প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
প্রথম কলাম
সীতার দেশে সতীত্ব পরীক্ষা
‘রামায়ণ’ কাহিনিতে আছে ‘সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।’ অনেক সীতাকে এখনো দিতে হয় অনেকটা সেইরকমই ‘অগ্নি পরীক্ষা’। সীতাদের নাম হয়তো বদলে গিয়ে কোথাও হয়েছে অনীতা বা নমিতা সূত্রধর, এই যা। ঘটনাও ‘রামরাজ্য’ অযোধ্যার পরিবর্তে হয়েছে মহারাষ্ট্রের কঞ্জরভাট নামে আদিবাসীদের সমাজে। ওই সমাজের সদ্য বিবাহিত নারীদের পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে বিয়ের দিন পর্যন্ত তারা কুমারী ছিলেন। বাসর রাতে নবদম্পতির বিছানায় পাতা সাদা চাদরে রক্তের দাগ লাগলেই পাওয়া যায় প্রমাণ। তবেই সমাজ মেনে নেয় যে, বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর নিজের কুমারীত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হলে নববধূর কপালে জোট তো জুতোপেটা, অথবা বের করে দেওয়া হত শ্বশুরবাড়ি থেকে।
মারাঠী যুবক বিবেক তামাইচিকার বিবিসিকে বলেন, ‘আমি তখন বেশ ছোট। বছর ১২ বোধহয় বয়স। একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম যে নববধূকে অনেক লোকে মিলে জুতাপেটা করছে। বুঝতেই পারিনি কেন মারছে সবাই মিলে ওই নতুন বউকে। কিছুটা বড় হয়ে গোটা বিষয়টা পরিষ্কার হয় আমার কাছে। সদ্য বিবাহিতা ওই নারী আসলে কুমারীত্বের পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি।’
এই প্রথা বন্ধের উদ্দেশে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন বিবেক। ‘স্টপ দ্য ভি রিচুয়াল’ নামে একটা হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপও হয়েছে, যেটির ৬০ জন সদস্যের অর্ধেকই নারী। ‘ভি রিচুয়াল’ অর্থ ভার্জিনিটি রিচুয়াল, বা কুমারীত্ব পরীক্ষা।
পুনে শহরে একটা বিয়ে বাড়িতে বিবেক আর তার কয়েকজন বন্ধু এই কৌমার্য পরীক্ষা বন্ধের স্বপক্ষে প্রচার চালাতে গিয়েছিলেন। সেখানেই কঞ্জরভাট সম্প্রদায়ের মানুষজন মারধর করেন। পুলিশ সেখান থেকে ৪০ জনকে গ্রেফতারও করেছে। ছোট আকারে প্রকাশিত সেই সংবাদটা দেখেই খোঁজখবর করতে গিয়ে জানা গেল যে, কৌমার্য পরীক্ষার মতো একটা মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথা এখনো চলছে।
কীভাবে নেওয়া হয় কৌমার্যের পরীক্ষা? বিয়ের ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ শেষ হওয়ার পরে নববিবাহিত দম্পতিকে একটা হোটেলের ঘরে পাঠানো হয়, সঙ্গে দেওয়া হয় একটা সাদা চাদর। যদি হোটেলের ভাড়া দিতে নববিবাহিত দম্পতির পরিবার অক্ষম হয়, তাহলে পঞ্চায়েতই এগিয়ে এসে সেই ভাড়া মিটিয়ে দেয়। ঘরের বাইরে অপেক্ষায় থাকেন দুই পরিবারের আত্মীয় স্বজনরা।
বিবেক তামাইচিকার বলেন, ‘অনেক সময় ঘরের ভেতরে পাঠানোর আগে বরকে শিক্ষিত করে তোলার নাম করে মদ খাওয়ানো হয় আর পর্নোগ্রাফি দেখানো হয়।’
শারীরিক মিলনের শেষে যখন নবদম্পতি বাইরে আসেন, তখন দেখা হয় যে ওই সাদা চাদরে নববধূর রক্তের দাগ লেগেছে কি না। দাগ থাকলে নববধূ যে বিয়ের সময় পর্যন্ত কুমারীই ছিলেন, সেটাই মনে করা হয়। তবেই পঞ্চায়েত ওই বিবাহকে স্বীকৃতি দেয়। আর যদি সদ্য বিবাহিতা নারী সেই পরীক্ষায় ফেল করেন, তাহলে তার পরিণাম ভোগার জন্য তাকে তৈরি থাকতে হয়।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সোনিয়া নায়েক বিবিসিকে বলছিলেন, ‘প্রথমবার শারীরিক সম্পর্কের সময়ে যে নারীর দেহ থেকে রক্ত বেরোবেই, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অনেক সময়ে প্রথমবার শারীরিক মিলন হলেও কুমারী মেয়েদের শরীর থেকে রক্ত নাও বেরোতে পারে। এর অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু রক্ত না বেরোনো মানেই যেকোনো নারী কুমারী নন, এটা বলা অবৈজ্ঞানিক।’ কুমারী না হওয়ার অপরাধে’ নববধূকে বেইজ্জত তো করাই হয়, এমনকি পেটানোও হতে পারে। আর স্বামীটি পেয়ে যায় সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করার অধিকার।
কৌমার্যের পরীক্ষায় ফেল করে গিয়েছিলেন অনীতা (পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে নাম পরিবর্তন করা হলো)। এই নারী বিবিসিকে বলেন, ‘বিয়ের আগেই হবু স্বামীর সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। তাই আমার স্বামীর একটা ভয় ছিল যে আমি হয়তো ভার্জিনটির পরীক্ষায় পাস করতে পারব না। ভেবেছিলাম আমার স্বামী পাশে দাঁড়াবে, কিন্তু সেই রাতে যা ঘটল, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না একদমই।’
‘পরীক্ষা’ দিয়ে বেরোনোর পরে সকলের সামনে পঞ্চায়েত বসিয়ে তার স্বামীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যে অনীতা ‘পবিত্র’ না ‘অপবিত্র’। ‘আমার স্বামী, নির্দ্বিধায় আঙুল তুলে রক্তের দাগহীন সাদা চাদরটা দেখিয়ে দিল। অথচ তার কথাতেই রাজি হয়ে আমি বিয়ের মাস ছয়েক আগে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছিলাম। আর ওই কঠিন সময়ে সে আমাকেই অপবিত্র বলে দিতে একবারও দ্বিধা করল না! পঞ্চায়েত আমাকেই ‘ফেক’ বলে দিল’ বলেন, অনীতা। পুলিশ আর স্থানীয় সামাজিক আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকর্মীর মধ্যস্থতায় অনীতার সঙ্গে থাকতে রাজি হয়েছিলেন তার স্বামী। তবে স্বামীর ঘর করাটা দিনকে দিন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল অনীতার কাছে। প্রতিদিনই মারধর করত স্বামী। আবার পঞ্চায়েতও বেইজ্জত করত তাকে। কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হত না। আর তাকে যেহেতু পঞ্চায়েত ‘অপবিত্র’ বলে রায় দিয়েছে, তাই অনীতার দুই বোনের বিয়ে দিতেও সমস্যা হচ্ছে।
"