হোসাইন মুবারক

  ২৭ মে, ২০১৭

ভেজালবিরোধী অভিযান ও নিত্যপণ্যের সুব্যবস্থাপনা

মাহে রমজানের সমাগত। দেশের সর্ববৃহৎ মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র মাস। সিয়াম সাধনা ও ত্যাগের মাস। প্রতিবছরের মতো এ মাসে দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। এ রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকারের দুটো পদক্ষেপ চোখে পড়ার মতো। ব্যাপক চাহিদার কয়েকটি নিত্যপণ্যের বাজারদর স্থিতিশীল রাখা এবং ভেজালবিরোধী অভিযান।

প্রথমে নিত্যপণ্যের কথায় আসি। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান টিসিবির মাধ্যমে ১৫ মে থেকে ট্রাকে করে চিনি, মশুর ডাল, ছোলা ও সয়াবিন তেল-এ চারটি পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ খাদ্যপণ্যগুলো বিক্রি হবে ১৬ জুন পর্যন্ত। টিসিবির ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল ৮০ টাকা, ছোলা ৭০ টাকা এবং সয়াবিন ৮৫ টাকা প্রতিলিটার বিক্রির কথা।

ওপরের পণ্যগুলো সবই নিত্যব্যবহার্য। অসৎ ব্যবসায়ীরা এ চারটি নিত্যপণ্যে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধি করে বেশি। রমজান মাসে এ পণ্যগুলোয় হঠাৎ ঊর্ধ্বগতিতে মূল্য বাড়ে। অনুসন্ধানে কারণ যা পাওয়া যায়, তার চেয়ে চলে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের উক্তি। কিন্তু এবার সরকারের প্রসারিত পদক্ষেপে অনেকটা প্রতিরোধী ভূমিকা রয়েছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি সারা দেশে ১৮৫টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে বিক্রি করছে এসব পণ্য। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৩৩টি ও চট্টগ্রামে ১০টি খোলা ট্রাকে চলছে পণ্য বিক্রি। অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর প্রতিটিতে ৫টি করে এবং বাকি জেলা শহরগুলোয় ২টি করে ট্রাকে পণ্য বিক্রি করার কথা। প্রতিটি ট্রাকে ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি করে মশুর ডাল, ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি করে ছোলা এবং ৩০০ থেকে ৪০০ লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। এ উদ্যোগ তৃণমূলের গণমানুষের মাঝে প্রভাব ফেলছে। মূলত এসব খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তরা পড়ে ঊর্ধ্বমূল্যের জাঁতাকলে। না-থাকে এদের পর্যাপ্ত পয়সা, না-পারে এরা ঊর্ধ্বমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে। সব মিলিয়ে হা-হুতাশ এদের নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকত। এবার কিছুটা হলেও এ থেকে নিস্তার পেতে পারে মানুষ। এবার আসা যাক ভেজালের কথায়। ফল সবজি থেকে শুরু করে অনেক পণ্যেই ভেজাল দেওয়া হয়। এটা আমাদের কাছে চেনাচিত্র হয়ে গেছে।

জ্যৈষ্ঠ মাস আমের মৌসুম। সুস্বাদু আমে দেওয়া হয় ফরমালিন। আর এই ফরমালিনে বিষসাদৃশ্য হয়ে যায় সুমিষ্ট ফল। অনেক সময় চেহারায় আসে পরিবর্তন। মানুষ ভয়ে আম কেনা কমিয়ে দেয়। আমচাষি থেকে বিক্রেতা পর্যন্ত পড়ে ক্ষতির মুখে। আমনির্ভর অর্থনৈতিক প্রবাহ স্থবির হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, যে ফল আনন্দ-উল্লাসে উপভোগ করার কথা, সে ফল দেখে মানুষ ভীত হয়ে পড়ে। খাবার সময়ও মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। প্রাকৃতিক ফল হয়ে যায় মানববিধ্বংসী বিষটোপ। এর চেয়ে আর বড় কষ্টের কী হতে পারে? আখের গুড়। এর শরবত রোজাদারদের কাছে প্রিয়। সেই গুড়কে আরো সাদা করতে দেওয়া হয় হাইডোজ। এতে বিক্রি বাড়ে বটে, কিন্তু ক্রেতারা থাকেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। ভয়ে গুড় কিনতে চান না অনেকে। কিনলেও সতর্কদৃষ্টি আর সন্দেহ একসঙ্গে কাজ করে। খাবার সময় ভেতরে বিদ্ধ হয় সন্দেহের তীর।

টমেটো শীতের সবজি হলেও এখন বারো মাস পাওয়া যায়। এ টমেটোকে বিষ স্প্রে করে অকালে পাকানো হয়। একসঙ্গে সব লাল হয়ে যায়। এটাকে কেউ বলেন হরমোন। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় এসব ভয়ঙ্কর কা-। ক্রেতা-সাধারণ বাজারে গেলে টমেটো নিরীক্ষণ করে ভয়ার্তদৃষ্টিতে। সবই যেন বিষমাখা। কয়েক দিনে চেহারায় পরিবর্তন এলে সন্দেহটা আরেক ধাপ ওপরে ওঠে। এভাবে বললে অনেক পণ্যই তালিকায় চলে আসবে। এটা আর দীর্ঘ না করে ফিরে আসি ভেজালবিরোধী অভিযানের কথায়। সরকার নিত্যপণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে নয়া উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগকে বলা যায়, এ সময়ের প্রসারিত চিন্তার পদক্ষেপ।

ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে জেল-জরিমানা, মামলা দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে খাবার দোকান পরিদর্শনে ৬০০ স্যানিটারি ইন্সপেক্টর কাজ করবেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সারা দেশের স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের কাছে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। খাদ্যে ভেজালের প্রমাণ পেলে পাঁচ বছরের জেল অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাসহ মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে ইন্সপেক্টরদের। ইন্সপেক্টররা রোজার মাসে কিচেন মার্কেট, ফল ও মাংসের দোকান এবং রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করে সন্দেহযুক্ত খাদ্যের নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠাবেন এবং ভেজালের প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিযোগ্য মামলা করবেন। দেশের প্রতিটি বিভাগের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে এ কার্যক্রম চালানো হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ উদ্যোগে নিয়েছে।

এমন উদ্যোগ আগেও নেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, যেখানের পানি সেখানে গিয়েই পড়েছে। ভেজালও আগের মতো আছে। স্যানিটারি ইন্সপেক্টররাও কর্তব্যরত আছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভেজাল পূর্বাপর নিয়মে চলছেই। এবারে যেটা ব্যতিক্রম সেটা হচ্ছে, সরাসরি জেল-জরিমানার ক্ষমতা প্রদান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের জানার কথা, ভেজালটা হচ্ছে কোথায়? তৃণমূলে তাদের একটা যোগাযোগ থাকেই। এ গণযোগাযোগের সূত্র ধরে ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব। সরকারের এ উদ্যোগ নবায়নের ধারা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করলে কার্যকারিতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এমনই দৈনন্দিন জীবনে খাদ্যের নানা স্তরে ভেজালের আনাগোনা। স্বাস্থ্য থাকে সর্বদাই ঝুঁকিতে। এই ভেজালের মধ্যে আমাদের বসবাস। একশ্রেণির অর্থলোভী মানুষ অল্প সময়ে অধিক উপার্জনের লক্ষ্যে এবং আইনি শিথিলতার সুযোগে সহজে ভেজালে জড়িয়ে পড়ছে। আর সাধারণ মানুষ বয়ে চলেছে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন। ভেজাল প্রতিরোধে প্রয়োজন সঠিক মাত্রার তদারকি ও মনিটরিং। শুধু পদক্ষেপ নিলেই চলবে না, যথাযথ মনিটরিংও করতে হবে। না হলে সব কিছু চলে যাবে অতীতের অনুকরণে। সরকারের কর্তব্য যথাযথভাবে তদারকি করা। শক্তভাবে তদারকি করলে ফল তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছবেই। দেশের মানুষের বৃহৎ অংশ মুসলিমদের রমজানের শিক্ষা হচ্ছে আত্মসংযম। এক মাসের শিক্ষায় বারো মাস যাবতীয় লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকা। কিন্তু না, এরপরও ভেজাল পণ্য তৈরিতে জড়িয়ে পড়ে একটা অংশ। অধিক উপার্জনের লোভে মানুষ ভেজাল পণ্য তৈরি করে। এ মাসের আদর্শ থেকে যদি সমাজের বড় অংশ শিক্ষা গ্রহণ করত, তাহলে তো বেশিরভাগ মানুষের সতর্ক হয়ে যাওয়ার কথা।

পণ্যের উচ্চমূল্য লোভ থেকে সৃষ্টি। যারা পণ্য স্টক করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটান, সেসব ব্যবসায়ীও লোভ থেকে করেন। না হলে রমজান মাসে কাঁচা, শুকনো সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ত না। আসলে আমরা রমজানের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করি না।

ভেজাল কোথায়, কখন, কীভাবে হয়-এটা আশপাশের মানুষের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জানার কথা। অনেক সময় এটা অঞ্চলভিত্তিকও হয়। সামাজিক বাস্তবতার কারণে অনেকে জেনেও না-জানার, দেখেও না-দেখার ভান করেন। যেসব এলাকায় পণ্যে ভেজাল দেওয়া হয়, সেসব এলাকায় জনমত তৈরি, গণপ্রচারণা, তর্কসভা করা দরকার। এসব এলাকায় সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকার গণ্যমাণ্য ব্যক্তি-সবার সমন্বয়ে সতর্কসভা করা হলে ভেজালের মাত্রা অনেকটা রুখে দেওয়া সম্ভব।

উচ্চমূল্যের ব্যাপারে আরো যেটা বলা দরকার সেটা হচ্ছে, কোথায়, কিভাবে উচ্চমূল্য ঘটে, সেটার খোঁজ নিলে অনেক তথ্য মিলে যায়। বিশেষ করে, সরকারের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা কোনো-না-কোনোভাবে জেনে যান। এসবের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক অভিযান দরকার। প্রয়োজনে অবৈধ মজুদকৃত পণ্য আটক করে বিক্রয়লব্ধ মূল্য সরকারের কোষাগারে নিতে হবে, সে সঙ্গে ঘোষিত শাস্তি দিতে হবে। তাহলে স্টককারীরা শাস্তির ভয়ে অনেকটা সতর্ক হবে। সরকারি উদ্যোগের যদি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই না থাকে, তাহলে অবৈধ স্টককারীরা কেন সতর্ক হবে। তাহলে তো উচ্চমূল্য চলতেই থাকবে। এক মাস রোজা রাখার পর আমরা রোজার শিক্ষা কী তা ভুলে যাই। এক মাস কষ্ট করে রোজা রেখে আমরা আবার জড়িয়ে পড়ি ভেজাল পণ্য উৎপাদনে ও দ্রব্যের উচ্চমূল্য সৃষ্টিতে। ঈদ শেষ হলেই আবার পুরো দমে শুরু হয়ে যায় ভেজাল পণ্য উৎপাদন। অর্থাৎ আমরা এক মাস নৈতিক থাকি আর সারা বছর থাকি অধিক মুনাফার লালসায় যাবতীয় অনৈতিক কর্মে লিপ্ত। তাহলে কী করে সমাজে সুস্থতা ফিরে আসবে? এটা আমাদের সবাইকে ভাবা দরকার যে, শুধু সরকারের অভিযান চালালেই হবে না, আমাদেরও সচেতন হতে হবে। তাহলেই কেবল এই অসুস্থ সামাজিক অনাচার থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যে ভেজাল দেওয়া অসৎ ব্যবসায়ীদের পুরনো অভ্যাস। বিষয় দুটো সাধারণ মানুষের গা-সহা হয়ে গেছে। সরকার বিষয় দুটোয় প্রতিবছরের মতো আবার পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন পর্যবেক্ষণের পালা- গণমানুষের নির্ভেজাল জীবনযাপনে কতটা স্বাভাবিকতা আসে। আশা ও শঙ্কা দুটোরই সঙ্গী রইল নাগরিক সমাজের। এখন সেটাই দেখার বিষয়- নাকি আবার ফিরে আসবে সেই চিরচেনা রূপ। সেটাই অনুভবে থাক সারাক্ষণ অবিরাম।

লেখক : সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist