প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৪ মার্চ, ২০১৮

মেহেদির রং শুকোয়নি আঙুলে বিয়ের আংটি...

নেপালে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। কারো ভাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতে পারছেন না বাবা। মা মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার। প্রিয় প্রতিবেশী বন্ধুকে হারিয়ে গ্রামের মানুষও শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছেন। বিয়ের আংটি যে আঙুলে সেটি এখন নিথর, অনুভূতিহীন। এমনই একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নিহতের নাম জেসি ফারিয়া ওরফে আঁখি মনি। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের মেয়ে। এদিকে এক মাকে তার ছেলের মৃত্যুর খবর না জানানোর জন্য বাড়ির ডিস সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ১১ শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে।

বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, হাতের মেহেদিও শুকোয়নি এখনো। বিয়ের আংটি যে আঙুলে সেটি এখন

নিথর, অনুভূতিহীন। এমনই একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নিথর যে আঙুল ধরে রাখা হয়েছে সেই আঙুলে মেহেদির ছোপ ছোপ রং, আঙটি। ছবিটি নেপালে বিধ্বস্ত বিমানের এক তরুণী যাত্রীর-যিনি মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তরুণীর নাম জেসি ফারিয়া ওরফে আঁখি মনি। মিনহাজ বিন নাসির নামের এক তরুণের সঙ্গে মাত্র ১৩ দিন আগে বিয়ে হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রুপসদী গ্রামের রফিকুল ইসলাম পেশকার মিয়ার মেয়ে আঁখি মনি ও তার স্বামী মিনহাজ বিন নাসির।

আঁখি মনির পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিহত নবদম্পতি আঁখি মনি ও মিনহাজ বিন নাসিরের বাসা রাজধানীর মহাখালীতে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হলুদ আর ৩ মার্চ রিসিপশন হয় আঁখি মনি ও মিনহাজ বিন নাসিরের। জাঁক-জমকপূর্ণ ওই অনুষ্ঠানের পর পরিবারের উদ্যোগে তাদের নেপালে হানিমুনে পাঠানো হয়।

সবার কাছে বিদায় নিয়ে গত সোমবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে হানিমুনের উদ্দেশে রওনা দেন। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বিমানে উঠেন। সময়মতো কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও পৌঁছান কিন্তু মাটি স্পর্শ করেননি তারা; করেছে নিথর দেহ।

রাজশাহী প্রতিনিধি জানান, নেপালে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রকিবুল হাসান। আর তার স্ত্রী এমরানা কবির এখন আইসিইউতে মৃত্যুর মুখোমুখি। এ অবস্থার মধ্যে এখনো রকিবুলের মৃত্যুর খবর তার মাকে জানানো হয়নি। মা যেন আপাতত কোনোভাবেই জানতে না পারে, তার জন্য রকিবুল ইসলামের ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসার ডিশ লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বিধ্বস্ত ওই বিমানের যাত্রী ছিলেন রকিবুল-এমরানা দম্পতি। তারা ছুটি কাটাতে নেপালে যাচ্ছিলেন। বিমান দুর্ঘটনায় তারা দুজনই গুরুতর আহত হন। তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়।

সেখানে না ফেরার দেশে চলে গেছেন রকিবুল হাসান। তার স্ত্রী রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) প্রভাষক এমরানা কবির হাসি এখনো আইসিইউতে। একমাত্র ছেলে রকিবুল হাসানকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন মা সেলিনা আখতার ঝর্ণা। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রকিবুল সারাক্ষণ মাকে আগলে রাখতেন। চাকরির কারণে রকিবুল মাকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। আর স্ত্রী এমরানা কবির হাসি থাকতেন রাজশাহীতে। রকিবুলের মৃত্যু সংবাদ মাকে কিভাবে জানাবেন স্বজনরা। একমাত্র ছেলে হারানোর সংবাদে কী হবে মায়ের অবস্থাÑএই দুশ্চিন্তা থেকে গতকাল মঙ্গলবারও তার মাকে জানানো হয়নি ছেলের মৃত্যু সংবাদ। বাসার ডিশ সংযোগ গত সোমবার থেকেই বন্ধ করে রাখা হয়েছে; যাতে রকিবুলের মা টিভি দেখে খবরটি জেনে না যায়।

রকিবুলের মামাতো ভাই সানি বলেন, ফুপু স্বাভাবিকভাবে ঘরের কাজকর্ম করছেন। কিছু জানেন না। ছেলের মৃত্যুর খবর যাতে জানতে না পারে সে জন্য বাসার ডিশ লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। অন্য স্বজনরা একসঙ্গে হলে হয়তো উনাকে জানানো হবে।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, নেপালে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত হয়েছেন নগরকান্দার এস এম মাহমুদুর রহমান রিমন (৩২)। নগরকান্দার লস্করদিয়া গ্রামের শাহ মো. মশিউর রহমান নিরু মিয়ার বড় ছেলে রিমন। গতকাল মঙ্গলবার নিহত রিমনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার মা লিলি বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। একমাত্র ভাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কথাই বলতে পারছেন না বাবা মশিউর রহমান। শুধু কাঁদছেন তারা। রিমনের মতো এমন ছেলেকে হারিয়ে গ্রামের মানুষও শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছেন।

রিমনের চাচা শাহ মো. আফতাব উদ্দিন জানান, রিমন লেখাপড়া শেষ করে প্রায় সাত বছর আগে ঢাকায় রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড কোম্পানিতে চাকরি নেয়। সে প্রধান কার্যালয়ে সিনিয়র ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিল। প্রতিষ্ঠানের কাজে রিমন নেপাল যাচ্ছিল। দুই মাস আগে রিমন বাড়ি এসেছিল। এরপর আর আসা হয়নি কাজের কারণে। সে ছিল পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি, যার আয়-উপার্জনে চলত সংসার। এখন এই পরিবার আয়-উপার্জনের কেউ থাকল না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বদরুদ্দোজা শুভ বলেন, এ ব্যাপারে আমরা যোগাযোগ করে যাচ্ছি। সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে।

সিলেট প্রতিনিধি জানান, বিমান দুর্ঘটনায় ১১ শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় তিন দিনের শোক পালন করছে সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে। এ ছাড়াও কলেজের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সব ক্লাস এবং পরীক্ষাও স্থগিত ছিল। জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. আবেদ হোসেন জানান, ১৩ নেপালি শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাকবলিত বিমানে ছিলেন। তবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটছে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষে ছুটি কাটাতে নিজ দেশে যাচ্ছিলেন তারা। ওই শিক্ষার্থীরা হচ্ছেনÑ ১৯তম ব্যাচের সঞ্জয় পৌডেল, সঞ্জয়া মহারজন, নেগা মহারজন, অঞ্জলি শ্রেষ্ঠ, পূর্ণিমা লোহানি, শ্রেতা থাপা, মিলি মহারজন, শর্মা শ্রেষ্ঠ, আলজিরা বারাল, চুরু বারাল, শামিরা বেনজারখার, আশ্রা শখিয়া ও প্রিঞ্চি ধনি। কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, পরীক্ষা শেষে ফলাফল প্রকাশের জন্য দুই মাসের মতো সময় লাগে। এ সময় কোনো অ্যাসাইনমেন্ট থাকে না। তাই সবাই নিজ নিজ বাড়ি চলে যায়।

গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বিমান দুর্ঘটনায় নিহত দুই যাত্রীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের বেগুনবাড়ী গ্রামে। তারা হলেন, ওই গ্রামের মৃত আবদুর রহিম মাস্টারের ছেলে নজরুল ইসলাম (৬৫) ও তার স্ত্রী আকতারা বেগম (৬০)। নজরুল অবসরপ্রাপ্ত রাজশাহী শিল্প ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী রাজশাহী মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন। তাদের দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে। বর্তমানে তারা রাজশাহী মহানগরীর উপশহরে বসবাস করছিলেন। চিকিৎসার উদ্দেশে নেপাল যাচ্ছিলেন। তাদের লাশ শনাক্তের জন্যে নজরুলের শ্যালক ডা. ময়েন নেপাল গেছেন বলে স্বজনরা জানিয়েছেন। নজরুলের ভাগ্নে বোরহান উদ্দীন জানান, লাশ দেশে আসলে গ্রামের বাড়ীতে দাফনের সম্ভাবনা রয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নেপালের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ীর উপজেলার বেশনাল এলাকার ইয়াকুব হোসেন রিপন (৩৭) নিহত হয়েছে। রিপন বেশনাল এলাকার ইউনূস বেপারীর পুত্র। তার পরিবার সূত্রে এ মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করা হয়েছে। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নিহত রিপন এক বন্ধুর সঙ্গে নেপাল যাচ্ছিলেন। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে নেপালের একটি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে রিপন সবার বড় ছিলেন। পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। এদিকে রিপন নিহত হওয়ার ঘটনায় এলাকাবাসী ও স্বজনদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। বন্ধু মহল ও স্থানীদের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিহত রিপনের ছবি, পাসপোর্ট ও মৃত্যর সংবাদ ছড়িয়ে পরে।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, আগামী ১৭ মার্চ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তাহিয়া শশী ও তার স্বামী ডা. রেজাউনুল হক শাওনের ষষ্ঠ বিবাহবাষির্কী। একটু আলাদা ভাবে বিবাহবার্ষিকী উদ্যাপন করতে নেপাল যাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় সব তছনছ হয়ে যায়। প্রাণ হারান তাহিয়া শশী। আর গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তার স্বামী ডা. রেজাউনুল হক শাওন। আহত শাওন সাটুরিয়ায় গোপালপুর গ্রামের মোজাম্মেল হকের ছেলে। শাওনের মামা অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, তাহিয়া শশীর সঙ্গে তার চাচাতো ভাই সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর এলাকার মোজাম্মেল হকের ছেলে ডা. রেজাউনুল হক শাওনের বিয়ে হয়। বিয়ের ষষ্ঠ বার্ষিকী উদ্যাপন করতে কাঠমান্ডুতে যাচ্ছিলেন ওই দম্পত্তি। কিন্তু দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তাহিয়া শশী। জানা যায়, টেলিভিশনে বিমান দুর্ঘটনার খবর দেখে শশীর বাবা-মা বিকেল ৪টার দিকে তারা ঢাকায় চলে যান। এ ঘটনায় এলাকায় নেমে এসছে শোকের ছায়া।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist