উপল বড়ুয়া
দল পর্যালোচনা: আর্জেন্টিনা
এবার ঘুচবে মেসিদের অপেক্ষা?
চার বছর পর পর বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর শুরু হলে বাঙালি বিভক্ত হয়ে পড়ে দুই ভাগে। এক ভাগের সমর্থন থাকে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের ওপর। অন্য ভাগ মেতে উঠে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে নিয়ে। দুই দেশের সমর্থনে বাংলাদেশের শহর-গ্রামে একমাস ধরে উড়তে থাকে অগণিত পতাকা। এবারও আসন্ন বিশ্বকাপ খেলতে দুই ল্যাটিন পরাশক্তি এরই মধ্যে পা রেখেছে রাশিয়ায়।
আর্জেন্টিনার কথা যখন উঠে তখন অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে ডিয়েগো ম্যারাডোনার কীর্তিকথা। এই মহানায়কের একক নৈপুণ্যে ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপে লা আলবিসেলেস্তেরা দ্বিতীয় বিশ্বসেরার শিরোপা ঘরে তুলেছিল। ফাইনালে ম্যারাডোনার দল পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়েছিল ৩-২ গোলে। ১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপেও ম্যারাডোনা তার অনন্য পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু এবার টানা দ্বিতীয় শিরোপার স্বাদ নিতে পারেননি ‘ফুটবল ঈশ্বর।’ পশ্চিম জার্মানি বদলা নেয় আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে।
শিরোপা হারালেও সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীর হৃদয় জয় করে নেন ম্যারাডোনা। হয়ে উঠেন বিশ্বসেরা ফুটবলার। এই কিংবদন্তি ফুটবলার নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলেন ১৯৯৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু ডোপ টেস্টে প্রমাণিত হওয়ায় মাঝপথেই থেমে যেতে হয় তাকে। এরপর থেকে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিতে পারেননি কেউ। প্রতিটি বিশ্বকাপে ল্যাটিন ফুটবল শক্তির দলটি এসেছে বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু আশা জাগিয়েও বারবার ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে আকাশি-নীলদের। এবারও বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট দল আর্জেন্টিনা। কারণ তাদের আছে ভিন গ্রহের
একজন ফুটবলার। যাকে বলা হয়, ফুটবলের ‘খুদে জাদুকর।’ ম্যারাডোনার যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। গত ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে মেসির অনবদ্য নৈপুণ্যের ওপর ভর করে ২৪ বছর পর ফাইনালে উঠেছিল আলবিসেলেস্তেরা। কিন্তু মারাকানার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে ১-০ গোলে হেরে শিরোপাবঞ্চিত থাকতে হয়েছে তাদের। তবে আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি উঠেছিল মেসির হাতে। কিন্তু তা দিয়ে তো আর বিশ্বকাপের ক্ষুধা মেটানো সম্ভব নয়।
আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক পুরনো। বিশ্বকাপের প্রথম আসর থেকেই দলটি নিজেদের নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। ১৯৩০ বিশ্বকাপে এসেই ফাইনাল খেলেছিল ল্যাটিন শক্তিরা। মন্টেভিডিওতে স্বাগতিক উরুগুয়ের বিপক্ষে ৪-২ গোলে না হারলে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হতে পারত তারা।
কিন্তু এরপরই বিশ্বমঞ্চে নিজেদের ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারেনি আর্জেন্টাইনরা। ১৯৩৪ বিশ্বকাপের পর টানা তিন আসরে দর্শক হয়ে থাকতে হয় তাদের। এরপর ফিরে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ বিশ্বকাপ খেললেও বলার মতো তেমন কোনো গল্প লিখতে পারেনি দেশটি। উল্টো ১৯৭০ বিশ্বকাপে আরেকবার দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হয় আকাশি-নীল জার্সিদের।
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ধারাবাহিক হয়ে উঠতে থাকে ১৯৭৪ পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে। প্রথম বিশ্বকাপের রানারআপ দলটির শিরোপা জিততে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪৮ বছর। ঘরের বিশ্বকাপে বুয়েনস আয়ারসে নেদারল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা।
আসন্ন টুর্নামেন্ট মিলিয়ে মোট ১৭ বার বিশ্বকাপ খেলবে আর্জেন্টিনা। তার মধ্যে দেশটি ফাইনাল খেলেছে পাঁচবার। শিরোপা জিতেছে দুইটি আসরে। এবার ৩২ বছরের অপেক্ষা ঘোচাতে রাশিয়াতে লড়াইয়ে নামবে দলটি।
বিশ্বকাপে শিরোপা জেতার পরিসংখ্যানে ব্রাজিল, জার্মানি ও ইতালির পরে তাদের অবস্থান। তবে বিশ্ব ফুটবলের পরাশক্তি আর্জেন্টিনাকে শিরোপা দিয়ে বিবেচনা করাটা অর্থহীন। কারণ দলটি যুগে যুুগে জন্ম দিয়েছে একেকজন বিশ্বসেরা ফুটবলার। সেই তালিকায় আছেন সিজার লুইস মেনোত্তি, কার্লোস বিলার্দো, ম্যারাডোনা, ক্যানিজিয়া, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে, হার্নান ক্রেসপো, মেসি, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়াদের মতো তারকা ফুটবলাররা।
তবে এবার রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট পেতে ঘাম ঝরাতে হয়েছে আর্জেন্টাইনদের। কনমেবল অঞ্চলের বাছাইপর্বে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়াটা ঝুঁকির মুখে পড়ে গিয়েছিল দলটির। রাশিয়া যেতে হলে আর্জেন্টাইনদের দরকার ছিল প্লে-অফ ম্যাচে জয়। সেবার মেসির হ্যাটট্রিকে ইকুয়েডরকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ২১তম বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে দেশটি।
রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খেলবে কোচ জর্জ সাম্পাওলির অধীনে। কিন্তু রাশিয়া যাওয়ার আগে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে তেমন একটা নজর কাড়তে পারেনি দেশটি। শেষ তিন প্রীতি তারা জয় পেয়েছে দুইটিতে। এর মধ্যে স্পেনের বিপক্ষে ৬-১ গোলের লজ্জাজনকও হারও আছে। আর ইসরায়েলের বিপক্ষে শেষ প্রীতি ম্যাচটি বাতিল করতে হয়েছে। যার কারণে অনেকটা আগোছাল দল নিয়ে রাশিয়া ভ্রমণ করতে হয়েছে সাম্পাওলিকে।
রাশিয়া বিশ্বকাপে সবচেয়ে বয়স্ক দল হচ্ছে আর্জেন্টিনা। দলটি গঠিত হয়েছে নতুন ও গত আসরে ফাইনাল খেলা অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নিয়ে। দলটির প্রাণভোমরা মেসি আছেন দারুণ ছন্দে। গত মৌসুমে বার্সেলোনার জার্সিতে হয়েছেন ইউরোপের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এছাড়া দলটিতে আছেন ডি মারিয়া, সার্জিও আগুয়েরো, গঞ্জালো হিগুয়েন, মাচেরানো, লো সেলসোদের মতো তারকা খেলোয়াড়। যারা যেকোনো সময়ে ঘুরিয়ে দিতে পারেন ম্যাচের মুহূর্ত। দলটির আর্মব্যান্ড থাকবে বার্সা ফরওয়ার্ড মেসির হাতে।
সদ্য প্রকাশিত ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে আর্জেন্টিনা আগের পাঁচ নাম্বার অবস্থানটি ধরে রেখেছে। সাম্পাওলির শিষ্যরা ‘ডি’ গ্রুপে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছে ক্রোয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও আইসল্যান্ডকে। গ্রুপটিকে বলা হচ্ছে ‘ডেথ গ্রুপ’ও। আগামী ১৬ জুন স্পার্তাক স্টেডিয়ামে নবাগত আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ৩২ বছরের শিরোপা খরা ঘুচাতে মাঠে নামবে আর্জেন্টিনা।
"