প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১২ জানুয়ারি, ২০১৮

১/১১’র পর্দার আড়ালের ঘটনা

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বা ১/১১ তে কী ঘটেছিল, তা উঠে এসেছে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদের লেখা বইয়ে। ‘শান্তির স্বপ্নে; সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামের এই বইয়ে তিনি বর্ণনা করেছেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে জরুরি অবস্থা জারির বিষয়টি। সেই দিন জেনারেল মঈন উ আহমেদ এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীসহ একদল সেনা কর্মকর্তা দুপুরের দিকে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। সূত্র বিবিসি।

মঈন উ আহমেদ বর্ণনা করেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি, নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের আল্টিমেটাম এবং বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের অবস্থান, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানালাম। জাতিসংঘ মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে তা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সচেষ্ট হলো।’ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচন হলে দেশে যে ধরনের সহিংস পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে সে বিষয়টি গোয়েন্দা দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে বুঝিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় সামরিক কর্মকর্তারা জরুরি অবস্থান জারির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেন।

দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হতে পারেÑ এমন ধারণা পেলেও বিষয়টি নিয়ে ১১ জানুয়ারি সারা দিনই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। সেই দিন দুপুরে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে

বৈঠক হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের। বৈঠকটি হয়েছিল ঢাকাস্থ কানাডীয় হাই কমিশনারের বাসায়।

সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের পাশাপাশি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এবং ভারতের হাই কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম।

বৈঠকের বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন কথার এক পর্যায়ে তারা বলল এভাবে হলে তো দেশ চলতে পারে না। এভাবে হলে তো বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা বাড়বে। আপনারা দুই দল যদি সমঝোতায় না আসেন তাহলে অন্যরকম ঘটনা ঘটতে পারে। ওনাদের কথায় মনে হলো কী যেন একটা হচ্ছে। কারণ ওনারা পজিটিভ কিছু বললেন না।’

একদিকে, রাস্তায় আওয়ামী লীগের আন্দোলন এবং অন্যদিকে বঙ্গভবনে সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা চলছে। একই সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকরা।

পর্দার অন্তরালে কী ঘটতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে অনেকটা অন্ধকারে ছিল সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া দল বিএনপি। দলটি তখন ২২ জানুয়ারির নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ১০ জানুয়ারি গভীর রাত পর্যন্ত কুমিল্লায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন। তখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

মোশাররফ হোসেন বলছিলেন, ‘কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে রাত নয় থেকে ১১টা পর্যন্ত জনসভা করেছেন। আমরা রাত একটার সময় ঢাকায় ফিরে আসি। ১১ তারিখ বিকেলের দিকে জানতে পারলাম যে সেনাবাহিনী থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়েছেন এবং সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। জাতিসংঘের কিছু একটা চিঠি নিয়ে সেনাপ্রধান এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে জরুরি আইন ঘোষণা করাচ্ছেন।

সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন সেটি নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র বিরোধের কারণে সহিংস পরিবেশ ছিল অনেকটা সময় ধরে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই সে সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট রাস্তায় আন্দোলন করছিল। একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

মঈন লেখেন, ‘একসময় ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করে জানাল, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নির্বাচনে সেনাবাহিনী সহায়তা করলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহারের জন্য তারা জাতিসংঘকে অনুরোধ করবে। প্রচ্ছন্ন এ হুমকির পরিণতি অনুধাবন করতে আমার অসুবিধা হলো না। জাতিসংঘের কর্মকা-ের নিয়ন্ত্রক এসব দেশের অনুরোধ ও মতামত যে জাতিসংঘ অগ্রাহ্য করতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য। আমি এর পরিণাম চিন্তা করে শিউরে উঠলাম। তারপরও আমার একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মকা- থেকে দূরে রাখা যায়।’ সে সময় ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন ড. সোয়েব আহমেদ।

২ জানুয়ারির নির্বাচনে যখন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তখন ‘ভিন্ন কিছু’ আঁচ করছিলেন আহমেদ। সেদিন সব উপদেষ্টাদের বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। ড. সোয়েব আহমেদ বঙ্গভবনে গিয়ে জানতে পারেন যে তিন বাহিনীর প্রধান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করছেন। তখন উপদেষ্টা পরিষদের সবাই জানতে পারলেন যে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন। কিন্তু বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তখনো তাদের জানানো হয়নি।

আহমেদ বলেন, ‘এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি আমাদের সঙ্গে চা চক্রে মিলিত হলেন। সেখানে তিনি জানালেন যে পরিস্থিতির জটিলতার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে হচ্ছে। আমরা সবাই রেজিগনেশন দিয়ে চলে গিয়েছি। সে রাতেই শুরু হয়েছিল আরেকটি সরকার গঠনের প্রক্রিয়া।

প্রথমে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তাতে রাজি হননি। তখন ড. ফখরুদ্দিন আহমদ প্রস্তাব পেয়ে এগিয়ে আসেন।

সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সে প্রক্রিয়া চালিয়েছিলেন। ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন সে সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।

তবে এর আগে জেনারেল মঈন উ আহমেদ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ব্যারিস্টার মইনুল সরাসরি সরকারে যোগ না দিয়ে তিনি নতুন সরকারের পেছনে থেকে সহায়তা করবেন বলে জানিয়ে দিলেন। যুক্তি হিসেবে হোসেন সরকার পরিচালনায় তার অনভিজ্ঞতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তখন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন।

মঈন আরো লেখেন, আমি জানলাম যে, ফখরুদ্দিন সাহেবকে প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। তখন আমি ভাবলাম যে ফখরুদ্দিন সাহেব যদি থাকে তাহলে ঠিক আছে। যাওয়া যেতে পারে। আমি ফখরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথাও বললাম। উনি বললেন যে তুমি যদি আসো তো ভালোই হবে।

এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তখনকার সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠে। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যবসায়ীকেও আটক করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের ওপর ছিল কড়া নজরদারী। একটি সাধারণ নির্বাচনের বিষয়ে সেনা সমর্থিত সরকারের ওপর চাপও বাড়ছিল। অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সব দলের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন হয়। যার মাধ্যমে দুই বছর পর দেশে ফিরে আসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist