সম্মুখ ভাগ থেকে দেখলে মনে হবে যে সামনের দুটি সন্তানকে মা যেন ডানা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন, আর বাবা যেন ঠিক তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। উত্তর দিক থেকে দেখলে মনে হবে বাবা-মা মাঝখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আর দুই পাশে দুই সন্তান। যা হেলমেটের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। সেই পরিবার থেকে দেশ যা ঘরের চারপাশে জলের মাঝে লাল সূর্য ও তার চারপাশে সবুজের আদলে করা হয়েছে।

মোহিনী তাজের ভেতরের প্রতিটি তলায় দেখলে মনে হবে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চাঁদ, তারা আর রংধনুর মিশ্রণ। মোহিনী তাজ মোট ১৩টি স্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে শিল্পী তার পরিবারের ১৩ জন ভাই-বোনকে উদ্দেশ্য করেছেন।

জুয়েল এখানে ব্যবস্থা করেছেন কমিউনিটি সেন্টার, শিশুদের বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পটের। চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েলের স্ত্রী জেসমিন রহিম বলেন, আমার স্বামী একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। বিয়ের পর থেকেই তার পরিকল্পনাগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখত জুয়েল সন্তানের বাবা হবে। দীর্ঘ ১২ বছর পর আমাদের ঘরে প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। জুয়েলের প্রতিটি স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের সাধ্যমতো উৎসাহ দিই। তার স্বপ্নের মোহিনী তাজ তৈরির ক্ষেত্রে সবসময় পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছি। আসলে মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে। স্বামীর প্রতিটি স্বপ্ন পূরণে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকতে চাই আমি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close