নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ জুন, ২০১৮

শেখ হাসিনা যেভাবে আ.লীগের সভানেত্রী হয়েছিলেন

বিদেশে অবস্থানকালে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় শেখ হাসিনাকে। দিনটি ছিল ১৭ মে, ১৯৮১ সাল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছাসহ পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য নিহত হওয়ার ছয় বছর পর প্রবাস থেকে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। এরপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্তপ্রতীক।

১৯৭৫ সালে যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সেসময় বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কেবল শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা। পরবর্তীতে তিনি আশ্রয় পান ভারতে। প্রবাসে ছয় বছর অতিবাহিত করার পর দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তারও আগে ১৯৮১ সালেই শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

শেখ হাসিনা কীভাবে আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে উঠলেন, সে প্রসঙ্গ আছে তার প্রয়াত স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার রচিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইতে। সেই সময়কার ঘটনার পরম্পরা উঠে এসেছে পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার লেখায়।

শেখ হাসিনা ও ওয়াজেদ মিয়া যখন ভারতে অবস্থান করছিলেন, তখন ১৯৭৯ ও ১৯৮০Ñ এই দুই বছরে কয়েকজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা বিভিন্ন সময় দিল্লি যান তাদের খোঁজখবর নিতে।

এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে লিখেছেন, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক কাবুল যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, তৎকালীন যুবলীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দিল্লিতে যান। তাদের সে সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে রাজি করানো।

এ প্রসঙ্গে ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের উপরোল্লিখিত নেতাদের দিল্লিতে আমাদের কাছে আসার অন্যতম কারণ ছিল ঢাকায় ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের ব্যাপারে হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় করা। তাদের সবাই এবং হাসিনার চাচি (বেগম নাসের), ফুফু আম্মারা এবং ফুফাতো ভাইয়েরা চাচ্ছিলেন যেন হাসিনা আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন। আমি এ প্রস্তাবে কখনোই সম্মত ছিলাম না।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমি তাদের সকলকে বলেছিলাম যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অকল্পনীয় মর্মান্তিক ঘটনার পর বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়স্বজনদের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা উচিত হবে না। অন্তত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত।’

তবে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতেই ঘোষণা করা হয় দলের সভানেত্রী হিসেবে। ড. মিয়ার বইতে ওই বিবরণ আসে এভাবে : ‘১৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৮১) তারিখের সকালে লন্ডন থেকে ফোনে সংবাদ পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে হাসিনাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর শেখ সেলিমও হাসিনাকে ফোনে একই সংবাদ দেন। এরপর ঢাকা ও লন্ডন থেকে আরো অনেকে টেলিফোনে হাসিনাকে অভিনন্দন জানান।’

তিনি আরো লেখেন, পরদিন দিল্লিস্থ অনেক সাংবাদিক শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে তার মন্তব্য ও মতামত প্রকাশ করেন। এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের ওই সময়কার শীর্ষ নেতারা যান দিল্লিতে।

‘২৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৮১) তারিখে ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের আবদুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, স্বামী গোলাম আকবার চৌধুরীসহ বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ দিল্লি পৌঁছান।’Ñ এভাবেই ঘটনাবলির বর্ণনা করেন ওয়াজেদ মিয়া। তারা শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন বলেও জানান ওয়াজেদ মিয়া তার লেখায়। এরপর ড. কামাল হোসেন ও সাজেদা চৌধুরী ছাড়া সবাই ঢাকায় ফিরে যান।

‘ড. কামাল হোসেন এবং বেগম সাজেদা চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল আমাদের পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করে হাসিনার ঢাকা ফেরার তারিখ চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করার জন্য’, লেখেন ওয়াজেদ মিয়া। তবে শেখ হাসিনার ঢাকা ফেরার বিষয়ে ড. কামাল হোসেন ও সাজেদা চৌধুরী মার্চের দুটো সম্ভাব্য তারিখ প্রস্তাব করলেও ওই তারিখের ব্যাপারে ওয়াজেদ মিয়ার আপত্তি ছিল।

ওয়াজেদ মিয়ার বর্ণনায়, ‘এরপর মে মাসের ১৭ তারিখ ফেরার দিন চূড়ান্ত হয়। ১৬ তারিখে আওয়ামী লীগের আব্দুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে পুতুলকে নিয়ে দিল্লি থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। এরপর ১৭ মে তারিখে সন্ধ্যায় তারা কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান।’

শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করার বিষয়টি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন দলের অন্যতম সিনিয়র নেতা আবদুর রাজ্জাক, এ কথা বলেছেন সে সময়কার আওয়ামী লীগ নেতা ও শেখ মুজিব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘মূল নেতা যাদের মনে করা হতো তারা হত্যাকান্ডের শিকার হলেন। দলও কিছুদিনের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ’ এরপর দলের মধ্যে যে কয়েকজন নেতা রয়েছেন তাদের মধ্যে একক কাউকে টানাহেঁচড়া না করে সাতজনের যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মতৈক্য হয়, জানান ড. কামাল হোসেন।

১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা হয়। এরপর দলের প্রেসিডেন্ট করা হয় জোহরা তাজউদ্দীনকে এবং সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক। রাত দুটোর সময় এই সিদ্ধান্ত হয় আর ঠিক হয় পরদিন এ ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়া হবে। কিন্তু পরদিন সকালে ঘটল ভিন্ন এক ঘটনা, যা মোড় পাল্টে দিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের।

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সকাল সকাল আমার কাছে আসেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর স্বামী এখন মারা গেছেন নাম বলতে পারি। তিনি এসে বললেন, খুব ভালো কাজ হয়েছে কাল রাতে, পার্টি বাঁচিয়ে দিয়েছেন। দেখুন আর একটা কাজ করা যায় কি না, আপনি তো বলেছিলেন শেখ হাসিনাকে সসম্মানে আনবেন। ওকে তো নিয়ে আসার একটা সুযোগ হয়েছে। ওকে চেয়ারম্যান করে দিন না! ওর তো ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে, ওকে যদি চেয়ারম্যান করে এটা বলা যাবে।’

এর পরের ঘটনা সম্পর্কে কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি বেগম তাজউদ্দীনকে বললাম, তার যে উদারতা, বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন ‘অবশ্যই অবশ্যই, আমি (বেগম তাজউদ্দীন) প্রস্তাব দেব ওকে চেয়ারম্যান করার জন্য।’ আমি (কামাল হোসেন) তখন বললাম, ‘আপনি বললে আমি সমর্থন দেব।’ এবং এটাই হলো, বেগম তাজউদ্দীন বললেন, আমি সমর্থন করলাম, ওকে নিয়ে আসো। কেননা হাসিনা কোনো দিন এটা দাবি করবে অথবা চিন্তাও করবে, সেটা চিন্তার বাইরে ছিল।’ এটা করল কিন্তু রাজ্জাক (আব্দুর রাজ্জাক), সে পাঠিয়েছিল চৌধুরী সাহেবকে (সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী)।’ ড. কামাল হোসেন বলেন, তারা শেখ হাসিনাকে আনতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist