কক্সবাজার প্রতিনিধি
খাদ্য সংকটে লোকালয়ে হাতি
আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে রোহিঙ্গাদের
খাদ্য সংকটের কারণে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের শরণার্থী শিবিরে ঢুকে পড়ছে বন্যহাতির পাল। আর এতে হামলার ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারছে না রোহিঙ্গারা। গেল পাঁচ মাসে তারা কয়েকবার হাতির আক্রমণের শিকার হয়েছে।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির স্থাপন ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য ব্যাপকভাবে বনের গাছ কাটায় হাতিদের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। খাবারের খোঁজে হাতির দল বন থেকে বেরিয়ে আসছে লোকালয়ে। এ অঞ্চলের এশীয় হাতিকে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা ঢলে তাদের আবাসস্থল দখল হতে শুরু করলে পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে বিরূপ হয়ে যায়।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন (আইইউসিএন) হাতি রক্ষায় কাজ করে। তারা জানায়, রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে হাতিরা বিপদে পড়েছে। তারা শিবির পার হয়ে খাদ্য সংগ্রহের জন্য যেতে পারছে না। হাতির আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত জানুয়ারিতে আইইউসিএন ৭০ বর্গকিলোমিটার পাহাড়ি এলাকায় মাঠ গবেষণা চালিয়েছে। সংস্থাটি তখন ওই অঞ্চলে ৪৫টি হাতি সক্রিয় দেখতে পেয়েছে।
আইইউসিএনের কান্ট্রি ম্যানেজার রাকিবুল আমিন বলেন, হাতির হামলার ঘটনায় তাৎক্ষণিক সহায়তা করতে আমরা ১৭টি কমিটি গঠন করেছি। আগামী সপ্তাহে আমরা কমিটির সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫টিতে নিয়ে যাব। গত ১০ দিনে হাতির দুটি হামলা কোনো হতাহতের ঘটনা ছাড়াই প্রতিরোধ করতে পেরেছি। শরণার্থী শিবিরের পাশে হাতি দেখা গেলে কমিটির সদস্যরা আমাদের ফোন করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই।
কক্সবাজারের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলী কবির বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে হাতির মূল বিচরণস্থলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির বসানো হয়েছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা এই পথ দিয়ে দলবেঁধে চলাচল করে। প্রাণীরা যখন দেখে তাদের চলাচলের পথ রুদ্ধ, তখন তারা বিরূপ হয়ে যায়। তারা বাধা দূর করতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
একটি হাতির দৈনিক ২০০ কেজির মতো খাবার লাগে। রোহিঙ্গা ঢলে বন ধ্বংস হওয়ার পর তাদের খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। হাতিরা খাবারের জন্য বন থেকে বেরিয়ে আসায় মানুষের সঙ্গে সংঘাত হচ্ছে। গত ছয় মাসে হাতির হামলায় ১০ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত ও অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। স্থানীয়দের ফসলি জমি ও বাড়িঘরও হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানা যায়, হাতির আক্রমণে বিপন্ন হওয়ার সবচেয়ে বেশি শঙ্কা রয়েছে রোহিঙ্গা শিশুদের। ত্রাণের জন্য নিয়মিতই অধীর অপেক্ষায় থাকা এই শিশুরা এমনিতেই যুদ্ধ করে চলেছে রোগবালাইয়ের সঙ্গে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে হাতির আক্রমণের ভয়। টেকনাফের পশ্চিম দিকের অভয়ারণ্যে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গহিন অরণ্যে চলে গেছে হাতির পাল। এ বিষয়ে স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘মানুষের ভয়ের কারণে হাতি একটু রাস্তার পাশে কম আসে। নিচে তো এখন আসে না। নিচে আসবে যে শীতকালে, কয়েকদিন পরে।’ আর এমন পূর্বাভাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার খবরও পৌঁছে গেছে রোহিঙ্গাদের অনেক ক্যাম্পে, যে কারণে তারা উদ্বিগ্ন।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় মধ্যবয়সী এক রোহিঙ্গা পুরুষ বলেন, ‘বেশি ডরের (ভয়) মাঝে আছি। আঁরা কোন জায় ন ফারি (কোথাও যেতে পারছি না)। হাতি আইলে আঁরার তো ডর লাগের (হাতি আসলে আমাদের ভয় লাগে)।’
সর্বশেষ হাতিশুমারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট ২৬৭টি বন্যহাতির মধ্যে কক্সবাজার জেলাতেই রয়েছে ১১৭টি, যার ৭৮টিরই বসবাস জেলার উখিয়া এবং টেকনাফের অভয়ারণ্যে।
কক্সবাজার বন সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘হাতির যে আবাসস্থল ছিল, এই আবাসস্থলে এখন রোহিঙ্গাদের ঘর তৈরি হয়েছে। তাহলে হাতিগুলা যাবে কোথায়? হাতিকে আবার অন্য দেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তাদের নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ নাই। তারা বাধ্য হয়ে মানুষকে আক্রমণ করবে না হয় তাদের না খেয়ে, আবাসস্থল না পেয়ে মারা পড়তে হবে।
"