জুয়েল কবির

  ২৭ মে, ২০১৭

টিভি নাটক ও নির্মাতাদের দায়

বর্তমান বাংলাদেশের টিভি নাটক একধরনের সঙ্কটের মধ্যে আছে। এখনকার টিভি নাটক মানেই তরুণ-তরুণীর প্রেম, কিংবা হা হা হি হি কমেডি। বাংলাদেশের টিভি পর্দায় তাই নায়ক-নায়িকা আর কাতুকুতু দিয়ে হাসাতে পারা অভিনেতাদেরই সার্বক্ষণিক আধিপত্য লক্ষ করা যায়। শক্তিশালী অনেক প্রবীণ অভিনয়শিল্পীর পর্দা উপস্থিতি দিনকে দিন যেন উপেক্ষিতই হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে মামুনুর রশীদের মতো কিংবদন্তিতুল্য অভিনেতাকেও অনেকটা আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, গত মাসে মাত্র পাঁচ দিন শুটিং ছিল। অথচ এসব অভিনয়শিল্পীর কাছ থেকে আরো অনেক ভালো ভালো কাজ পেতে পারত জাতি। আচ্ছা কী এমন কারণ আছে বর্তমান এই পরিস্থিতির পেছনে? এ লেখার উদ্দেশ্য মূলত এটাই।

‘প্রবল জ্যোৎস্না, নৌকার ভেতরে ছোট ছোট আলো জ্বলছে... হাঁটু বরাবর কাদা ভেঙে আমরা নৌকায় গিয়ে উঠলাম’... কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এভাবেই বলে চলেন তার লেখালেখির গল্প। অথচ এ গল্প নিয়ে টিভি নাটক বানাতে গেলে গলদঘর্ম হতে হয় একজন টেলিভিশন নাট্য পরিচালককে। প্রথমত, টিভি চ্যানেলের গল্প পছন্দ হওয়ার ঝক্কি, দ্বিতীয়ত, বাজেট স্বল্পতা। তাই দিনে দিনে এক ঘণ্টার নাটকের এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ কমে গেছে অনেকটাই, নাট্যগল্পের স্বাভাবিক চলনও যেন বাধাগ্রস্ত বর্তমান বাংলাদেশের টিভি নাটকে।

অথচ বাংলা টিভি নাটকের একটা সোনালি অতীত আছে। সেই অতীতে বিটিভিতে প্রচারিত নাটকগুলো দর্শকের মন জয় করে। সকাল-সন্ধ্যা, ঢাকায় থাকি, মাটির কোলে, ফিরিয়ে দাও অরণ্য, এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, বারো রকম মানুষ, নক্ষত্রের রাত, সংশপ্তক, গ্রন্থিক গণ কহে, বহুব্রীহি, এ রকম আরো অনেক নাটকের নাম করা যায়। এগুলোর সবটিতেই প্রেম ছিল, কিন্তু কেবলই তরুণ-তরুণীর প্রেম আর কোনো ম্যাসেজ ছাড়া অযথাই হা হা হি হির খোড়াক ছিল না। সে কারণেই এসব নাটকের তুঙ্গস্পর্শি জনপ্রিয়তা ছিল। এরপর বিটিভিতে প্রচলন হয় প্যাকেজ নাটকের। একের পর এক নির্মিত হয় অসাধারণ সব কাহিনিচিত্র। এসব কাহিনিচিত্রের জনপ্রিয়তা কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ভারতের বাংলা ভাষা অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরাসহ সেভেন সিস্টার খ্যাত প্রদেশগুলোতে। অথচ আমাদের নাটকের দর্শকরা এখন মুখ ঘুরিয়েছে অন্যদিকে। সে মুখ ফেরে না সহজে। তাই ভালো নাটক কখনও বানানো হলেও আমার দেশের একজন নাট্যকারকে তার নাটক দেখার জন্য ফেসবুকে আহ্বান করতে দেখি এভাবে-

‘আমি জানি এদেশের অনেক টিভি নাটকের দর্শক ঠিক এই মুহূর্তে কলকাতার সিরিয়াল দেখছেন। অথচ বাংলা ভিশনে এখন বৃষ্টিদের বাড়ি শুরু হয়েছে। আমি আমার ভালোবাসার সৃষ্টিকে নিয়ে তাদের কাছে যেতে পারছি না। এর চেয়ে কষ্টের, ব্যর্থতার, পরিতাপের আর কি থাকতে পারে? আহারে কত মানুষের কষ্ট সাধনার ধন একটা, বৃষ্টিদের বাড়ি। ... মাঝে মাঝে খুব জেদ হয়। খুব অভিমান হয়। আমরা আমাদের সিরিয়াল দেখার অভ্যাসটাও ভুলে যাচ্ছি। আজ বৃষ্টিদের বাড়ি দেখার দরকার নেই। আসুন আজ আমরা চ্যানেলটা কত নম্বরে আছে সেটা মনে রাখার চেষ্টা করি। কারণ আমি নিশ্চিত আমাদের বৃষ্টিদের বাড়ি তাদের অনেক কিছুর চেয়ে সুন্দর।’

১৯৯৭ সালে এ দেশে শুরু হয় বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলের যাত্রা। দিনে দিনে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছেই। অথচ চ্যানেলের সংখ্যা বেড়ে গেলেও বাজার বাড়েনি, বাড়েনি বিজ্ঞাপন। আর এ কারণে বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য চ্যানেলগুলোতে সারাবছর একরকম প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে। আর এই সুযোগে তৈরি হয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা নামে এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর। তাদের হাতে বিজ্ঞাপন থাকার সুবাদে বেশিরভাগ চ্যানেলকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে। এ সংস্থাগুলো মূলত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বলে শিল্প, সংস্কৃতি, নাটকের মান তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় হয় না। তাদের কাছে কাহিনি মুখ্য না হয়ে গ্ল্যামার প্রদর্শনটা মুখ্য হয়ে গেছে, সে কারণে নাটকের প্রধানতম বিষয় হয়ে গেছে তরুণ-তরুণীর প্রেম। যে গল্পে সিনিয়র শিল্পীদের সে অর্থে কাজের সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে গেছে। কোনো কোনো শুটিং স্পটে গিয়ে লক্ষ করেছি, সিনিয়র শিল্পীদের একটা শটের জন্য বসিয়ে রেখেছে সারাদিন। তাকে বসিয়ে রেখে নেয়া হচ্ছে নায়ক-নায়িকার শট, তা নইলে নায়ক অথবা নায়িকার সিডিউল মেলানো যাচ্ছে না। এসব প্রেমের নাটকের বাইরে আর যে আরেক ধরনের প্রচলন আছে যেগুলোতে আজগুবি সব ঘটনার উপস্থাপনের মাধ্যমে কেবল দর্শক হাসানোর একটা প্রয়াস চলে সারাক্ষণ। এসবের মাধ্যমে সে অর্থে বিশেষ কোনো ম্যাসেজের সন্ধান পায় কি দর্শক?

মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মতে, প্রতিটা লেখক তার স্মৃতি থেকে লেখে। বর্তমান বাংলাদেশের নাট্যকারদের স্মৃতি বলতে কি কেবলই প্রেম? কেবলই হাস্যরস? ভরত তার নাট্যশাস্ত্রে নবরসের কথা বলেছেন। নাটকগুলো কি অন্যান্য রসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কেবলই হাস্য এবং শৃঙ্গার রসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত সামনের দিনগুলোতেও? নাট্যকার নির্মাতারা কি তাদের স্মৃতি থেকে বয়ষ্ক চরিত্রের অস্তিত্বকে বিলীনই করে দেবেন?

চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিজ্ঞাপনের দরপতন আর মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে পড়ে দিন দিন নাটকের বাজেটের পরিমাণ কমতে কমতে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে, সেখান থেকে কোনো মানসম্পন্ন নাটক বানানোই আর সম্ভব নয়। টিভি নাট্যপরিচালকের সঙ্গে নাট্যকারের ইদানীংকালের ফোন কথোপকথন অনেকটাই ঠিক এ রকম-

পরিচালক : একটা ভালো গল্প দেন ভাই।

নাট্যকার : কী রকম গল্প চান?

পরিচালক : প্রেমের গল্প, নইলে কমেডি। রোমান্টিক কমেডি হইলে আরো বেশি ভালো।

নাট্যকার : শহরের না গ্রামের?

পরিচালক : গ্রামের নাটক কইরা কস্টিং পোষাইতে পারুম না।

নাট্যকার : আর্টিস্ট কয়জন থাকবে?

পরিচালক : দুজন হইলে বেশি ভালো, ইয়াং নায়ক-নায়িকা, বোঝেন তো স্পন্সর চাহিদা। তবে দুয়েকজন সাইড

চরিত্র থাকতে পারে।

নাট্যকার : আউটডোর না ইনডোর করতে চান?

পরিচালক : একটা বাড়িতে শেষ করতে পারলে ভালো হয়। অবশ্য বাড়ির সামনের দুয়েকটা সিন রাখতে পারেন।

নাট্যকার : ওকে। কবে লাগবে স্ক্রিপ্ট?

পরিচালক : ভাই যত দ্রুত সম্ভব। দেখবেন ভাই গল্পটা যেন ফাটাফাটি হয়। একটা সুন্দর নাটক বানাতে চাই।

নাট্যকার : ঠিক আছে হয়ে যাবে।

পরিচালক : আরেকটা কথা ভাই। প্রযোজকের এক ছোটবোন আছে অভিনয় করতে চায়, ওর জন্য একটা চরিত্র

বানায়েন ছোটোখাট।

অনেক পরিচালকই এখন আর এক ঘণ্টার নাটক বানাতে আগ্রহ বোধ করেন না। যারা বানান তারা অর্থ লগ্নির কথা চিন্তা করে পিছিয়ে যান। লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকা ফিরে আসাও কষ্টকর হয়ে যায়। স্টারদের সম্মানি বৃদ্ধির কারণে দেখা যায় নাটকের পুরো খরচের অর্ধেকই চলে যায় শিল্পী সম্মানিতে। আর বাকি অর্ধেক পুরো নাটকের বাকি সব খরচে। এদিকে স্টার কাস্টিং ছাড়া নাটক না বানালে স্পন্সর ঝামেলা হবে, চ্যানেলে নাটক বিক্রিতেও ঝামেলা হবে চিন্তা করে পরিচালকরা স্টার কাস্টিংটা রেখে বাকি শিল্পীর সম্মানি আর না বাড়াতে দুই, আড়াই কিংবা চার পৌনে পাঁচ চরিত্রের নাটক বানান। দুই চরিত্রের অতিরিক্ত শিল্পীরা অনেকটা সম্মানি ছাড়া গেটিস শিল্পী হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে তাদেরকে পূর্ণ সংখ্যা ধরা হলো না লেখায় (সেজন্য দুঃখিত)। অন্যদিকে নাটক নির্মাণের বাজেট কমে যাওয়ার কারণে বেশিরভাগ নাটকের শুটিংস্পট হয়ে যাচ্ছে ঢাকাকেন্দ্রিক, বড়জোর পুবাইল-হোতাপাড়ার আশপাশে।

কাহিনি এবং বিষয়বস্তুর একঘেয়েমি, লোকেশনের বৈচিত্র্যহীনতা এবং নিয়মিতভাবে একই ধরনের অভিনেতা-অভিনেত্রীর পর্দা উপস্থিতি সর্বোপরি দর্শক চাহিদার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ না দেওয়ার কারণে আমাদের টিভি দর্শকরা দিন দিন ব্যস্ত হয়ে পড়ছে পাশের দেশের চ্যানেলের প্রতি। বেশিরভাগ দর্শকেরই অভিযোগ-প্রেম এবং কমেডি ছাড়া বাংলাদেশের নাটক হয় না। তার ওপর আবার বিজ্ঞাপনের অত্যাচার। নাটক দেখায় যতটুকু বিজ্ঞাপন দেখায় তারচেয়ে বেশি। ইত্যাদি।

ইন্ডিয়ান জি-বাংলা, স্টারপ্লাস কিংবা জলসার নাটক যেগুলো আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়, সেগুলো মূলত ওল্ড হ্যাজার্ড মূল্যবোধ নিয়ে তৈরি হয়। লোকেশনের কারিশমা সেগুলোতেও নেই। তবে আছে সব ধরনের চরিত্রের অংশগ্রহণের সুযোগ। যদিও নাটকগুলোর ইনটেনশন খুব পজেটিভ নয়। সেসব নাটকের টার্গেট মূলত পঞ্চাশোর্ধ দর্শক।

নাটকগুলোতে সেসব মানুষের প্রচলিত মূল্যবোধ তথা ইমোশনকে গুরুত্ব দিয়ে তাদেরকে তাদের সময় থেকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আরো অতীত সেন্টিমেন্টে। এসব নাটকে মানুষের চিন্তা-ভাবনার পরিণতি আনার চেষ্টা হয় না একেবারেই। তবে এসব নাটকের রচনা নিয়ে দর্শক সেন্টিমেন্ট নিয়ে বেশ চিন্তা করে সেসব ওসব নাট্য নির্মাতারা, এটা খুব স্পষ্ট। যার ফলেই অন্ততপক্ষে দিন দিন আমাদের দেশের তথা ইন্ডিয়ার পঞ্চাশোর্ধ মানুষগুলোকে এসব নাটক দেখাতে বাধ্য করতে পারছে তারা। আচ্ছা আমাদের নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন, নাট্য নির্মাণ নিয়ে আসলে ঠিক কতটুকু স্ট্র্যাটেজিক ওয়েতে চিন্তাভাবনা করা হয় সেসব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। সত্যিকার অর্থেই আমরা এসব নাটকের মাধ্যমে কি ম্যাসেজ পৌঁছাতে চাই দর্শকদের?

আমাদের নাট্যকারদের নাটক লেখার ক্ষমতা আছে। তাদেরকে দিন দিন কেবল ফরমেটিভ ওয়েতে বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। চরিত্র সংখ্যা সীমাবদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সে কারণে দিনকে দিন আমাদের প্রবীণ অভিনেতারা হয়ে পড়ছেন বেকার। অথচ তাদেরকে কেন্দ্র্র করেও তৈরি হতে পারে অনেক মহৎ নাটকের।

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা দর্শকরা নাট্যকারদের মাধ্যমে ভালো গল্প দেখতে চাই। দেখতে চাই গল্পের প্রয়োজনে যেকোনো চরিত্রের অনুপ্রবেশ নিশ্চিত হয়েছে। সে চরিত্রের বয়স কম নাকি বেশি সেটা মুখ্য নয়। সে অভিনেতার ফেসভ্যালু কতটা সেটাকে আমরা প্রাধান্য দিতে চাই না। আমরা দেখতে চাই অভিনেতার অভিনয়। আমরা দিন গুণতে চাই সেই দিনের, যখন বাংলাদেশের টিভি নাটক দেখবে বলে একটা স্পেশাল টাইম বরাদ্দ রাখবে আমাদের দর্শক। অতীত দিনের মতো পুরো এক সপ্তাহ অপেক্ষায় থাকবে পরবর্তী পর্ব দেখার জন্য। সেদিন কি আসবে না আর? সেদিন কি আসবে না আর, যেদিন কেবল গ্ল্যামার প্রদর্শন নয়, একটা ভালো গল্প প্রদর্শনের জন্য যা যা করা দরকার তার আয়োজনই করবে নাট্যকার, নির্মাতা, প্রযোজক, চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আর স্পন্সর কোম্পানিগুলো?

লেখক : টিভি নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist