প্রবীর বিকাশ সরকার

  ২৬ মে, ২০১৭

কাজুও আজুমা : বাঙালির নিকট বন্ধু

কলকাতার প্রখ্যাত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বিদেশ ঘুরতে ঘুরতে একবার জাপানে এসেছিলেন। উঠেছিলেন ‘এশিয়া সেন্টার অব জাপানের চারতলার একটি কক্ষে। রাত তখন সাড়ে ১১টা। জিনিসপত্র গুছিয়ে সদ্য বিছানায় শুয়েছেন-এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। এত রাতে কে তাকে ফোন করতে পারে? কবি ভাবনায় পড়লেন, একমাত্র জাপান প্রবাসী বিকাশ বিশ্বাস ছাড়া তাকে আর কেউ চেনার কথা নয়। তিনি ফোন ধরতে ওদিক থেকে পরিষ্কার বাংলায় একজন বললেন, আমি কাজুও আজুমা বলছি। নীরেন্দ্রনাথ তার নামের সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু কোনো দিন কথা হয়নি। সরাসরি আজুমা বললেন, হোটেলে উঠেছেন কেন, অনর্থক পয়সা খরচ হবে। আমার বাসায় থাকতে কি আপনার অসুবিধে হবে? আবার ভাবনায় পড়লেন তিনি। হোটেলে চেক ইন করার সময় ২৬ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত থাকবেন বলে দিয়েছেন। এখন হঠাৎ করে তা কি বদল করা যাবে? গেলেও দ- তো দিতে হবে! তার সমস্যার কথা বুঝে শেষে একটা রফা হলো। প্রফেসর আজুমা বললেন, অন্তত শেষের দিনটা আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমি ৩০ তারিখ সকালে এসে আপনাকে নিয়ে যাব, তারপর ৩১ তারিখের সকালে আপনাকে হানেদা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেব।

৩০ তারিখ ভোর থেকেই প্রচ- বৃষ্টি। সঙ্গে ঝড়ো হওয়া। বৃষ্টি আর বাতাসের দাপটে জানালার সার্শি থর থর করে কাঁপছে-এমন বর্ষণ বঙ্গভূমির বাইরে আর কোথাও তিনি দেখেননি। তার ভয় হলো আজুমাসান আসতে পারবেন কি না! আবার ভাবনায় পড়লেন। কেননা এশিয়া সেন্টারে আজ আর থাকার উপায় নেই, প্রফেসর আজুমা গতকালকে ম্যানেজারকে বলে দিয়েছেন, তিরিশ তারিখ সকালে নীরেন্দ্রনাথ এই আশ্রয় ছেড়ে দেবেন। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বিকাশবাবুর বাসায় ফোন করতেই তার স্ত্রী শ্রীমতি মালা বললেন, কিছু ঘাবড়াবেন না নীরেনদা। আজুমাসানকে আপনি চেনেন না। বৃষ্টি তো বৃষ্টি, প্লাবন কিংবা ভূমিকম্প হলেও তার কথার নড়চড় হবে না। ন’টায় যখন বলেছেন তখন ন’টা বেজে এক মিনিট হবারও জো নেই, একেবারে কাটায় কাটায় ন’টায় তিনি হোটেলে হাজিরা দেবেন।

আসলেও তাই। প্রফেসর আজুমা সাড়ে আটটায় এসে লবিতে বসে আছেন। তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে টোকিও স্টেশনের লকারে মালামাল জমা রেখে ঘুরতে বেরোলেন। একটি রেস্তোরাঁয় বসে কথাবার্তা বললেন। কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে প্রফেসর আজুমা বললেন, দেখুন, আমি যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলুম, সেটা নেহাত চাকরি করতে নয়। গিয়েছিলুম এ জন্য যে, আপনাদের দেশকে আমি ভালোবাসি। শুধু আমি বলেই বা কথা কী, জাপানে আপনি এমন বিস্তর লোক পাবেন, শাক্যমুনির ভারতবর্ষ সম্পর্কে যাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অন্ত নেই। শাক্যমুনি আমাদের আত্মিক ক্ষুধার খোরাক জুগিয়েছিলেন। একালে আর একজন মহামানব সেই ক্ষুধা নিবৃত্তির সন্ধান দিয়েছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তার সাহিত্য আমি পাঠ করেছি। না, তর্জমায় নয়, তারই আপন ভাষায়। তাকে ভালোবেসে তার ভাষাকেও আমি ভালোবেসেছি। আবার বললেন, জানেন, এই টোকিও শহরেই এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত অল্প নয়, গুরুদেবের সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য যাদের হয়েছিল। তাদের অনেকে শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলেন। কেউ পড়তে, কেউ পড়াতে। তাছাড়া, কিছু তরুণ রবীন্দ্রভক্তেরও আমরা দেখা পাচ্ছি। প্রবীণ ও নবীনদের নিয়ে একটি সমিতিও গড়ে তুলেছি আমরা। তার নাম দিয়েছি ‘ভারত-জাপান ঠাকুর সমিতি’। উদ্দেশ্য রবীন্দ্রচর্চা। ফি মাসে আমাদের সভা হয়, তাতে রবীন্দ্রসাহিত্য আর রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে আলোচনা নেহাত কম হয় না।’ কথায় কথায় শান্তিনিকেতনে নিপ্পন-ভবন প্রতিষ্ঠার কথাও জানালেন।

বিকেল ৩টার দিকে টোকিওর কোমিয়োজি বৌদ্ধ মন্দিরে একটি পুনর্মিলনের আয়োজনও প্রফেসর করে রেখেছিলেন। সেখানে নীরেন্দ্রনাথের সম্মানে আলোচনা, নৃত্য-গীতেরও ব্যবস্থা ছিল। তিনি মেয়েদের কণ্ঠে নির্ভুল রবীন্দ্রসংগীত শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন!

রাতে আজুমাসানের বাসায় ছিলেন। যাকে তিনি বর্ণনা করেছেন কলকাতার কোনো বাঙালি পরিবারের সংসার বলে। প্রফেসর, তার স্ত্রী এবং মেয়েরা পর্যন্ত অনর্গল বাংলা বলছেন। আপ্যায়ন করেছেন বাঙালি রীতিতে। নীরেন্দ্রনাথ অভিভূত হয়ে লিখেছেন, বৈঠকখানায় কোনো সোফা-কৌচের আড়ম্বর ছিল না, শয়নকক্ষেও খাট-পালঙ্কের ঝঞ্জাট নেই। নিরহঙ্কার গৃহরুচি। কাঠের মেঝে। সেই মেঝে জুড়ে মিহি জাপানি মাদুর পাতা। তার উপরে পাশাপাশি দুটি শয্যা রচনা করা হয়েছে। একটি তার ও অন্যটি প্রফেসরের। পরদিন যথাসময়ে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছিলেন আজুমাসান।

শুধু কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নন। কলকাতা এবং বাংলাদেশের যাদের নাম তিনি জানেন বা চেনেন তারা কেউ জাপানে যেভাবেই আসুন না কেন তা তিনি জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়ে আপ্যায়ন না করা পর্যন্ত তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন না। যা প্রবাসে কোন বাঙালির পক্ষেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিগত ৪০ বছরেরও অধিককাল ধরে অনেক বাঙালি তার আমন্ত্রণে জাপান সফর করেছেন। কয়েকটি বাঙালি-জাপানি বিয়েরও ঘটকালি করেছেন তিনি।

প্রফেসর আজুমার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৮৯ সালের দিকে। তখন আমি বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। বাংলাদেশের জাতীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সোসাইটি। তাতে আমন্ত্রিত দশর্ক হিসেবে আজুমা স্যার, ‘আপনারা বেইমান! আপনারা বাঙালি নন! বঙ্গবন্ধু কী অপরাধ করেছিল যে তাকে খুন করেছেন!’ ইত্যাদি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন। আমরা বিব্রতবোধ করলেও গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলাম, আজমু স্যার সত্যিই বাঙালিকে ভালোবাসেন শুধু নয়-তিনি সত্যিকার অর্থেই বাঙালিতে পরিণত হয়েছেন! বঙ্গবন্ধুর জন্য যে তাঁর গভীর টান ছিল তাও বুঝতে বিলম্ব হয়নি। পরে জেনেছিলাম ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন জাপান সরকারের আমন্ত্রণে জাপান সফর করছিলেন তখন তিনি তাঁর দোভাষী এবং সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের কাজ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে তিনি যে দারুণ শোকাভিভূত হয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। সেই শোক তার কোনোদিনই কাটেনি।

বাঙালিকে কেন তিনি এত ভালোবেসেছিলেন? কেন সমস্ত জীবনব্যাপী বাংলাকে ভালোবেসে কাটিয়ে দিলেন? তার পেছনে রয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একমাত্র কবিগুরুর জন্যই তিনি বাংলা ভাষার প্রেমে পড়ে গেলেন। শুধু তিনি একাই নন, তার সহধর্মিণী কেইকো আজুমা পর্যন্ত বাংলা ভাষা বলতে অন্তঃপ্রাণ। দুজনেই অনর্গল বাংলা বলতে, পড়তে এবং লিখতে শিখেছিলেন। প্রফেসর আজুমার বাসায় ছিল রবীন্দ্রনাথ রচিত গ্রন্থ ছাড়াও এ বিষয়ক অসংখ্য পত্রপত্রিকা। সব মিলিয়ে যা সংখ্যা হবে প্রায় দশ হাজার। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ছবি এবং গানের রেকর্ড, ক্যাসেট কত কি-সে এক জাদুঘর প্রায়। বাড়ির নিচ তলায় সেসব গ্রন্থের পাশাপাশি একটি গ্রন্থাগারই গড়ে তুলেছিলেন শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত গ্রন্থ, সাময়িকী ও দলিলপত্রাদি দিয়ে। স্থান সংকুলান হয় না বলে বহু গ্রন্থ বাক্সে ভরে শ্বশুরের বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে আলাদা বসবাস করছিল। ফলে বাড়িতে তখন তারা মাত্র দুজন। তাও কি বছরের বেশির ভাগ সময়ই কলকাতা, শান্তিনিকেতনে কাটাতেন নানা কাজে। তার জন্মদিনগুলো সেখানে পালিত হতো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে।

১৯৯৮-২০০০ সালের দিকে সত্তর পেরিয়েছেন। আগস্ট মাসে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার কারণে জাপান সরকারের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকায় আর যাওয়া হয়নি। তবে আগস্ট মাসের ১৭ তারিখ থেকে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত আমেরিকা, জাপান, ভারত ও বাংলাদেশের সংগীত সম্মেলেন জাপানের প্রতিনিধি হয়ে সরকারিভাবে সন্ত্রীক যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ছুটি পাননি। যেতে পারলে মনের আশ মিটত অনেকটা। কেননা সেখানে বাঙালির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটত। কেন এই বাঙালি প্রীতি, বাংলা অন্তঃপ্রাণ! তার আড়ালে রয়েছে অনেক অজানা ইতিহাস। বাংলা-ভারত-জাপান এই তিনটি অঞ্চলের সেতুবন্ধনের প্রতীক তিনি একদিনে হননি। ব্যয় করেছেন সুদীর্ঘ সময়। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, যতই বাঙালির ঘনিষ্ঠ হয়েছেন ততই বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি-মনস্তত্ব তার সামনে উন্মুক্ত হয়েছে। এ সমস্ত গবেষণা, মেলামেশা আর ভাবের বিনিময়গুলোকে সযতেœ বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রবন্ধে, নিবন্ধে এবং গ্রন্থাকারে লিপিবন্ধ করেছেন। গ্রন্থের সংখ্যাই হবে ১২১টি, অনুবাদের সংখ্যা ত্রিশের ওপর। এসব রচনা বাংলা, ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় রচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এগুলো অমূল্য সম্পদ। এই বিশাল সম্পদ যে তিনি সৃষ্টি করে গেলেন আমাদের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তার পেছনে মূল উদ্দীপনা হিসেবে একটি ব্যক্তিত্বই কাজ করেছে তিনি রবীন্দ্রনাথ।

কাজুও আজুমার জন্ম টোকিওতে ১৯৩১ সালের ১৪ আগস্ট। ‘আজুমা’ দুটি কানজি অক্ষরের একটি যুথিবদ্ধ শব্দ। যার অর্থ ‘আমার স্ত্রী’। জাপানিরা এই পদবি শুনলেই মুচকি হাসেন। প্রাথমিক শিক্ষা চিবা-প্রদেশের ইচিকাওয়া শহরে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বৈত এমএ জার্মান ভাষা ও সাহিত্য এবং ভারতীয় দর্শন বিষয়ে।

ছোটবেলা থেকে প্রকৃতির সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। সাঁতার কাটতেন, মাছ ধরতেন, গাছে উঠতেন, দূরে দূরে হেঁটে বেড়াতেন। তখন শহর তেমন গড়ে ওঠেনি। বাড়ি ছিল রাজধানী টোকিও শহর থেকে বেশ দূরে। গ্রাম না হলেও গ্রামের মতো। পাশে ছিল নদী। টোকিওর ‘এদো’ নদী ছিল তাঁর বাড়ির খুব কাছে। একশ’ বছর আগেও টোকিওকে লোকে ‘এদো’ বলত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত খুব ভালো সময় কেটেছে। যুদ্ধের পর এলো খুব খারাপ সময়। রাজধানী টোকিও শহর সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছিল। তার প্রভাব আশপাশের উপশহরেও পড়েছে। যুদ্ধে বহু লোক মারা গেছে। অনেকের যক্ষ্মা রোগ হয়েছিল। তারও হয়েছিল। প্রায় প্রতিদিন মুখ দিয়ে রক্ত বের হতো। একটি দিনের কথা আমাকে বলেছিলেন যা কোনোদিন বিস্মৃত হননি : ‘১৯৪৫ সালের ১০ মার্চ। তখন তার বয়স ১৪ বছর। আমেরিকার সাড়ে ৩ ঘণ্টার বোমাবর্ষণে টোকিও শহরেই প্রায় এক লাখ লোক তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। আজুমাদের স্কুলে বোমা পড়ে। আগুনে আর ধোঁয়ায় প্রায় শতাধিক ছাত্র মারা যায়। চারদিকে অভাব আর অভাব। চাল ছিল না, গম ছিল না, নুন ছিল না। কী নিদারুণ কষ্টেই না আমরা দিন কাটিয়েছি, পড়ালেখা করেছি। এখন তা ভাবলে আশ্চর্য লাগে!’

কাজুও আজুমার শিক্ষাগুরু ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ভারততত্ত্ববিদ, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের অধ্যাপক হাজিমে নাকামুরা (১৯১২-১৯৯৯)। তার পরামর্শে ভারতীয় দর্শন নিয়ে পড়ালেখা করেন। গবেষণা সন্দর্ভ লিখেন প্রখ্যাত জার্মান লেখক হারমেন হেসের সিদ্ধার্থ উপন্যাসের ওপর। এই উপন্যাসের ওপর কাজ করতে গিয়ে ভারতবর্ষ তাকে আকর্ষণ করে। তার মতে, ভারতীয় দর্শন না পড়লে কিছুই শিখতে পারতেন না। ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথের লেখা ইংরেজি থেকে জাপানি ভাষায় অনূদিত গীতাঞ্জলি, ডাকঘর, রক্তকরবী পড়ে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মে। ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষায় রবীন্দ্রসাহিত্য পড়তে শুরু করেন। জাপানে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের সময় ‘আপোলন প্রকাশনী সংস্থা’ রবীন্দ্ররচনাবলির সাতটি নির্বাচিত খন্ড প্রকাশ করে। তার মধ্যে তিনি রবীন্দ্রনাথের চবৎংড়হধষরঃু গ্রন্থটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে জাপানিদের উপহার দেন। তারপর মূল বাংলা ভাষায় লেখা রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রকৃত রস আস্বাদনের উদ্দেশ্যে বাংলা শেখার আগ্রহ তার অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে। দুঃখের বিষয় তখন জাপানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল না। সেজন্য টোকিও প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি ছাত্রদের কাছে বাংলা শিখতে আরম্ভ করেন। আর তাদের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে পত্রালাপের মাধ্যমে বাংলা ভাষার জটিল বিষয়গুলো সমাধানে সক্ষম হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সপ্তাহ নামক গ্রন্থটি তিনি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী আমেরিকা যাওয়া ও ফেরার পথে জাপানে এলে অধ্যাপক আজুমা ও সহপাঠীরা মিলে তার আগমন উপলক্ষে অভ্যর্থনা ও সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন। অন্যদিকে ভারতের চলন্তিকা অভিধানের পরিশিষ্টের বাংলা ব্যাকরণটিও জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তখন জাপানের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলি সংগ্রহ করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। অনেক চেষ্টায় আড়াই বছর পর যখন ওই রচনাবলি তার হাতে এলো তা পেয়ে তিনি যে কী গভীর আনন্দ অনুভব করেছিলেন তার ব্যাখ্যা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয় বলে হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলেন।

জানার আগ্রহ তাকে এতই উদ্দীপ্ত করেছিল যে, তিনি যোগাযোগ করেন জাপানের প্রবীণ পন্ডিত শোওকোও ওয়াতানাবের সঙ্গে। ড. ওয়াতানাবে সংস্কৃত, পালি, চীনা, গ্রিক, রুশ, ইংরেজি, ফরাসি, বাংলা এবং আরও কিছু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনিই ১৯৬১ সালে প্রথম রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি মূল বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন। যেহেতু বাংলা ভাষায় তার অগাধ বুৎপত্তি ছিল তাই গীতাঞ্জলির প্রকৃত অনুবাদ তার পক্ষেই যথার্থভাবে সম্ভব হয়েছিল। তার আগেও ১৯১৫ সাল থেকে আরও দশবার গীতাঞ্জলি জাপানি ভাষায় ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে কিন্তু জনপ্রিয়তা পায়নি। আজুমা ড. ওয়াতানাবের কাছেও বাংলা শিখেন। প্রফেসর ওয়াতানাবে তাকে বলেন, ‘তোমরা রবীন্দ্রসাহিত্য মূল বাংলা ভাষায় পড়বে। তাহলে আরও ভালো জানতে পারবে।’ তার কাছে রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠের রেকর্ড ‘হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে জাগো রে ধীরে/এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ...’ কবিতাটি শুনে আজুমা রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ছন্দের প্রতি আরও আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি সোৎসাহে রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয়, চন্ডালিকা, নটীর পূজা, মুক্তধারা ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন।

এই সময় তিনি য়োকোহামা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। হঠাৎ করে তার গুরু হাজিমে নাকামুরার মাধ্যমে বিশ্বভারতীর জাপানি বিভাগে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রণ পান। তখন একই সঙ্গে জার্মানি থেকেও আমন্ত্রণ আসে। ভারতে যাওয়ার চেয়ে তার পক্ষে জার্মান যাওয়া ছিল সহজ এবং আর্থিক দিক দিয়েও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কেননা, তখন তিনি জার্মান ভাষা পড়াচ্ছিলেন। অতএব ভারতে বেশিদিন থাকলে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি এক বছরের জন্য বিশ্বভারতীতেই যাওয়ার সঙ্কল্প করেন।

জাপানে থাকাকালে তার পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ওপর বইপত্র পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। রবীন্দ্ররচনাবলির কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে ওখানে বিশেষ আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণেই তিনি সবকিছু ছেড়ে ১৯৬৭ সালে ৩৬ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে ছুটে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার মনে কোনো প্রশ্ন এলেই সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞদের কাছে উপস্থিত হতেন। তারাও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তার সমাধান করে দিতেন। এদের মধ্যে প্রবোধচন্দ্র সেন, ভূদেব চৌধুরী ও সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেন। সেখানে ড. পুলিনবিহারী সেন, শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, কানাই সামন্ত, চিত্তরঞ্জন দেব ও শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় সবাই গবেষণার কাজ করতেন। জাপানে এসব কাজের কথা কল্পনাও করা যেত না। সেজন্যই ভারতে মাত্র এক বছরের জন্য গেলেও সাড়ে তিন বছরের মতো ছিলেন। শান্তিনিকেতনের নিরিবিলি ও মুক্ত হাওয়ায় আনন্দচিত্তে সময় কাটিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে তার জীবনযাপন সম্পর্কে তারই বন্ধুপ্রতিম কলকাতার বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভার মুখপত্র জগজ্যোতির সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরী লিখেছেন : ‘বিশ্বভারতীতে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এখানকার অধ্যাপকমন্ডলী পেলেন এমন একজন সুহৃদকে, যিনি সময় নষ্ট করেন না, পরচর্চা করেন না, দুপুরে ঘুমোন না, যার অভিধানে বিশ্রাম ও আলস্য শব্দ দুটি নেই এবং যিনি প্রকৃতপক্ষে এক আদর্শ বিদ্যানুরাগী, সজ্জন, পন্ডিত, রবীন্দ্রঅন্ত মানুষ।

‘১৯৬৮ সালটি জাপানের ইতিহাসে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন জাপানের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯-১৯৭২)। প্রাচ্যে রবীন্দ্রনাথের পরেই কাওয়াবাতা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তার ইউকিগুনি (বরফের দেশ) উপন্যাসটির জন্য। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কাওয়াবাতার নাম খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার আবির্ভাব সমকালীন সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শোওয়া যুগ (১৯২৬-১৯৮৯) থেকেই জাপানে বামপন্থী সাহিত্যচর্চার অনুকূল হাওয়া বইতে শুরু করে। বামপন্থী লেখকরা ‘নয়া জাপানি সাহিত্য’ নামক পত্রিকার ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হন। এর বিপরীতে ছিল ‘১৩ জনের ক্লাব’। এই ক্লাবের লেখকরা ছকে বাঁধা জীবনচেতনার বাইরে মানুষের জীবনের গহীন প্রদেশে ডুব দিলেন। এই গোষ্ঠীরই উল্লেখযোগ্য নাম ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা। তিনি ইউকিগুনি লেখা শুরু করেন ১৯৩৪ সাল থেকে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় যুদ্ধের পর এবং ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ১৯৬৭ সালে। এই উপন্যাসে কাওয়াবাতা প্রাচীন হাইকু কাব্যরীতিই অনুসরণ করেছেন। তার সংলাপ কাব্যধর্মী, সংক্ষিপ্ত।’ এভাবে প্রফেসর আজুমা কাওয়াবাতা ইয়াসুনারির ওপর একটি প্রবন্ধ কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ কাগজে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের সহযোগিতায় ‘প্রাচ্য ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা’ নামে প্রকাশ করেন ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে। এটিই বাংলা ভাষায় এবং বঙ্গদেশে প্রকাশিত প্রফেসর কাজুও আজুমার প্রথম রচনা। এ লেখার মাধ্যমেই আজুমা এই নামের সঙ্গে বাঙালি পাঠক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এই লেখাটি তৎকালীন সাপ্তাহিক দেশ-এ প্রকাশের পর সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আজুমাকে অনুরোধ করেন কাওয়াবাতার একটি উপন্যাস অনুবাদ করার জন্য। তবে উপন্যাসটি এমন হতে হবে যা পৃথিবীর আর অন্য কোনো ভাষায় অনূদিত হয়নি। বাংলা ভাষায়ই প্রথম হবে। প্রফেসর আজুমা যোগাযোগ করলেন কাওয়াবাতার সঙ্গে। কাওয়াবাতার অনুমোদন ও নির্দেশে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যসহ যৌথভাবে তারা অনুবাদ করতে লাগলেন কাওয়াবাতার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস নিজি বা রংধনু। ১৯৬৯ সালের জুন মাস থেকে দেশ পত্রিকায় ‘ইন্দ্রধনু’ নামে প্রকাশিত হতে লাগল। পরে এটি কাওয়াবাতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কলকাতার মডেল পাবলিশিং হাউস কর্তৃপক্ষ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে এক সুন্দর নজির সৃষ্টি করেন।

নীরব কর্মকুশলী প্রফেসর আজুমা শান্তিনিকেতনে থাকাকালে সবাইকে যেমন আপন করে নিতে পেরেছিলেন তেমনি সবার কাছে তিনি ও তার পরিবারের প্রতিটি সদস্য আপনজন বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। আত্মার আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি হয় তিনি সেখানে থাকাকালে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। যেমন প্রবোধচন্দ্র সেন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, পুলিনবিহারী সেন, শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নিমাইসাধন বসু, ধর্মপাল মহাথের, রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ। এদের অনেকেই পরে তার আমন্ত্রণে জাপান এসেছিলেন। গ্রহণ করেছেন নিরহঙ্কার, সর্বদা সুহাসিনী কেইকো আজুমার হাতের বাঙালি আতিথেয়তা। যা কখনো ভোলার নয়। উল্লেখ্য, প্রফেসর আজুমার সহধর্মিণী শ্রীমতি কেইকো চিবা প্রদেশের এক বৌদ্ধ পুরোহিত পরিবারের মেয়ে। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা দুজনে ছিলেন সহপাঠী। তিনি ভারতীয় দর্শনে এমএ। তার সন্দর্ভের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্য। প্রফেসর আজুমার সুযোগ্যা সহধর্মিণী হিসেবে যে ভূমিকা রেখেছেন স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত তা এক কথায় জাপানি সমাজে অনন্য সাধারণ ঘটনা। দুজনেই বাঙালি সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতিকে এমনভাবে অন্তরে গ্রহণ করেছেন যা সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়: তাঁরা পূর্বজন্মে যেন বাঙালি ছিলেন!

অক্লান্ত পরিশ্রমী, নিরহঙ্কার এবং অত্যন্ত সহজ সরল চরিত্রের অধিকারী অধ্যাপক কাজুও আজুমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথের এই পংক্তিগুলো:

কত অজানারে জানাইলে তুমি

কত ঘরে দিলে ঠাঁই

দূরকে করিলে নিকট বন্ধু

পরকে করিলে ভাই।

২০১১ সালের ২৮ জুলাই বাঙালি জাতির এই বিরলতম শুভাকাক্সক্ষীর তিরোধান ঘটে ৭৯ বছর বয়সে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কলকাতায় এক সংবর্ধনা সভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘যদি আবার জন্মলাভ করি, তাহলে বাঙালি হয়ে জন্মাতে চাই।’

জাপান প্রবাসী লেখক, গবেষক এবং

মাসিক কিশোরচিত্র সম্পাদক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist