পাঠান সোহাগ

  ২৭ মে, ২০১৭

কংলাক পাহাড়ের চূড়ায়

কিছুদিন আগের কথা। কলাবাগান থেকে ২৩ জনের একটি দল নিয়ে বাসে রাত সাড়ে ১১টায় সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। সকাল ৮টায় ঢাকা থেকে ২৬১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে খাগডাছড়ি পর্যটন মোটেলে পৌঁছে আমাদের দলটি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সকালের নাশতা শেষে রাঙামাটির সাজেকের পথে বেরিয়ে পড়লাম সবাই। চলার পথে দুটি চান্দের গাড়িই আমাদের সাথী। গাড়ি ছুটছে হেলেদুলে হাওয়ার বেগে। আশপাশের দৃশ্য দেখে বিমোহিত হলাম।

জেলা সদর থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। চলতে চলতে গাড়ি তখন বাঘাইছড়ি। এ উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটারের দূরের সাজেকের পুরো পথ পাহাড়ে ঘেরা। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম রূপ, অরণ্যভূমি আর পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের হাতছানি মনে প্রশান্তির দোলা দেয়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উঁচু-নিচু রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কয়েকটি নদী। পাহাড়ের বুক চিরে নদীগুলো বয়ে গেছে বহু দূর। রাস্তার দুপাশের বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি ছোট ছোট কুঁড়েঘর। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জুম, কলা, পেঁপে চাষের কারণে সৃষ্ট পাহাড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ দলের সবাই।

উড়োবাজার, গঙ্গারামমুথ, নন্দরাম-এসব পাহাড়িপাড়া পেরিয়ে আমাদের চান্দের গাড়ি পৌঁছে গেল মাচালং বাজারে। পাশের সীমান্তঘেঁষা ভারত থেকে আসা মাচালং নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে ছোটখাটো বাজার। এটিই সাজেক ইউনিয়নের প্রধান কেন্দ্রস্থল। আদিবাসী আর বাঙালি মিলেমিশে এই বাজারে ব্যবসা করে। দূরদূরান্তের পাহাড়িরা নাকি এক দিন আগেই বাজারে আসতে শুরু করে। মাচালং বাজার থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে সাজেক। আকাশচুম্বী পাহাড়ের বুকে শির তুলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি। দূরের পাহাড়ে শুভ্র সাদা মেঘ দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম কাক্সিক্ষত মেঘরাজ্যের সেই সাজেক ভ্যালি।

বলে রাখা ভালো, সাজেক রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। সাজেক হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। এর আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও যাতায়াতে সুবিধার কারণে পর্যটকরা খাগড়াছড়ি জেলা দিয়েই সাজেকে আসা যাওয়া করে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। সাজেকে প্রবেশের আগেই পড়বে সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুইপাড়া। ১৮৮৫ সালে এই পাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত সাজেক বলতে যে স্থানকে বোঝায় সেটি হলো ‘রুইলুই’ এবং ‘কংলাক’ নামে দুটি পাড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১৮০০ ফুট। রুইলুইপাড়ায় সাজেক উপত্যকার মূল কেন্দ্রবিন্দু। রুইলুইপাড়ায় লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। সাজেক থেকে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার।

সাজেকে পৌঁছে আমাদের নির্ধারিত হোটেলে উঠলাম। তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১২টায়। গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। যথা সময়ে চান্দের গাড়ি হাজির। রুইলুইপাড়া থেকে ১৫ মিনিটের পথ কংলাকপাড়া। পাংখোয়াদের বসবাস এখানে। সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২টি পরিবারের বসবাস। বিশাল পাথরখ-ের ভাঁজে ভাঁজে পা ফেলে চূড়ায় উঠতে থাকলাম। পুরো পথটি গিরিখাতময়। নিচের দিকে তাকালেই শরীর কেঁপে ওঠে। বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে এক সময় সেই সর্বোচ্চ চূড়ায় পদচিহ্ন রাখলাম। চারপাশের অপরূপ দৃশ্যে বিমোহিত সবাই। এটিই সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। কংলাকের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো সাজেক উপত্যকার সৌন্দর্য দেখা যায়। শ্রভ্র সাদা মেঘের স্তূপ ভেসে বেড়ায় পাহাড়ের চূড়ায়। এ যেন এক স্বপ্নরাজ্য।

কংলাক পাহাড় থেকে ফেরার পথে রুনময় রিসোর্টের পাশেই হেলিপ্যাডে নামলাম এবং সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করলাম। সন্ধ্যার যে সৌন্দর্য তার বর্ণনা দিয়ে প্রকাশ সম্ভব নয়। এ যেন পাহাড়ের দেশে লাল সূর্যের লুকোচুরি খেলা। সন্ধ্যার আঁধার আরো তীব্র হয়ে রাতের নিস্তব্ধতায় সাজেক যেন ঝিঁঝি ডাকা এক আঁধার রাজ্য। দূর থেকে কিছু সৌরবিদ্যুতের মিটিমিটি আলো দেখা যায়। সব মিলিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি।

জ্যোৎস্না রাতের আলোয় অন্ধকারে দূরের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ভেসে উঠছে ঘন সাদা কুয়াশা। কুয়াশাকে মনে হয় মেঘের ভেলা। অপেক্ষার প্রহর একসময় ভোর হয়। কুয়াশার কারণে মেঘকেও আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না। অপেক্ষা করতে থাকলাম সূর্যোদয়ের। কিছুতেই বুঝিনি কী দীপ্তিময় এক সাজেক অপেক্ষা করছে। সূর্যটাও উঠে গেছে বেশ খানিকটা উপরে। কুয়াশা কাটছে ধীরে ধীরে। শুরু হলো মেঘপুঞ্জের লুকোচুরি খেলা। সত্যিই মনে হলো আমি মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছি। মেঘ মাথার কাছে হেসে নতুন দিনের জানান দিল। হলুদ নদী, সবুজ বন, গেরুয়া পাহাড় সবটুকু অদৃশ্য হয় সাদা মেঘের আড়ালে। মেঘ কেটে কেটে ফিরতে লাগলাম চেনা লোকালয়ের পথে।

সাজেক এমন একটি জায়গা যেখানে ভাগ্য ভালো হলে ২৪ ঘণ্টায় প্রকৃতির তিনটি রূপই দেখা যায়। কখনো খুবই গরম একটু পরেই হঠাৎ বৃষ্টি। তার কিছু পরেই চারদিকে ঢেকে যায় কুয়াশার চাদরে।

আমরা সবাই নাশতা করে গোছগাছ করে হোটেল ত্যাগ করে চান্দের গাড়িতে উঠলাম। শুরু হলো ফেরার যাত্রা। পাহাড়ি পথ বেয়ে নামার পালা। আমরা ঢালু আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নেমে চললাম। খাগড়াছড়ি পৌঁছে পুনরায় পাহাড়ি রান্নার স্বাদ নিতে গেলাম ‘সিস্টেম রেস্টুরেন্ট’। এটি খাগড়াছড়ির একটি ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্ট। এটি বাঁশ আর কাঠের তৈরি অপরূপ নকশায় সজ্জিত। ব্যতিক্রমী ও নানা স্বাদের দেশি এবং পাহাড়ি খাবারের সমাহার। ঐতিহ্যবাহী বাঁশের মধ্যে রান্না করা মুরগির মাংসের (ব্যাম্বু চিকেন) স্বাদ নিলাম।

খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে রিসাং ঝর্ণায় গোসল, বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে দেখা এবং ঝুলন্ত সেতুতে ভ্রমণও বাদ যায়নি। সব শেষে আমরা ৪টার দিকে আলুটিলা পৌঁছে গেলাম। সেখানেই রহস্যময় আলুটিলা গুহা। এটি অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি সুড়ঙ্গপথ। দৈর্ঘে প্রায় ৩০০ মিটার। বাঁশের তৈরি ক্ষুদ্র আকৃতির মশাল নিয়ে দলের সবাই নির্মিত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম। সত্যিই রোমাঞ্চকর ছিল এটি। কিছুক্ষণ পর আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো পর্যটন মোটেলের উদ্দেশে। সন্ধ্যার আগেই আমরা খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছে গেলাম। মোটেলে কেউ কেউ গোসল সেরে বিশ্রাম নিল। আবার কেউবা কেনাকাটায় বের হলো। তারপর শহর থেকে রাতের খাবার খেয়ে ঢাকার উদ্দেশে গাড়িতে উঠলাম। রাত শেষে ভোরে আবারও চেনা শহরে। শুধুই ঘোরাঘুরির জন্য হলে শীতকালে যাওয়া সবচেয়ে ভালো। আপনি যদি এডভেঞ্চারপ্রিয় হন আর পাহাড়ের সত্যিকারের সৌন্দর্য দেখতে চান, তবে বর্ষাকালে যেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন : সাজেকে থাকার জন্য বেশ কিছু ভালোমানের রিসোর্ট আছে। সেখানে পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারবেন। রুনময় রিসোর্ট (বিজিবি পরিচালিত), সাজেক রিসোর্ট (সেনাবাহিনী পরিচালিত), আলো রিসোর্ট, ইমানুয়েল রিসোর্ট, সারা রিসোর্ট, রুইলুইপাড়া ক্লাব হাউসসহ অনেক রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টে আপনি ১৫০০ থেকে ৪৫০০ টাকার মধ্যে থাকতে পারবেন। তবে আগে বুকিং দেওয়া থাকলে ভালো।

কোথায় খাবেন : সাজেক রিসোর্ট, রিসোর্ট রুনময়, টেন্ট এবং আলো রিসোর্টে থাকলে খাবারের ব্যবস্থা রিসোর্ট থেকেই হবে। ক্লাব হাউসে থাকলে সেখানকার কেয়ারটেকারকে দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবেন। খাবার খরচ পড়বে প্রতিবেলা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা। রিসোর্ট রুনময় এবং আর্মি পরিচালিত ক্যান্টিনে অর্ডার করলেও ওরা খাবার এনে দেবে, তবে এখানে দাম তুলনামূলক একটু বেশি হবে। খাবার ব্যবস্থার জন্য পূর্বেই যোগাযোগ করে নেওয়াই ভালো।

কীভাবে যাবেন : রাজধানী থেকে প্রথমে যেতে হবে খাগড়াছড়ি বা দীঘিনালা। তারপর সাজেক। ঢাকা থেকে শান্তি পরিবহন, বিআরটিসি (এসি বাস), সেন্ট মার্টিন (এসি বাস), শ্যামলী, সৌদিয়া, ঈগল, হিমাচল পরিবহন, এস আলম পরিবহনে খাগড়াছড়ি এবং দীঘিনালায় সরাসরি যাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি পর্যন্ত নন এসি ভাড়া ৫২০ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে এক ঘণ্টা পরপর শান্তি পরিবহনের গাড়ি ছাড়ে, ভাড়া পড়বে ১৯০ টাকা। খাগড়াছড়ি থেকে আপনি তিন মাধ্যমে সাজেক পৌঁছাতে পারবেন। চাঁদের গাড়ি, সিএনজি এবং মোটরসাইকেলে। সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো খাগড়াছড়ি শহর থেকে জীপগাড়ি (লোকাল নাম চাঁদের গাড়ি) রিজার্ভ নিয়ে ঘুরে আসা। ভাড়া নেবে ৪৫০০ থেকে ৫৫০০ টাকা। এক গাড়িতে ১২ জন বসতে পারবেন। লোকসংখ্যা বেশি হলে অবশ্যই চাঁদের গাড়ি নিয়ে মজা করতে করতে যেতে পারবেন। সিএনজি তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা অথবা মোটরবাইক এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় রিজার্ভ করে সাজেক ঘুরে আসতে পারবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist