প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৫ আগস্ট, ২০১৮

বিবিসির প্রতিবেদন

এক বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন শুরু হলো না?

প্রত্যাবাসন আদৌ হবে কিনা বা হলে কবে হবে তা নিয়ে অবিশ্বাস আরো জোরালো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা আছেন, তাদের ফেরত নিতে কয়েক দফা বৈঠকের পর এ বছরের শুরুতেই মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। যেখানে তালিকা অনুযায়ী ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় একটি তালিকা হস্তান্তর করলেও পরে সেখান থেকে একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের দুইটি সংস্থাও মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের পরিস্থতি পর্যবেক্ষণ শেষে বাংলাদেশে ফিরেছেন গত রোববার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস ও সন্দেহ আরো জোরালো হচ্ছে। কেন এই অবস্থা তৈরি হলো?

মিয়ানমারে সাজানো গোছানো সংসার ফেলে এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ফাতেমা বেগম বিবিসিকে বলেন,‘ আমরা তো অনেকবারই শুনেছি যে আমাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু ফিরিয়ে নিলেই কি সব শেষ? আমাদের নিরাপত্তা কি থাকবে? এক বছর হয়ে গেল। কেউ তো এখন আর কিছু বলছে না। চুক্তি হচ্ছে নাকি হচ্ছে না সেগুলোও আমরা জানি না।’

উখিয়ার থাইনখালি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রাশেদা বেগম বলেন, ‘এখানে আমরা ১০ জন থাকি। ১৫ দিনে চাল পাই মাত্র ৩০ কেজি। এতে দুই বেলাও ঠিকমতো খাওয়া যায় না। পাহাড়ের অনেক নিচে থেকে পানি আনতেও খুব কষ্ট হয়। যখন বৃষ্টি হয় তখন পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি ঘরের ভেতর দিয়ে নিচে চলে যায়। ঘুমাতে পারি না কেউই। কিন্তু তবুও মিয়ানমারের চেয়ে আমরা এখানেই ভালো আছি।’ রাশেদার খুপড়ি ঘরের পাশেই সৈয়দ উল্লাহ-নার্গিস দম্পতি অবশ্য মনে প্রাণে ফিরতে চান মিয়ানমারে। সেখানকার কথা মনে করতেই অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন নার্গিস। মুখে কোনো ভাষা নেই। তার স্বামী সৈয়দ উল্লাহ আশাবাদী দেরি হলেও মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।

মিয়ানমারে ফিরতে চান সৈয়দ উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘একবছর হয়ে গেল কিন্তু মিয়ানমার এখনো আমাদের নিচ্ছে না। প্রক্রিয়া শুরু হলেই তারা নানান টালবাহানা করে। তবে নাগরিকত্বসহ আমাদের দাবি-দাওয়া না মানলে কিন্তু আমরা যাব না।’ সৈয়দ উল্লাহর মতো আরো অনেকেই বিবিসিকে জানিয়েছেন তারা নিজ দেশে ফিরতে চান। কিন্তু ফেরার প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় তারা হতাশ। বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা আছেন, তাদের ফেরত নিতে কয়েক দফা বৈঠকের পর এ বছরের শুরুতেই মিয়ানমারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।

ওই চুক্তিতে তালিকা অনুযায়ী ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা হস্তান্তর করা হলেও পরে আর একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।

কেন এ অবস্থা হলো? এর উত্তরে অবশ্য বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন মনে করছে, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারে যে অবকাঠামো দরকার তা এখনো না হওয়াতে এবং রাখাইনে নিরাপত্তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাসের কারণেই প্রত্যাবাসনে দেরি হচ্ছে।

বাংলাদেশের অতিরিক্তি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামছুদ্দৌজা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা তাদের গ্রামে ফিরতে চায়। আর মিয়ানমার চায় আগে কিছু দিন ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখতে। এটা নিয়েও সন্দেহ আছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। সবকিছু নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করতে মিয়ানমারে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিল। তারা রাখাইন সফরও করেছেন। মিয়ানমারের প্রস্তুতি দেখেছেন। আশা করি এই সফরে প্রত্যাবাসন নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে গত কয়েক মাসে মিয়ানমারে ফেরার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস আরো বেড়েছে। এত দিন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা চেয়ে এসেছিলেন। কিন্তু গত জুনে জাতিসংঘের দুইটি সংস্থার সঙ্গে মিয়ানমারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা নিয়ে নিজেরাই এখন সন্দিহান হয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ এর সভাপতি মুহিব উল্লাহ এ ব্যাপারে বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, চুক্তিতে কী আছে? কিন্তু তারা আমাদের কিছুই জানায়নি। শুধু বলেছে চুক্তিতে আমাদের ভালো হবে। কিন্তু খবরে দেখছি যে, চুক্তিতে আমাদের নাগরিকত্ব, শিক্ষা বা মুক্তভাবে চলাফেরার মতো বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাহলে এভাবে ফেরত গিয়ে আমাদের কী লাভ?’ তবে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর অবশ্য বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের চুক্তি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে নিরাপদ ও টেকসই করবে।

ইউএনএইচসিআর কিংবা বাংলাদেশের শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশন সবার বক্তব্যেই এটা পরিষ্কার যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হয়তো খুব সহসাই শুরু হচ্ছে না এবং যখন শুরু হবে তখন তা শেষ হতেও লেগে যেতে পারে দীর্ঘ সময়। ফলে বলা যায়, রোহিঙ্গাদের অপেক্ষার অবসানও খুব সহসাই শেষ হচ্ছে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close