শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮

চট্টগ্রাম বিভাগে এক বছরে ৬৫৪ খুন

আতঙ্কে রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতারা

খুনের ঘটনায় মূল আসামিরা ধরা পড়ছে না। হত্যাকা-ে ব্যবহার করা অস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে না

পুলিশের হিসাবে চট্টগ্রাম বিভাগে গত এক বছরে খুন হয়েছেন ৬৫৪ জন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন রাজনৈতিক কোন্দলে। এ কারণে রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। অনেকে কমিয়ে দিয়েছেন প্রকাশ্যে চলাফেরা। রাজনৈতিক খুনের ঘটনায় তদন্তকাজ ঠিকমতো এগোচ্ছে না বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া বেশকিছু খুনের ঘটনায় মূল আসামিরা ধরা পড়ছে না। বেশিরভাগ হত্যাকা-ে ব্যবহার করা অস্ত্রও উদ্ধার করতে পারছে না পুলিশ।

গত ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের নেতারা। সেদিন সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু চট্টগ্রামে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা হত্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু খুনিদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? দিয়াজ ইরফান চৌধুরী, নাসিম আহমেদ সোহেলের হত্যাকারী কেন গ্রেফতার হচ্ছে না? আমরা যারা চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ করি, আমরা এখন মৃত্যুভয়ে ভীত। আমরা জীবনের নিরাপত্তা চাই। আমরা সবাই জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছি।’

গত ৬ অক্টোবর নগরের নালাপাড়ায় চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চলে যাওয়ার সময় হত্যাকারীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। পুলিশ বলেছে, হত্যাকা-ে ৩০ জনের বেশি অংশ নেন। তারা মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা করে নগরের লালখান বাজার এলাকা থেকে নালাপাড়ায় যান। তাদের কয়েকজনের কোমরে গোঁজা ছিল অস্ত্র। এই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া চারজনের মধ্যে দুজন আদালতে জবানবন্দিতে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে সেদিন অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করলেও সেসব উদ্ধার হয়নি। নিহত সুদীপ্তের বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘এতগুলো লোক আমার ছেলেকে হত্যার পর গুলি ছুড়ে পালিয়ে গেল। আর পুলিশ মূল খুনিদের কিছুই করতে পারছে না।’ সদরঘাট থানার ওসি বলেন, সুদীপ্ত হত্যার ঘটনায় জড়িত বাকি আসামিদের ধরার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ঘটনার দিন যারা অস্ত্র ব্যবহার করেছিল তাদের শনাক্ত করেছি আমরা। ঘটনায় ব্যবহার করা অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে কদমতলী এলাকায় যুবদল নেতা ও পরিবহন ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদকে তার ব্যবসায়িক কার্যালয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে কারা, কী কারণে খুন করেছে তা এক মাসেও বের করতে পারেনি পুলিশ। হারুন হত্যার ১৩ দিন পর মাতারবাড়ী এলাকার জসীম উদ্দিন নামের সন্দেহভাজন এক আসামিকে গত ১৭ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আদালতে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। কিন্তু আসামি উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিনে থাকায় রিমান্ড আবেদন নাকচ হয়। পরে জামিনে মুক্তি পান আসামি। এরপর সর্বশেষ গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নগরের হালিশহর এলাকা থেকে মো. ফয়সাল খান নামের সন্দেহভাজন এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধান পায়নি পুলিশ। এই মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশ নিহতের পরিবার। খুনের রহস্যের কোনো কিনারা না হওয়ায় আতঙ্কের মধ্যে কদমতলী এলাকার পরিবহন ব্যবসায়ীরা।

মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির বড় ভাই হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী অভিযোগ করেন, ‘আসামিরা সরকারি দলের আশ্রয়ে থাকায় পুলিশ তাদের ধরছে না। আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় তাদের পরিবার আতঙ্কে রয়েছে।’

সদরঘাট থানার ওসি মর্জিনা আক্তার বলেন, সন্দেহভাজন কয়েকজন আসামি আগাম জামিন নেওয়ায় তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে হয়তো অনেক তথ্য বেরিয়ে আসত। এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নগরীর কোতোয়ালি থানার আমতলী এলাকায় নিজ দলের প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন ইয়াছির আরাফাত নামের ছাত্রলীগের এক কর্মী। গত ১৮ এপ্রিল নগরীর লালখান বাজার এলাকায় শরিফ নামের এক যুবলীগ কর্মী ছুরিকাঘাতে খুন হয়। গত বছরের গত ৯ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ইমরানুল করিম ইমন নামের এক ছাত্রলীগ নেতাকে। খুন করার পর তার লাশ ড্রামভর্তি করে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। ১৩ আগস্ট কোতোয়ালি থানাধীন রানির দীঘি থেকে ইমনের লাশ ভর্তি ড্রাম উদ্ধার করে পুলিশ। যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী তার অনুসারীদের নিয়েই ইমনকে খুন করেছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।

গত ২৯ মার্চ রাতে নগরীর চকবাজার থানাধীন চন্দনপুরা এলাকার মিন্নি মহলের বাসা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে খুন করা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুকে। এর পর দিন ৩০ মার্চ হাত-পা, চোখ বাঁধা অবস্থায় নুরুর লাশ রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে উদ্ধার করা হয়। গত ১৮ মে হাটহাজারীতে খুন হয় ফতেপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. লোকমান। তাকে নিজ বাড়ির কাছে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। গত ১৮ মে সন্দ্বীপে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হয় যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ওরফে বচা বাবলু। পরিবারের অভিযোগ, রাজনৈতিক বিরোধের জের ধরে তাকে প্রতিপক্ষের লোকজন হত্যা করেছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘২০১৭ সালে চট্টগ্রাম মহানগরে ৬৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। কিছু মামলার তদন্ত অব্যাহত আছে। জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

এদিকে, বিদায়ী বছরে একের পর রাজনৈতিক হত্যাকা-ের জেরে উত্তপ্ত ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলা। গত বছরের ২২ নভেম্বর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক স্বপ্না আক্তারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গত ৫ জানুয়ারি আনোয়ার হোসেন নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় ইউপি চেয়ারম্যান মনির হত্যার রেশ ধরে গত বছরের ১ এপ্রিল সন্ধ্যায় আবু সাইদ ও মোহাম্মদ আলী নামের দুই যুবলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। দাউদকান্দির পশ্চিম মাইজপাড়া এলাকায় ৬ মে আমির হোসেন রাজন নামের এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৮ জুন ফেনী সদরের ধর্মপুর ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা রেজাউল করিমকে কুপিয়ে হত্যা করে নিজ দলের দুর্বৃত্তরা।

এদিকে, খুন আতঙ্কে ভুগছেন ফেনীর ছাগলনাইয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। গত বছরের ৭ জুলাই ছাগলনাইয়া আওয়ামী লীগের সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ইলিয়াছ হোসেন সোহাগ জিডি করেন। তারা জিডিতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুর আহমদ মজুমদার এবং তার ভাই আবু আহমদ মজুমদারসহ

আটজনকে অভিযুক্ত করেছেন। জিডিতে বলেছেন, অভিযুক্তরা ঢাকা ও ছাগলনাইয়া বাজারে গোপন বৈঠক করে সোহেল চৌধুরীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন। তাই জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে তারা আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। ২৭ নভেম্বর ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র মোহাম্মদ মোস্তফা জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।

অন্যদিকে, গত ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার জুরাছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অরবিন্দু চাকমাকে তার বাড়ির কাছে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি উপজেলা যুবলীগেরও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। একই দিন বিকেলে বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাসেল মারমাকে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলা সদরে তার বাড়ির পাশে এই ঘটনা ঘটে। এর পর দিন ৬ ডিসেম্বর রাতে রাঙামাটি শহরে মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ঝরনা খীসার বাড়িতে হামলা চালায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। সেদিন তাকে কুপিয়ে আহত করা হয়। তিনটি ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের পাহাড়ি নেতাকর্মীরা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এসব ঘটনার জন্যই জেএসএসকে দায়ী করে বিবৃতি দেয় জেলা আওয়ামী লীগ। এছাড়া জেএসএস হত্যার ভয় দেখিয়ে নেতাকর্মীদের জোর করে দল ছাড়তে বাধ্য করছে উল্লেখ করে ৯ ডিসেম্বর রাতে একটি বিবৃতি দেয় রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ। এতে বলা হয়, অস্ত্রের মুখে ও নানাভাবে পাহাড়ি নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য ১২ ডিসেম্বর পাল্টা বিবৃতিতে জনসংহতি সমিতি এই অভিযোগ অস্বীকার করে।

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মূছা মাতব্বর বলেন, ‘রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের সুসংগঠিত রাজনীতি নস্যাৎ করার জন্য অস্ত্রের ভয় দেখাচ্ছে জেএসএস। এই বিষয়টি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে জানানো হয়েছে।’

এ বিষয়ে জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি উষাতন তালুকদার বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ সত্য নয়। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও অসন্তোষ ও ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকে অনেক কিছু ঘটতে পারে। সেজন্য জনসংহতি সমিতি দায়ী হতে পারে না।’

এদিকে, খাগড়াছড়িতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমএন লারমা) দ্বন্দ্ব চরমে। গত বছরের ২০ অক্টোবর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে সুমায়ুন চাকমা নামের জনসংহতি সমিতির এক নেতা নিহত হন। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরে ইউপিডিএফের জেলা সংগঠক মিঠুন চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রেঞ্জের অধীন ১১ জেলায় ২০১৭ সালে ৫৮৮টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অপরাধজনিত ও রাজনৈতিক কারণে এসব খুন হয়েছে। খুনের ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের বেশিরভাগই ইতোমধ্যে আইনের আওতায় এসেছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist