শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ০৯ এপ্রিল, ২০১৮

চট্টগ্রামে পাহাড়ধস রোধে গুচ্ছ পরিকল্পনা

পাদদেশে হবে গাইড ওয়াল ড্রেন ও সীমানা প্রাচীর

পাহাড়ধসে জানমাল রক্ষায় একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমেছে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রশাসন। এর অংশ হিসেবে অননুমোদিত পাহাড়কাটা বন্ধ ও ন্যাড়া পাহাড়ে গভীর শিকড়যুক্ত গাছ লাগানো হবে। যেসব পাহাড়ের পাদদেশের ঢালু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী গাইড ওয়াল, পানি নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর তৈরি করবে সরকার। পাহাড়ধসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলা প্রশাসককে পাঠানো বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের চিঠিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে। পাহাড়ধস রোধে করণীয় বিষয়ে ওই নির্দেশনায় আরো বলা হয়, আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই পাহাড়ের পাদদেশ ও ঢালে বসবাসকারীদের অন্যত্র আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাহাড়ে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে অন্যত্র আবাসনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি পাহাড়ে নতুন করে বসতি ও ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার নির্দেশনাও এতে দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসককে গত ২০ মার্চ পাঠানো এ বার্তায় পাহাড়ধস রোধে মোট আটটি নির্দেশনা দেয়া হয়। বাকি নির্দেশনাগুলো হচ্ছে পাহাড়কাটা ও ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে পাহাড়কাটা বন্ধ করা, পাহাড়কাটার কুফল সম্পর্কে পাহাড়ি এলাকার জনগণকে সচেতন করা, পাহাড়কাটা বিষয়ক মামলা রুজু, তদন্ত ও বিচার সুষ্ঠু এবং দ্রুততর করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে অবগত করা।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান জানান, ‘প্রতি বছর পাহাড়ধসে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। গত বছরের ১২ থেকে ১৪ জুন ১৭২ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। তাই এ বছর আমরা আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছি। বর্ষা শুরুর আগেই পাহাড়ধস রোধে কোন জেলা কোন কোন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে তা জানাতে বলা হয়েছে।’

পাহাড় ও বনভূমি ধ্বংসের ফলে ব্যাপক পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৪ জুন পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ৩৭ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণের ঘটনা ঘটে। সে সময় পাহাড়ধসে, দেয়াল ভেঙে, পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। যাদের অধিকাংশই ছিল শিশু ও নারী।

এদিকে ‘চট্টগ্রাম জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস, পাহাড় কর্তন ও করণীয় সম্পর্কে রূপরেখা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে জমা দেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী। প্রতিবেদনে পাহাড় রক্ষায় ১০টি সুপারিশও করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম জেলায় প্রায় ৫০০ পাহাড় আছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের এলাকায় সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ঝুঁকিপূর্ণ ২৮টি পাহাড় আছে। এসব পাহাড়ে ৬৮৪ পরিবার বসবাস করছে।

ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের মধ্যে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন আছে সিআরবির পাদদেশ, টাইগার পাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ পশ্চিম কোণের পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড় ও আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়। সড়ক ও জনপথ, রেলওয়ে, গণপূর্ত ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মালিকাধীন পরিবেশ অধিদফতর সংলগ্ন পাহাড় ও লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়। বন বিভাগের বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়। ইস্পাহানি গ্রুপের ইস্পাহানি পাহাড়। জেলা প্রশাসনের ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড় মোড় সংলগ্ন পাহাড়, একে খান কোম্পানির একে খান কোম্পানি পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কৈবল্যধামের বিশ্ব কলোনির পাহাড়, ভিপি লিজভুক্ত লালখান বাজার, চান্দমারি রোড সংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম ইসলামী মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়, সরকারি (এপি সম্পত্তি) নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়।

ব্যাক্তিমালিকানাধীন পাহাড় সশূহের মধ্যে আছে মোজফফর নগর পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোল পাহাড়, জয় পাহাড়, চট্টেশ্বরী হিল, ফয়েজ লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, গরীবুল্লাহ শাহ মাজার সংলগ্ন বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তর পাশে মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড় ও ইস্পাহানি পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের হারুন খানের পাহাড়ের পশ্চিমাংশ।

বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের কাছে জমা দেয়া জেলা প্রশাসকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পাহাড় ধ্বংসে প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। বিরাজমান সুষ্ঠু আইনশৃক্সক্ষলা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো মূল্যে পাহাড়কাটা বন্ধ করতে হবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব পরিবারে আছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধা।

এতে আরো বলা হয়েছে, পাহাড়ধসে ভৌগলিক কারণ কিছুটা দায়ী হলেও এর চেয়ে বড় দায়ী নির্বিচারে পাহাড় কর্তন, পাহাড় ব্যবস্থাপনায় নীতিমালা না থাকা, পাহাড় নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অনুপস্থিতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তায়ন। তবে এসব ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সবাইক সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী।

প্রতিবেদনে অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীরা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, অবৈধ উপায়ে পাহাড়ে বসবাসকারীরা অবৈধ উপায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়সহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ তথা মাদকসেবন ও বিক্রয়ের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। এ কারণে একটি সামাজিক সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া পাহাড়ে বসবাসকারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এক শ্রেণির প্রভাবশালী দালাল চক্র দেশের আইনশৃক্সক্ষলাকে অমান্য করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসব পাহাড়কে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে ভাড়া দেয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল বলেন, ভূতাত্ত্বিক কারণেই মূলত পার্বত্য জেলায় গত বছর পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছিল। বৃক্ষ নিধনের ফলে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া পাহাড়ের ভেতরে অতিবৃষ্টিজনিত পানি ঢুকে পড়ায় বড় ধরনের ধস হয়েছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ, বসতি স্থাপন, বন ধ্বংস বন্ধ না হলে সামনে আরো বড় বিপদ-বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist