জাহাঙ্গীর হোসেন

  ২৭ মে, ২০১৭

বিস্ময়কর উপহার

আমার সপ্তদশবর্ষীয়া একমাত্র কন্যা নাবিলা গ্রীম্মের ছুটিতে যখন দেশে এলো আমার কর্মস্থল তখন ঢাকায়। মেয়ের ভার্সিটি আর হোস্টেলের বিদেশি বন্ধুদের গল্প শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা। বছর দুয়েক আগে রাশান সরকারের একটি স্কলারশিপ নিয়ে আমার মেয়ে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিষয়ে পড়তে গিয়েছিল মস্কো থেকে প্রায় ৭ ঘণ্টার বিমান পথের দূরত্বের ছোট্ট শহর টমস্কে। টমস্ক রাশিয়ার সাইবেরীয় এলাকার উত্তরাঞ্চলের নিরিবিলি ও শান্ত শহরগুলোর অন্যতম। যেখানে বছরের ৮-৯ মাসের বেশি সময় থাকে বরফে ঢাকা। শহরবাসীরা ফ্রিজের পরিবর্তে তাদের খাবার পলিথিনে ভরে জানালার বাইরে লটকে রাখে। টমস্ক নদীতে পালতোলা নৌকো আর ফিশিং বোটের পরিবর্তে বছরের অধিকাংশ সময় শৌখিন তরুণ-শিশুরা স্কি করে সময় কাটায়। কুকুর-টানা স্লেজ গাড়িতে করে কেউ কেউ নদীর অপর পাড়ের রুশভাষিক গাঁয়ে ঘুরতে যায়। ফুল আর পাতাশূন্য জমে যাওয়া শীতার্থ ওক বৃক্ষ নিয়েই এই ছোট্ট শহরে স্বল্পসংখ্যক মানুষের বসবাস। ওরা ১৬ কোটি মানুষে ঠাসা এক দেশ যার রাজধানী শহর ‘ঢাকা’ তার নাম কখনও শোনেনি অনেকেই। তাই বাংলাদেশে ফিরে আসার বিমান টিকিট কাটতে আমার মেয়েটিকে যেতে হয় পার্শ্ববর্তী শহর নভোসিভিরক্সে। নভোসিভিরক্স হচ্ছে আবার টমস্ক থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টার ট্রেন যাত্রার দূরত্বে। ওখানে কিছু ইংরেজি ভাষিক বিদেশি ও ট্রাভেল এজেন্টের দেখা মেলে। যাদের অনন্ত চেষ্টায় ইন্টারনেটে সেনেগালের রাজধানী ডাকারের পরিবর্তে ঢাকা শহর খুঁজে পায় শেষাবধি তারা। ঢাকার ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আইসক্রিম প্রিয় আমার মেয়ে যখন বর্ণিত মাইনাস তাপমান সর্বত্র আইসক্রিমময় শহর থেকে বহুমুখি অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বভূমে ফিরে আসে, তখন তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা শুনবে না এ সাধ্য কার?

সাইবেরীয় প্রেইরি অঞ্চল, স্তেপ তৃণভূমি, বরফে ছোটাছুটি, লোকাল পুলিশের প্রকাশ্যে ভদকা পান, পেজা তুলোর মতো তুষারপাত, আর নানাদেশীয় বন্ধু-বান্ধবদের গল্প শুনতে শুনতে একসময় মেয়ের ছুটি ফুরিয়ে যায়। ঢাকা থেকে আবার টমস্ক ফেরার প্রাক্কালে মেয়ে নাবিলা তার রুমমেট ও সবচেয়ে প্রিয় ইতালীয় বান্ধবী ফ্রান্সিসকার জন্য গিফট কেনার বায়না ধরে। গুলশান-বনানীর অভিজাত গিফট শপেও মনমতো উপহার খুঁজে পায় না সে। কারণ উপহারটি হতে হবে একক, অনন্য তথা অসাধারণ। যাতে ফ্রান্সিসকা চমকিত হয় বাংলাদেশ থেকে নেয়া তার বন্ধুর উপহারে। নানা দোকান ঘুরে অবশেষে বসুন্ধরা সিটির সেভেল সাতের ফর-ইউ শপের মনোমুগ্ধকর গিফট পছন্দ হয় নাবিলার। হৃদয়গ্রাহী কারুকার্যখচিত গ্রিক পুরাণের দেবদূতের পিঠে উড়ন্ত মানব-মানবীর শিল্পম-িত ক্রিস্টাল অ্যানটিক্স কিনে দিতে হয় চড়া দামে। একমাত্র মেয়ের আবদার রক্ষার্থে তার বিদেশিনী বন্ধুর জন্য তাই কিনে দিতে হলো অবশেষে। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে মেয়ে কনফার্ম হলো, ইতোমধ্যেই তার রুমমেট ফ্রান্সিসকা ছুটি কাটিয়ে ফিরে গেছে টমস্ক ভার্সিটি হোস্টেলে, অপেক্ষা করছে নাবিলার জন্য।

আমিরাতের ইকে জাম্বোজেট ফ্লাইটে দুবাই হয়ে প্রায় দু’দিনের ক্লান্তিকর অথচ নির্বিঘœ বিমান আর ট্রেন জার্নি শেষে মেয়ে ফিরে যায় তার বিদেশের ভার্সিটি জীবনে। শুরু হয় লেখাপড়ার ছকে বাঁধা জীবন। নতুন সেশনে রেজিস্ট্রেশন, ক্লাস রুটিন, নবতর ফ্যাকাল্টির সঙ্গে পরিচয়পর্বে ব্যস্ত সময় কাটে সারাদিন। সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফিরে দেখা মেলে ইতালীয় টরিন শহরের নীল চোখ আর সোনালি চুলের লাস্যময়ী মেয়ে ফ্রান্সিসকার সঙ্গে। টরিনের ছোট্ট আঞ্চলিক সাপ্তাহিকি পেরানদেল্লার সম্পাদকের মেয়ে ফ্রান্সিসকা। তার আচরণে মনেই হয় না সে ইতালীয়, বরং নদী তীরের কোনো লাজুক বাঙালি ললনার কথা মনে করিয়ে দেয় সে। গ্রাম থেকে বড় শহরে এসেছে যেন এসএসসি পরীক্ষা দিতে এই প্রথম! এমন সরলতার জন্যই নাবিলার সঙ্গে অল্পদিনেই গড়ে উঠে ফ্রান্সিসকার সখ্য। দিন তিনেক আগে ফিরে এলেও ফ্রান্সিসকাও সারাদিন ব্যস্ত ছিল দূরবর্তী ফ্যাকাল্টির একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজে। যে কারণে নাবিলার সঙ্গে সারাদিন তার সেল ফোনে কথা হলেও, দেখা হয়নি একটু আগেও। দু’জনেই রাতে সাক্ষাতের প্রতীক্ষায় ছিল, যখন বিনিময় হবে তাদের দু’জনের কেনা সিক্রেট উপহার। স্বদেশ ত্যাগের প্রাক্কালে ফ্রান্সিসকাও একটি দামি উপহার এনেছে নাবিলার জন্য সুদূর ইতালির রোম থেকে। রোমের বিশ্বখ্যাত মনোলোভা ফ্যাশনমল ভ্যালেনতিনো থেকে ফ্রান্সিসকা কিনেছে ফুলতোলা টি-শার্ট আর স্নো প্রুফ জ্যাকেট সেট নাবিলার জন্য। সারপ্রাইজ গিফট দেওয়ার জন্য দু’জনে সিক্রেট রেখেছে উপহারের নাম আর বর্ণনা। ডিনার শেষে নাবিলা বের করল প্রিয় বান্ধবী ফ্রান্সিসকার জন্য ঢাকার বসুন্ধরা সিটি থেকে মহাকষ্টে কেনা অ্যানটিক্সটি। র‌্যাপিং করা অ্যানটিক্স প্রদানের আগেই ফ্রান্সিসকা বের করল তার টি-শার্ট আর জ্যাকেট সেট। কথা হলো একসঙ্গে ৩-২-১ কাউন্ট ডাউন করে দু’জনে খুলবে তাদের র‌্যাপিং একসঙ্গে। প্যাকিং উন্মোচনের পর ফ্রান্সিসকা চোখ ফেরাতে পারল না ঢাকা থেকে নাবিলার আনা ক্রিস্টাল অ্যানটিক্স থেকে। নাবিলারও খুব পছন্দ হলো ইলিয়ানা প্রদত্ত টি-শার্ট ও জ্যাকেট সেটটি। মারাত্মক তুষারপাতেও জ্যাকেটটি ব্যবহার করতে পারবে নাবিলা, ভেবে মনে মনে পুলকিত হলো তার। পরম পছন্দে দু’জনে নাড়াচাড়া করার প্রাক্কালে নাবিলা চিৎকার করে উঠল বিস্ময়কর উল্লাসে, আরে টি-শার্ট আর জ্যাকেটে ভ্যালেনতিনো স্টিকার লাগানো থাকলেও, তাতে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এ যে বাংলাদেশের গ্রামীণ বস্ত্র বালিকাদের তৈরি আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টস সামগ্রী। নাবিলার উচ্ছ্বাসে ফ্রান্সিসকা কিছুটা হতচকিত হয়ে নিজের ক্রিস্টাল উপহারের নিচে খোদাই করা লেখাগুলো পড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো দ্বিগুণ উল্লাসে। আরে কি চমৎকার ব্যাপার, ঢাকা থেকে আনা তোমার উপহারটি তো ইতালির তৈরি। দামি এ ক্রিস্টাল অ্যানটিক্সগুলো তৈরি করেছে রোমের উপশহর ইদিভারের শ্রমজীবী নারী শিল্পীরা। এদের জীবন আর শিল্পকর্ম নিয়ে এর আগে আমি একটি ডকুমেন্টারি দেখেছি চ্যানেল ৪-এ। ক্রিস্টাল অ্যানটিক্সের নিচে স্পষ্ট ইতালীয় ভাষায় লেখা ‘ইদিভার-ইতালিয়ানো’। ভিনদেশি দুই তরুণী নিজ বাসভূম থেকে বহুদূরের কোনো এক ছোট্ট শহরে বরফঝরা শীতার্থ রাতে বিদেশি কর্তৃক প্রদত্ত নিজ দেশীয় উপহার হাতে পরম বিস্ময়ে চেয়ে থাকে একে অপরের দিকে। যে দেশ আর মাতৃভূমিকে চরমভাবে ভালোবেসেও জীবন বাস্তবতায় যারা তাকে ফেলে এসেছে যোজন যোজন দূরে, সে দেশ ঠিকই তাদের মনে রেখেছে পরম মমতায় মাতৃস্নেহে। তাই প্রাক্তন সোভিয়েতের উত্তর-পূর্ব সাইবেরীয় বরফ জমা এক নিস্তব্ধ শহরের নিঝুম রাতে বিশ্বের দুই প্রান্তিকের দুই তরুণীকে বিস্ময়করভাবে স্বদেশি উপহারে উদ্ভাসিত করে পরম মমতায়। যার ব্যাখ্যা হয়তো বস্তুবাদী সমাজে দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু উপহার হাতে ফ্রান্সিসকা আর নাবিলার চোখ যখন বাইরে তুষারপাতের মতো নোনা জলে ঝাপসা হয়, তখনও তারা বুঝতে পারে না এ কান্না আসলে কিসের! এটি কি ফেলে আসা মা-বাবা, স্বজন কিংবা নিজ মাতৃভূমি প্রদত্ত বিস্ময়কর স্বদেশি উপহারের জন্য? না কি বন্ধুত্বের এক অবর্ণনীয় মমতায়?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist