পাঠান সোহাগ

  ১৫ আগস্ট, ২০১৮

ইতিহাস আর আবেগের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ঘিরে বাঙালির আবেগের এতটুকুও কমতি নেই। ইতিহাসের সাক্ষী এ বাড়ি একনজর দেখতে এখনো প্রতিদিনই শত শত মানুষ ভিড় করে। আর আগস্টের ১৫ তারিখ এলেই সেই ভিড় আরো বেড়ে যায়, অনেকে ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে। আবেগতাড়িত হয়ে এখানে এসেই মনের অজান্তে কেঁদে ওঠেন। তাদের দুচোখের সামনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ভেসে ওঠে। গত সপ্তাহের কয়েকদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা যায়।

সরেজমিনে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এই বাড়ির সামনে দাঁড়ালে ভেতরটা মুচড়ে যায়, মনে হয় এখনিই দোতলার বারান্দায় হ্যান্ডমাইক নিয়ে হাজির হবেন বঙ্গবন্ধু। সংকটে দিকনির্দেশনা দেবেন। শিশু-কিশোর তরুণদের মধ্যেও সেই বাড়ি সম্পর্কে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এমনটাই জানালেন কয়েকজন তরুণ ও বয়স্ক মানুষ।

কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহ থেকে পারভেজ রায়হান ঘুরতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি আগেও দেখেছি। ঢাকায় এলেই একবার এখানে আসি। এখানে এলে মনে অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়।’ মিরপুরে তাসদিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির বাসভবন এতটা সাদামাটা, বিভিন্ন আসবাবপত্রও অত্যন্ত সাধারণ মানের। এটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই।’

সরেজমিনে বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটির দেয়ালে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত দেয়াল তেমনি আছে। মূল সিঁড়িতে এখনো সেই রক্তের দাগ লেগে আছে। নিচতলার প্রথম কক্ষে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তোলা বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ছবি। রয়েছে পরিবারের নিহত অন্যান্য সদস্যের তৈলচিত্র। দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। ১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল এবং বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানেই পড়ে ছিল। এই ঘরের সামনে করিডর থেকে নিচে যাওয়ার জন্য যে সিঁড়ি, সেখানেই ঘাতকরা গুলি করে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে বিছানার পাশে ছোট টেবিলে আছে তার ব্যবহার্য পাইপ, তামাকের কৌটা। আরো আছে টেলিফোন সেট, রেডিও, কিছু রক্তমাখা পোশাক। সামনের খাবার ঘরের পাশেই রয়েছে শিশু রাসেলের ব্যবহার করা বাইসাইকেল। শেখ জামালের কক্ষে রয়েছে তার সামরিক পোশাক। শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানার কক্ষও একই তলায়। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। ওই কক্ষে রয়েছে তার বিভিন্ন সংগীতযন্ত্র। বাড়ির রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিলগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো। এই ভবনে মোট নয়টি কক্ষে বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশু রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে খাওয়ার টেবিল, টেবিলের ওপর থালা-বাটি। আছে রেক্সিনের সোফা। এই সোফায় বিশ্রাম নিতেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির দেয়ালে, দরজায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন।

সাদা রঙের এই বাড়ি এখন ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’। মূল কাঠামো পরিবর্তন না করেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’। এর পেছনেই জাদুঘরের সম্প্রসারিত নতুন ভবন। এতে ‘শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন’ নামে দুটি গ্যালারি আছে। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট এই অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ছয় তলা ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে। আর পঞ্চম তলায় পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। জাদুঘরের প্রতিটি জিনিসের বর্ণনা লেখা রয়েছে।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনো মতে তিনটি কামরা করে এসে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা করে কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। নিচতলায় চলত রাজনৈতিক কর্মকান্ড। নিচে আব্বার শোয়ার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাড়িটি বেদখল ছিল। পরে ১৯৮১ সালেই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বাড়িটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালের ১১ এপ্রিল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ গঠনের পর বাড়িটিকে ট্রাস্টের অধীনে দেওয়া হয়। ট্রাস্টের উদ্যোগে বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

এই জাদুঘরের প্রবীণ গাইড মোজাম্মেল হক জানান, স্বাধীন বাংলার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এই বাড়িটির অনেক স্মৃতিবিজড়িত। তিনি বলেন, দর্শনার্থীদের জন্য সপ্তাহের মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। বুধবার সাপ্তাহিক ছুটি। এ ছাড়া সরকারি ছুটির দিনে জাদুঘর বন্ধ থাকে। তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো টিকিট লাগে না। এ ছাড়া শুক্রবার ১২ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুর টিকিট প্রয়োজন হয় না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close