নাহিদ হাসান রবিন

  ২৯ জুলাই, ২০১৮

সংবাদপত্র ও মফস্বল সাংবাদিকতা

একটি সুন্দর ও বিশুদ্ধ সমাজ গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিহার্য। সংবাদপত্র যে কেবল সংবাদই পরিবেশন করে, তা নয়। জনমতের প্রতিফলন ও জনমত গঠনেও সংবাদপত্রের ভূমিকা ইতিবাচক। আজ প্রযুক্তির উন্নয়নে সংবাদের বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি হলেও, সংবাদপত্রের আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। কখনো যাবেও না। সংবাদপত্রের পাঠক আছে এবং থাকবে।

সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও নানা ধরনের তথ্য পরিবেশন করে থাকে। শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে

পারি। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় রয়েছে আলাদা বিভাগ, যা থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আরোহণ

করতে পারে সহজেই। রয়েছে পাঠকদের জন্যও আলাদা পাতা। সেখানে পাঠকরা তাদের নানা মন্তব্যের

কথা লিখতে ও পড়তে পারেন। নগর, বন্দর পেরিয়ে দুর্গম চর এলাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে এই সংবাদপত্র। আঞ্চলিক পত্রিকার পাশাপাশি এখন সব জায়গাতেই পাওয়া যায় জাতীয় পত্রিকা। ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের শিক্ষা ও বিনোদনের একটি অন্যরকম মাধ্যম এই সংবাদপত্র। সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের লেখা প্রবন্ধ, কলাম, মতামত পাঠকদের চিন্তাশক্তিকে করে তোলে আরো বেগবান। সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় জনমত গঠনে সহায়তা করে। এভাবে আমাদের দৈনন্দিন নানা বিষয়ে সংবাদপত্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। সব মিলিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সংবাদপত্র

একটি নির্দেশিকা।

সংবাদপত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মফস্বল সাংবাদিকরা। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সংবাদ সংগ্রহ করে থাকেন। রাত নেই, দিন নেই, যখন যেখানে যা ঘটছে, দ্রুত সেখানে চলে যাচ্ছেন সেই সংবাদ সংগ্রহের জন্য। অথচ এই মফস্বল সাংবাদিকদের কোনো বেতন নেই। হাতে গোনা দু-একটা পত্রিকার প্রতিনিধিরা নামমাত্র একটা সম্মানী পান, যা থেকে নিজের পকেট খরচ চালানো কঠিন। তাহলে প্রশ্ন আসে, তারা কেন এই পেশায় আসেন? এ প্রশ্ন আসা ভুল নয়। এ বিষয়ে সামান্য কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সাংবাদিকতা মূলত নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে, দেশীয় সংস্কৃতিকে লালন করে পরম মমতামাখা মন নিয়ে কিছু সৃজনশীল মানুষ এই পেশায় আসেন। এখানকার আয় দিয়ে সংসার চালানোর কথা ভেবে নয়, সমাজের জন্য ভালো কিছু করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তারা আসে এই পেশায়। নিজেদের অন্য কোনো কর্মের আয় বা সংসারের টাকা খরচ করে ক্যামেরা, কম্পিউটার বা চলাচলের জন্য বাইক বা অন্য কোনো যানবাহন কিনতে হয় তাদের। সংবাদ সংগ্রহ ও পত্রিকা অফিসে সংবাদ পাঠানোর জন্য ইন্টারনেট খরচ ও যাতায়াত খরচটাও নিজ পকেট থেকে করতে হয়। এইটুকুতেই শেষ নয়। অনেক পত্রিকার সাংবাদিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যার জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজ। অনেক কষ্ট

করে তাদের এই বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে হয়। মফস্বল এলাকা থেকে এই বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা কতটা কঠিন,

তা কেবল ভুক্তভোগী সাংবাদিকরাই জানেন। এত কিছু করেও তাদের নানা হুমকির মধ্যে চলতে হয়। দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো অপরাধ বা অপকর্মের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ করলে তাদের হুমকির স্বীকার

হতে হয়। এমনকি লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে অনেক সময়। হায়রে সমাজ, যারা জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের থাকতে হয় ভয়, শঙ্কা আর হুমকির মধ্যে।

বেশির ভাগ সাংবাদিকের সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফিরতে হয় খালি হাতে। গিন্নি বা সন্তানদের সামনে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকতে হয়। কখনো কখনো গিন্নির কাছে না হলেও, সন্তানদের কাছে মিথ্যা কথা বলতে হয় ওদের ছোটখাটো আবদার মেটাতে না পারার জন্য। এটা যে কতটা লজ্জার, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। এরপরও অনেকে সাংবাদিকদের বলে থাকেন চাঁদাবাজ। কেউ কেউ তো সাংবাদিক না বলে, সাংঘাতিক বলে। এসব অবহেলা আর নানা প্রতিকূলতায় অনেক সময় কেউ কেউ তাদের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে। সাংবাদিকদের মধ্যে দু-একজন যে অপসাংবাদিকতা করে না, এ কথা বলা যাবে না। তাদের বলা হয় হলুদ সাংবাদিক। এদের সংখ্যা কম হলেও, কাজের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। এরা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে, নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। কিছু কিছু নামধারী সাংবাদিক আছে, তারা গলায় আইডি কার্ড ও কাঁধে একটা ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরলেও কখনো তাদের লেখা কোনো নিউজ চোখে পড়ে না। যাদের নিউজ লেখার মতো ন্যূনতম যোগ্যতা নেই, তারাও এখন সাংবাদিক। বিভিন্নজনের কাছ থেকে নিউজ নিয়ে তারা নিজের নামে চালিয়ে দেয়। আবার কিছু আত্মকেন্দ্রিক সাংবাদিক রয়েছেন, যারা সংগঠনে একটা পদ পাওয়ার আশায় বা পদ ধরে রাখার জন্য নিজেদের আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের সাংবাদিক বানিয়ে ভোটার বাড়ান। কেউ কেউ তো আজকাল মস্তানদেরও সাংবাদিক বানাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও অপরাধীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যার ফলে দিন দিন অপরাধ বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে, এসব ভুয়া সাংবাদিকের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এসব অপসাংবাদিকতা যদি রোধ করা না যায়, তবে খুব অল্পদিনেই সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের যে আস্থা রয়েছে, তা হারিয়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে, সরকার ও জনগণের সচেতনতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রকৃত সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন। হলুদ সাংবাদিকদের অপকর্মের কথা তুলে ধরে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের এ পথ থেকে সরাতে হবে। তবেই সাংবাদিকদের সম্মানটুকু টিকে থাকবে। জাতি

ফিরে পাবে একটি বিশুদ্ধ সমাজ। সর্বোপরি সরকার ও দেশের জনগণের সুদৃষ্টি আর সহযোগিতার পাশাপাশি পত্রিকা মালিকদের সুদৃষ্টি থাকলে এই পত্রিকার মাধ্যমে

ঘুণে ধরা সমাজকেও একটি উন্নয়নশীল সমাজে

রূপান্তরিত করা সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist