উপল বড়ুয়া

  ১৩ জুন, ২০১৮

ব্রাজিলের হেক্সা মিশন

শুরুতেই একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া যাক। ব্রাজিলকে ছাড়া আপনি কি কখনো ফুটবল বিশ্বকাপ কল্পনা করতে পারবেন? এমন চিন্তা খোদ বিশ্ব ফুটবলের অন্যান্য পরাশক্তির দেশগুলোও হয়তো পারবে না। পারবে না বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটি ফিফা। পারবে না পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ফুটবল ভক্ত। সেলেকাওরা না থাকলে যে বিশ্বকাপের মূল আবেদনটায় কমে যাবে!

বিশ্বকাপের শিরোপার দিক থেকে হোক বা অংশগ্রহণ, সব জায়গায় প্রথমে চলে আসবে একটি নামÑ ব্রাজিল। পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ২১ বার টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণসহ অসংখ্য রেকর্ডের মালিক বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তির দেশটি। ব্রাজিলের ‘জোগো বোনিতো’ বা ছন্দময় ফুটবল কিংবা সাম্বা নৃত্যে পাগল হয়নি এমন ফুটবল দর্শক খুঁজে পাওয়া পৃথিবীতে দুষ্কর। বিশ্বকাপের সেই শুরু থেকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশটি তাদের নিপুণ ফুটবলশৈলী দিয়ে মুগ্ধ করে আসছে ফুটবলপ্রেমীদের। কিন্তু বর্তমানে সেলেকাওদের পায়ে অতীতের সেই জাদু না থাকলেও এখনো সমর্থকদের কাছে ব্রাজিল অনন্য দল।

কেবল বিশ্বকাপে নয়, যেকোনো আসরেই ব্রাজিলের গায়ে থাকে ফেভারিটের তকমা। ‘কোপা আমেরিকা’ নামে পরিচিত ল্যাটিন ফুটবলের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতার শিরোপা জিতেছে তারা ৮টি। সাতবারের অংশগ্রহণে কনফেডারেশন কাপ জিতেছে চারবার। নিজেদের ইতিহাসে বাকি ছিল শুধু অলিম্পিক শিরোপা। নেইমার, গ্যাব্রিয়েল জেসুসদের হাত ধরে মুকুটে সেই পালকটাও তারা যোগ করে ২০১৬ অলিম্পিক প্রতিযোগিতায়। তাও জার্মানদের বিপক্ষে প্রতিশোধ নিয়ে। ব্রাজিল হচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সব ফুটবলারদের আঁতুড়ঘর। দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম দেশটি যুগে যুগে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি ফুটবলারদের। এই দীর্ঘ তালিকায় আছেন পেলে, গারিঞ্চা, জিকো, সক্রেটিস, রোমারিও, রিভালদো, টোস্টাও, বেবেতো, মারিও জাগালো, জিজিনহো, জারজিনহো, কাফু, কাকা, দিদা, দুঙ্গা, গিলবার্তো সিলভা, রবার্তো কার্লোস, রোনাল্ডো, রোনালদিনহো, নেইমারসহ অনেকে। কখনো ফুটবলার প্রতিভার অভাব পড়েনি সেলেকাওদের।

রাশিয়া যাওয়ার জন্য কনমেবল অঞ্চল থেকে এবার সর্বপ্রথম টিকিট পেয়েছে ব্রাজিল। দক্ষিণ আমেরিকার ১০টি দলের বাছাইপর্বের লড়াইয়ে ১২ ম্যাচে জিতেছে হলুদ-সবুজ জার্সির দলটি। সব মিলে ১৮ ম্যাচে ৪১ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষ থেকে রাশিয়ার টিকিট নিশ্চিত করে তারা।

বিশ্বকাপে ব্রাজিল মানেই রেকর্ডের ছড়াছড়ি। এবার তার কিছু জেনে নেয়া যাক। পাঁচ শিরোপা ও সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ ছাড়াও ব্রাজিল সবচেয়ে বেশি কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা দল। মোট ১৬ বার শেষ আটে খেলেছে সেলেকাওরা। তাছাড়া গ্রুপপর্বে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটাও তাদের। ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। তিনটি বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র ফুটবলার ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলে। টানা শিরোপা না জিতলেও তিনটি করে ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা আছে কাফু ও রোনাল্ডোর। এক আসরে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়ী দল হচ্ছে ব্রাজিল। ২০০২ জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে সাতটিই ম্যাচেই জিতেছিল সেলেকাওরা। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ৭০ ম্যাচ জয়ের রেকর্ডটাও তাদের দখলে।

বিশ্বকাপের প্রথম আসর থেকেই অংশগ্রহণ করে আসছে ব্রাজিল। তবে অভিষেক ও দ্বিতীয় বিশ্বকাপে তেমন কোনো নজর কাড়তে পারেনি তারা। ঘরে ফিরে গ্রুপপর্ব থেকে। এরপর থেকেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে শুরু করে দেশটি। ১৯৩৮ সালে প্রথমবার তৃতীয়স্থান অধিকার করার পর সাফল্যের জন্য আর তেমন অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের। ১৯৫০ বিশ্বকাপের রানারআপ ব্রাজিল প্রথম বিশ্বকাপ ঘরে তুলে ১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপে। এরপর ১৯৬২ চিলি বিশ্বকাপে সেই শিরোপাটা ধরে রাখে তারা। ১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইতালিকে হারিয়ে তৃতীয়বারের বিশ্ব সেরার খেতাব জিতে দলটি। ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের ফাইনালে টাইব্রেকারে আরেকবার আজ্জুরিদের হারিয়ে শিরোপা স্বাদ গ্রহণ করে রোমারিও-বেবেতোরা। পরের ১৯৯৮ আসরে পুনর্বার ফাইনাল খেলে দলটি। কিন্তু স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে ৩-০ গোলে হারায় টানা দ্বিতীয় শিরোপার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় ব্রাজিলিয়ানদের। তবে সেই আক্ষেপটার বয়স বেশিদিন বাড়তে দেয়নি তারা। পরের এশিয়া বিশ্বকাপেই ইউরোপ পরাশক্তি জার্মানিকে হারিয়ে পঞ্চম শিরোপা ঘরে তুলে ব্রাজিল। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দলটি পরের দুই আসরে বলার মতো আর কোনো গল্প লিখতে পারেনি।

তবে গত আসরটি নিজ দেশে আয়োজন করে ব্রাজিল। স্বাগতিক হওয়ায় হেক্সা জয়ের মিশনেরর স্বপ্ন দেখছিল তারা। প্রথম রাউন্ড থেকে দোর্দন্ড প্রতাপে এগিয়ে যাচ্ছিল সেলেকাওরা। সেমিফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় জার্মানির বিপক্ষে। কিন্তু তার আগেই তাদের জন্য দুঃসংবাদ হয়ে আসে দলের প্রাণভোমরা নেইমারের চোট ও অধিনায়ক থিয়াগো সিলভার লালকার্ডের নিষেধাজ্ঞা। ঘরের মাঠে ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামে ব্রাজিল। তবে ফুটবল বিধাতা এদিন মুখ সরিয়ে নিয়েছিল তাদের কাছ থেকে। জন্ম হয় ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অঘটনটির। ফাইনালে উঠার লড়াইয়ে জার্মানির বিপক্ষে তারা বিধ্বস্ত হয় ৭-১ গোলে। যা তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের হারও।

গতবার পারেনি। এবার সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে ষষ্ঠ শিরোপা জয়ের মিশনের জন্য প্রস্তুত সেলেকাও বাহিনী। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতেও নিজেদের ভালোভাবে ঝালিয়ে নিয়েছে দলটি। গত তিনটি প্রীতি ম্যাচেই জয় পেয়েছে তারা।

রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিল খেলবে স্বদেশি কোচ টিটের অধীনে। দুর্দান্ত এই টেকটিশিয়ানের কল্যাণে টালমাতাল অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দলটি। বিশ্বকাপে দলটির প্রাণভোমরা হচ্ছেন নেইমার। গত মাসেও চোটের কারণে এই পিএসজি তারকার রাশিয়া যাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু সব শঙ্কা দূর করে দিয়ে ২৬ বছর বয়সী ফরওয়ার্ড ফিরেছেন রাজসিক বেশে। গত দুই প্রীতি ম্যাচে দুইটি গোল করে জানান দিয়েছেন বিশ্বকাপের জন্য তিনি কতটুকু প্রস্তুত। নেইমারও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ব্রাজিলকে হেক্সা জেতাতে।

এবার তারকায় ভরপুর একটি ব্যালেন্সড দল নিয়েই রাশিয়া যাবেন টিটে। দলের প্রায় ফুটবলারই খেলেন ইউরোপের শীর্ষ লিগের ক্লাবগুলোতে। নেইমার ছাড়াও ম্যাচের স্পটলাইটটা কেড়ে নিতে পারেন ফিলিপ্পে কুতিনহো, গ্যাব্রিয়েল জেসুস, মার্সেলো, রবার্তো ফিরমিনো, উইলিয়ানদের মতো তারকারা। তবে বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলকে শুনতে হয়েছে বড় একটি দুঃসংবাদ। চোটের কারণে চূড়ান্ত দল থেকে বাদ পড়েছেন অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার দানি আলভেজ। তাছাড়া সদ্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে চুক্তি করা ফ্রেডও পড়েছেন চোটের কবলে। প্রধান অস্ত্র নেইমার সদ্য নির্বাসন থেকে ফিরলেও এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেননি।

ব্রাজিল হেক্সা জয়ের মিশনে নামবে ১৭ জুন সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে, রোস্তভ অ্যারেনায়। ‘ই’ গ্রুপে টিটের শিষ্যদের অন্য দুই প্রতিপক্ষ হচ্ছে কোস্টারিকা ও সার্বিয়া। দেখার বিষয়, পেলের যোগ্য উত্তরসূরি নেইমার ব্রাজিলকে ষষ্ঠ শিরোপাটা এনে দিতে পারেন কিনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist