শফিকুল ইসলাম খোকন

  ২৯ জুলাই, ২০১৮

গণমাধ্যম হোক উপকূলবান্ধব

বাংলাদেশ একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে জনশক্তি। স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ও বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন সমৃদ্ধিশালী দেশ। এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে শামিল হওয়ার চেষ্টা রয়েছে। আর সেই উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে শামিল হতে যে কয়টি বিষয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক বা সহযোগিতা থাকে বা থাকতে হয়, তার মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, জনশক্তি, উন্নয়ন, বহির্বিশ্বের দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং গণমাধ্যম। আর গণমাধ্যমকে দেশের চতুর্থ রাষ্ট্র বা আয়না বলা হয়েছে। বহির্বিশ্বে দেশটাকে পরিচিতসহ নানাভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। আর দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছে, তার সিংহভাগ জনশক্তি হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরে বাংলাদেশ। মাঝে এসেছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ ও নেতৃত্বের সংকট। জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। তারপরও পিছিয়ে নেই দেশ। এ সময়ে দারিদ্র্যের হার ৮২ থেকে নেমে এসেছে ২৪ শতাংশে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১২ গুণের বেশি, ৫০০ গুণের বেশি বেড়েছে বাজেট। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। বর্তমানে খাদ্য চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশই উৎপাদিত হচ্ছে দেশে। যার সিংহভাগই উপকূলে। বিশেষ করে সমুদ্রের মৎস্য সেক্টর হচ্ছে উপকূলকেন্দ্রিক। বিদেশনির্ভরতা অনেক কমেছে, কমেছে বাজেট বাস্তবায়নেও। বাজাস্তূল্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৪৭ বছরে ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি থেকে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকায়। দেশে এখন নিবন্ধিত কোম্পানি প্রায় ৪ লাখ। আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত আড়াই কোটি মানুষ। প্রায় এক কোটি প্রবাসীও বড় অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে। এ ছাড়া উপকূলের মৎস্যজীবী এবং চাষিরা খাদ্য ও মৎস্য উৎপাদনে রাখছে সিংহভাগ ভূমিকা। বাংলাদেশের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় যেমন কমেছে দরিদ্রতা, তেমনি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। পাশাপাশি সাবমেরিনের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনও সম্পন্ন হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটার হাউসকুপারস তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পরিণত হবে বিশ্বের ২৩তম অর্থনীতির দেশে। আর ২০৩০ সালে হবে ২৮তম। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে, যার অন্যতম বাংলাদেশ। লন্ডনের পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। আর বাংলাদেশের কল-কারখানার পাশাপাশি উপকূলের মৎস্য সেক্টরসহ উপজেলার জনশক্তি দেশের অর্থনীতিতে অনেক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে কল-কারখানা যেভাবে গণমাধ্যমে গুরুত্ব পাচ্ছে, উপকূলের শ্রমশক্তি, মৎস্য সেক্টর সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না।

পুরনো কথা বারবার বলতে না চাইলেও কখনো কখনো বলতে হয় আর কিছু কিছু পুরনো কথা রয়েছে, যা কখনোই পুরনো হয় না। বরং ওই শব্দগুলো বারবার উচ্চারণ করলে সেটি চর্চা হয়। আর সে পুরনো কথা হচ্ছে-গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রকে বলা হয় ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে পৃথিবীতে সংবাদ মাধ্যমের আবির্ভাব। অর্থাৎ সংবাদ প্রচারই যার মুখ্য উদ্দেশ্য। ইংরেজি শব্দ ঘবংি হলো ঘড়ৎঃয, ঊধংঃ, ডবংঃ, ঝড়ঁঃয-এর আদ্যক্ষর। উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ এ চারদিকের খবর বা সংবাদই হলো ঘবংি। রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের মধ্য দিয়ে গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে শতাব্দীব্যাপী সংবাদপত্র তথা সংবাদমাধ্যমের প্রতিটি শাখা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীতে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রশিল্প অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের চেহারা ও চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

একটি মুক্ত ও সভ্যসমাজে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের পরই চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদমাধ্যম তথা গণমাধ্যমের স্থান নির্ধারিত হলেও এই ‘চতুর্থ স্তম্ভ ব্যতিরেকে বর্তমান যুগে অন্য তিনটি স্তম্ভকে সক্রিয় বা কার্যকর করার প্রয়াস একটি অকল্পনীয় এবং অসম্ভব ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় জীবনে সংবাদমাধ্যমের এই অসীম গুরুত্ব ও অপরিসীম ভূমিকার কারণেই প্রেসিডেন্ট জেফারসন বলেছিলেন, ‘যদি আমাকে বলা হয় কোনটা বেছে নেব সংবাদক্ষেত্র ছাড়া সরকার, না সরকার ছাড়া সংবাদক্ষেত্র? আমি বেছে নেব শেষেরটিকে।’ এ থেকেই বোঝা যায়, গণমাধ্যম কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্ব বহন করে একটি দেশ বা জাতির জন্য। আর এ দেশের অধিকাংশ মানুষের বাস উপকূলে।

বাংলাদেশ একটি বিশাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ মৎস্যসম্পদ সমৃদ্ধ বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ব-দ্বীপ। এটি দেশের ৭০-৮০ ভাগ প্রোটিন চাহিদার জোগান দিয়ে থাকে। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের মোট ১৯টি উপকূলীয় জেলা ও ১৪৭টি উপজেলার মধ্যে ১২টি জেলার ৪৮টি উপজেলা সমুদ্রের অববাহিকায় অবস্থিত। বাকি ৯৯টি উপজেলা ভৌগোলিকভাবে অভ্যন্তরীণ উপকূলের অংশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। এদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে মাছ, কৃষি, বন, স্থানীয় পরিবহন, লবণ ইত্যাদির ওপর। এ দেশের উপকূলের জনগোষ্ঠী প্রতি বছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন : সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদির মুখোমুখি হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট নানা রকম দুর্যোগ যেমন : আর্সেনিক দূষণ, জলাবদ্ধতা, চাষের জমির জলাবদ্ধতা। আর এসবের সঙ্গে সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে এ অঞ্চলের মানুষ। উপকূল নিয়ে অনেক বেসরকারি সংস্থা কাজ করতে দেখা গেছে। এদেরই একটি কোডেক। সম্প্রতি এক গবেষণায় কোডেক উপকূলীয় জনপদের জীবন-জীবিকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়ন দলিলে অন্তর্ভুক্ত, বাস্তবায়নসহ ৬৮টি সুপারিশমালা তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সব সময় অবহেলিত থাকে। উপকূলের সবচেয়ে আদি পেশা হলো সমুদ্রে মাছ আহরণ, অর্থাৎ জেলে পেশা। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় কয়েক লাখ জেলে পরিবার বাস করে। দেশের মোট জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ এই জেলে সম্প্রদায়। দেশের উন্নয়নে এ জেলে সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই, বরং তাদের ভূমিকা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু এ সম্প্রদায়ের রয়েছে নানামুখী সমস্যা, যে সমস্যার কোনো অন্ত নেই। প্রতিযোগিতার এ যুগেও জেলেরা তাদের জীবিকা নির্বাহে এখনো সেই পুরনো পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে মৎস্য আহরণ করেন। জীবনমান উন্নয়নে জেলে পরিবারের নারীরা একদিকে বাইরে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে, অন্যদিকে সংসারের কাজও সম্পন্ন করেন। এই নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামুদ্রিক মাছ শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করে। এসব শুঁটকি মাছ বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলদস্যুদের আর প্রভাবশালীদের অত্যাচারে বিগত দশক থেকে জেলে পরিবারের অনেকে তাদের এ পেশা থেকে ছিটকে পড়ছে। জেলে পরিবারের নারীরা এখন অন্যান্য কাজও করছে। শুঁটকি তৈরির কাজের পাশাপাশি শাকসবজি উৎপাদনসহ বিভিন্ন আয়বর্ধনমূলক কাজ করছে। কিন্তু এত কিছুর পরও সব সময় উপকূলের মানুষ অবহেলিত। প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যম উপকূলকে কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে? বা কতটুকু গুরুত্ব পায়? তবে অস্বীকার করারও সুযোগ নেই, এখন দু-একটি সংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টাল উপকুল নিয়ে বেশ সংবাদ পরিবেশন করছে। যার মধ্যে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ দেখা গেছে অন্যান্য বিভাগের পাশাপাশি ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামে একটি বিভাগই রয়েছে, যেখানে উপকূলের দুঃখ, দুর্দশাসহ নানা বিষয়ে বিশেষ স্টোরি থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে, উপকূলসন্ধানী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর মতো অনেক সংবাদকর্মী উপকূলের সংবাদ সংগ্রহের জন্য দিন-রাত ছুটে চলেন।

উপকূলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগ এলেই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খবরাখবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না। উপকূলের প্রান্তিকের তথ্য যেমন কেন্দ্রে পৌঁছায় না, ঠিক তেমনি কেন্দ্রের মাঠে পৌঁছাচ্ছে না বহুমুখী কারণে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে প্রান্তিক জনপদের তথ্য মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেও এখনো উপকূল নিয়ে গণমাধ্যমকে ভাবতে দেখা যায় না। উপকূলের ভয়াবহতা উপকূলবাসীরাই কেবল বুঝবে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘটনা উপকূলবাসী আজও ভুলেনি। এটাই উপকূলবাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় দিন। কারণ, ওই দিন উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল গোটা উপকূল।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক এবং কৃষিপ্রধান দেশ। দক্ষিণাঞ্চলের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভর করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগও এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বেশি বয়ে যায়। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলাসহ নানা দুর্যোগের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ। তার পরে নার্গিস, রেশমা, গিরি, রোয়ানুতো রয়েছেই। ২০০৭ সালের ১৫ নভে¤¦র দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ যাবৎকালে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে এ জনপদের বিশাল বেড়িবাঁধের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয় ৩৬৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের। ২০০৯ সালে উপকূলে আবারও আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। বড় ধরনের দুটি ঘূর্ণিঝড়ের এসব এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দ্রুত মেরামত না হওয়ায বিস্তীর্ণ এলাকা আজও অরক্ষিত। ফলে সামান্য প্লাবনেও লবণাক্ত পানি ভেতরে প্রবেশ করছে।

উপকূলে যত দুর্যোগ : ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় ছিল একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা ওই বছরের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত ইউকিপিডিয়ার রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সমুদ্র সমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এটি ১৯৭০-এর উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ষষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল, যা সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরে ৮ নভেম্বর সৃষ্ট হয়ে ক্রমেই শক্তিশালী হতে হতে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে (১১৫ মাইল) পৌঁছায় এবং সে রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। এতে ওইসব এলাকার ঘরবাড়ি, গ্রাম ও শস্য স্রোতে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল তজুমদ্দিন উপজেলা, সেখানে ১৬৭০০০ জন অধিবাসীর মধ্যে ৭৭০০০ জনই (৪৬%) প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ১৯৮৮ সালে সংঘটিত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে দেশে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সর্বনাশা বন্যা হিসেবে পরিচিত। ২১ নভেম্বর মালাক্কা প্রণালিতে এই ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হয়েছিল। শুরুতে এটি পশ্চিমগামী ছিল, এরপর গভীর নিম্নচাপ থেকে ক্রমান্বয়ে আন্দামান সাগরে এসে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। নভেম্বর ২৬ তারিখে, এটি তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তরদিকে ঘুরে যায়। ধীরে ধীরে, এর গতি তীব্রতর হয় এবং ১২৫ মাইল/ঘণ্টা (২০০কিমি/ঘণ্টা) বাতাসের গতিতে ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের স্থলভূমিতে আঘাত করে। এই গতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী অবস্থা ধরে রাখে এবং এটি ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মাঝারি ঘূর্ণিঝড় হিসেবে সক্রিয় ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সর্বমোট ৬,২৪০ জনের মৃত্যু ঘটে, এর মধ্যে বাংলাদেশের ৫,৭০৮ জন এবং পশ্চিমবঙ্গের ৫৩৮ জন। অধিকাংশ মৃত্যু ঘটে প্রচ- ঝড়ের কারণে, ঘরবাড়ি এবং আক্রান্ত অঞ্চলের বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে তড়িতাহত হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি। এটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিমি/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে। এর ফলে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানে সিডর। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার পর পাথরঘাটায় বলেশ্বর নদীর উপকূল অতিক্রম করে এটি। ঝড়ের তা-বে উপকূলীয় জেলাগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধসহ সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের প্রায় ৬০০,০০০ টন ধান নষ্ট হয়েছে। সে সময় বিশ্বঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন না থাকলে পাথরঘাটাসহ উপকূলের কোনো চিহ্ন থাকত না। প্রায় ৯৬৮,০০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং ২১০,০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল, প্রায় ২৪২,০০০ গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা গেছে। বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিমি এবং ৩০৫ কিমি বেগে দমকা হাওয়া বইছিল। এ কারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী একে ক্যাটাগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আখ্যা দেওয়া হয়। ১৮ নভে¤¦র সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারিভাবে ২,২১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনাকে জাতীয় দুর্যোগ বলে ঘোষণা করে। এ ছাড়া আইলা, নার্গিস, রোয়ানুসহ ছোট ছোট নানা দুর্যোগসহ প্রতিনিয়ত উপকূলের বাসিন্দারা দুর্যোগ মোকাবিলা করছে।

জীবনের সঙ্গে যাদের নিরন্তর সংগ্রাম : উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেসহ স্থানীয় বাসিন্দারা জীবনের শুরু থেকেই নিরন্তর সংগ্রাম করে করে বেঁচে আছে। একদিকে প্রকৃতির নির্মমতা, অন্যদিকে বেঁচে থাকার সোনালি স্বপ্নের হাতছানি। নদীভাঙনের করাল গ্রাস থেকে বাঁচার প্রত্যাশায় নতুন ঠিকানার আশায় বুক বাঁধা। দিনরাত পরিশ্রম করে অভাব আর সীমাহীন দরিদ্রতার কবলে ক্ষুধার হাহাকার আর নানা রোগ শোক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে তাদের, তবু থেমে নেই তাদের জীবন সংগ্রাম।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ এখন আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির মধ্য দিয়েই সেটা স্পষ্ট। সে অগ্রগতিতে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকার মানুষরাও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এসব খেটে খাওয়া মানুষদের নিরাপত্তা ও অন্য সুযোগ-সুবিধা দিলে পরিপূর্ণভাবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। সে কারণে উপকূলের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও থাকতে হবে ব্যাপক ভূমিকা-আমরা এটাই প্রত্যাশা করছি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist