মোকারম হোসেন

  ২৬ মে, ২০১৭

আমাদের বৃক্ষবৈচিত্র্য : নতুন ভাবনা

প্রাকৃতিক নিয়মে তরুপ্রজাতি প্রতিনিয়তই স্থান বদলায়। সুদূর আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকার কোনো গাছ আমাদের দেশে এসেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। আবার আমাদের অঞ্চলের কোনো গাছ অস্ট্রেলিয়ায় প্রাকৃতিক বৃক্ষ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এ কারণেই গাছপালাকে নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করা যায় না। সমগ্র পৃথিবী তার আবাসস্থল। তাই সবধরনের গাছপালাকেই সমগুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখতে হয়। নানাভাবে আমাদের দেশে এসে থিতু হওয়া বিদেশি গাছগুলোকে দেশি নাম দিয়ে বরণ করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বিভিন্ন শ্রুতিমধুর নাম দিয়ে অনেক বিদেশি গাছপালাকে আপন করে নিয়েছেন। পেট্টিয়া’র নাম রেখেছেন নীলমণিলতা, রেঙ্গুনক্রিপারের নাম মধুমঞ্জরি লতা, মিলিংটোনিয়ার নাম হিমঝুরি। এমন আরও কিছু গাছকে তিনি বাংলা নাম দিয়ে আদৃত করেছেন। কিন্তু তারপর এক বিরাট শূন্যতা! বছরের পর বছর ধরে অনেক বিদেশি গাছ আমাদের দেশে এসে থিতু হয়েছে, অথচ তাদের কোনো বাংলা নাম নেই। ফলে শুরু হয়েছে বিভ্রান্তি। একেকজন একক নামে চেনেন। এই সুযোগে গাছ বিক্রেতারাও রাতারাতি নামের কারিগর সেজে বসেছে। ক্রেতাদের সামনে ভুল-ভাল নামে উপস্থাপন করছে বিভিন্ন বিদেশি গাছ। এসব বিদেশি গাছপালা সংখ্যায় নেহায়েৎ কম নয়। এমন কয়েকটি বিদেশি গাছের নাম এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না; আফ্রিকান টিউলিপ, গ্লিরিসিডিয়া, মিলেশিয়া, জ্যাকারান্ডা, ক্রেব/ফুরুস, কমব্রেটামলতা, অ্যালমান্ডা, ইউক্যালিপটাস, ইপিল ইপিল, ব্রনফেলসিয়া, অ্যারোকেরিয়া, ক্যাশিয়া সায়ামিয়া, ক্যাশিয়া জাভানিকা, ক্যামেলিয়া, গুস্তাভিয়া, গোল্ডেন শাওয়ার, গ্ল্যাডিওলাস, ট্যাবেবুইয়া, ট্রাম্পিট লতা, পেটুনিয়া, পেল্টোফরাম টেরোকার্পাম, বটলব্রাশ, মানিপ্ল্যান্ট, ল্যান্টানা, সাইকাস, স্কারলেট কর্ডিয়া ইত্যাদি। দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানী, নিসর্গী, কবি, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে নামকরণের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এই উদ্যোগটি নিতে পারে বাংলা একাডেমি। তাহলে বিদেশি গাছের নাম নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না।

২.

বোটানিক্যাল গার্ডেন কি ও কেন?-এর ব্যাখ্যা অনেক বিশাল এবং ব্যাপক। সে প্রসঙ্গে যাব না। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি; বোটানিক্যাল গার্ডেন কোনো সম্পূর্ণ বিনোদন উদ্যান নয়। তাছাড়া এর জন্মও কিন্তু বিনোদনের উদ্দেশ্যে নয়। যে দেশে মানুষ এখনো নির্বিচারে গাছ কাটে, নদী ভরাট করে, খাল দখল করে, বন উজাড় করে সে দেশের মানুষ বোটানিক্যাল গার্ডেনে কি শুধু গাছপালা দেখতে যায়? এমন ভাবনা অবান্তর। মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলে এ কথা বারবারই মনে হবে। সেখানে যারা বেড়াতে যান তাদের শতকরা কতজন গাছপালা বা নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে যান? শতকরা তো দূরের কথা, প্রতি হাজারেও এমন একজন খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। একটি জাতীয় উদ্ভিদউদ্যানের সঙ্গে নানা কিছু সম্পর্কিত। আজকাল উদ্যান মানে শুধু বৃক্ষশালা নয়; হার্বেরিয়াম, গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, জাদুঘর ইত্যাদি নিয়েই পূর্ণাঙ্গ উদ্যান। সেখানে শুধু উপস্থাপনই নয়, নতুন নতুন উদ্ভাবনও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যদি আমাদের আবাদিত নতুন নতুন জাত উপহার না দিতে পারে তাহলে এখানকার আঞ্চলিক বৃক্ষাদির উৎকর্ষ সাধনের দায়িত্ব কে নেবে? কিন্তু এতসব কাজের কাজ রেখে প্রতিষ্ঠানটি একটি বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আমরা জানি, বিনোদন মূল্য বোটানিক্যাল গার্ডেনের পূর্বশর্ত নয়। এক্ষেত্রে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বিদেশি প্রজাতির যথাযথ সংরক্ষণ প্রধান কাজ। এখানে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতি হচ্ছে হার্বেরিয়াম ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে একটি দীর্ঘ দেয়াল। অথচ হার্বেরিয়াম বোটানিক্যাল গার্ডেনেরই অংশ। কিন্তু আমাদের দেশে যেন চির বৈরী দুটি প্রতিষ্ঠান। নিয়ম অনুযায়ী, বোটানিক্যাল গার্ডেনের সঙ্গে একটি জাদুঘর থাকার কথা। যেখানে সজ্জিত থাকবে আমাদের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদপ্রজাতিসহ অন্যান্য সংগ্রহের নমুনা। একজন সাধারণ মানুষ যেন অতি সহজেই তার কাক্সিক্ষত গাছটি দেখে শনাক্ত করতে পারেন। বোটানিক্যাল গার্ডেনকে সার্বজনীন ও সহজলভ্য করতে এবং কেন্দ্রীয় উদ্যানকে কিছুটা নির্ভার করতে স্থানীয় উদ্ভিদপ্রজাতি নিয়ে আঞ্চলিক বোটানিক্যাল গার্ডেন বানানো যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৬টি বিভাগীয় শহরে স্থানীয়ভাবে বেটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তোলা যায়। এ ধরনের উদ্যানে একদিকে স্থানীয় প্রজাতিগুলো সংরক্ষণের সুযোগ থাকে অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও বোটানিক গার্ডেন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই অসংখ্য আঞ্চলিক উদ্যান রয়েছে। তার কোনো কোনোটি বিশেষ কারণে সুখ্যাত।

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের কাজ হচ্ছে দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে জন্মানো গাছপালা সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করা। সংরক্ষণ পদ্ধতিটি অবশ্যই বৈজ্ঞানিক হবে, যাতে একজন সাধারণ মানুষও যেন অতি সহজেই গাছপালার নাম-পরিচয় জানতে পারে। তবে গাছপালা কিংবা প্রাণিকূল যেহেতু ভৌগোলিক সীমারেখা মানে না, সেহেতু বিদেশি গাছপালাও গবেষণার কাজে স্থান পেতে পারে। তাতে উদ্যানের সংগ্রহ সমৃদ্ধ হবে। সবাই জানতে পারবে বিশ্বের অপরাপর আবহাওয়ায় কোন ধরনের গাছপালা জন্মে। সার্বিক অর্থে বোটানিক্যাল গার্ডেন অপরাপর বাগান ও পার্ক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত প্রজাতি সংরক্ষণ, শিক্ষা, গবেষণা, বিনোদন ও পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু। অন্তত কেন্দ্রীয় বোটানিক গার্ডেনটি এভাবেই হওয়া উচিত। নির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথ নকশা অনুসরণ করে যাবতীয় কর্মকা- সুসম্পন্ন করলে তার ফল সুদূরপ্রসারী হয়। কাজেই আমাদের ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেনটিকে শুধু পার্ক হিসেবে বিবেচনা না করে এর যাবতীয় চাহিদাগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্যানের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সংরক্ষিত রাখা প্রয়োজন। যা শুধু গবেষক ও শিক্ষার্থী ব্যতীত অন্যদের জন্য দুষ্প্রবেশ্য থাকবে। গাছের পরিচিতিমূলক নামফলক অবশ্যই থাকতে হবে। নামফলকগুলো কোনো অবস্থাতেই তারকাঁটার সাহায্যে লাগানো যাবে না। এ কাজে ব্যবহার করতে হবে কোমল ধরনের তার। উন্নতমানের বোটানিক গার্ডেনে নামফলকগুলো গাছের পাশে একটি স্বতন্ত্র খুঁটিতে পুঁতে রাখা হয়। আমাদের দেশের জন্য সুবিধাজনক না হলেও এটাই একমাত্র উত্তম পদ্ধতি। সরকারকে মনে রাখতে হবে, বোটানিক গার্ডেন প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক লাভালাভের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, এর ফল সর্বদাই অদৃশ্য, চলমান ও সুদূরপ্রসারী।

৩.

আপনি একবার কল্পনায় ভেবে দেখুন। আপনার চোখের সামনে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথ। তার দু’পাশে থরে থরে সাজানো জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া। বিন্যাসটা এমন যে প্রথমে কৃষ্ণচূড়া, তারপর সোনালু, সোনালুর পর জারুল; এভাবেই তৈরি করা হয়েছে তিন রঙের সুসজ্জিত বীথি। জারুলের রঙ উজ্জ্বল বেগুনি, সোনালুর রঙ হলুদ, সোনালি আর কৃষ্ণচূড়ার প্রধান রঙ টকটকে লাল। এমন সৌন্দর্য থেকে কি চোখ ফেরানো যায়? চোখটা সরিয়ে নিলেও মনটা কিন্তু পড়েই থাকবে সেখানে। আর সেখানেই যদি হয় আমাদের পুষ্প উৎসব, তাহলে কেমন হয়। আমরা এমন একটি পুষ্প উৎসবের স্বপ্ন দেখছি দীর্ঘদিন। এমন একটি স্বপ্ন দেখা কি অবান্তর কারণ গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে ছড়ানো থাকে যাবতীয় উন্মাদনার রঙ। কৃষ্ণচূড়ার রঙ পাগল করা। অনেকদূর থেকেই তার উজ্জ্বল রঙ আমাদের উতলা করে। জাপানে শুধু চেরি ফুল ফোটার মৌসুমে ওরা প্রতিবছর মস্তবড় উৎসব করে। ওদের একটিই তো ফুল; আর আমাদের আমাদের বৃক্ষবৈচিত্র্য : নতুন ভাবনা

তিন তিনটি প্রধান ফুল। তাহলে কেন আমরা বঞ্চিত হচ্ছি এমন একটি নান্দনিক উৎসব থেকে। আমাদের দেশে এই ধরনের একটি অ্যাভিনিউ তৈরি করা কি খুব ব্যয়বহুল? মোটেই না, অতি সহজ। আমাদের অনেক সড়ক আছে, যার দু’পাশ এখনো বৃক্ষ ও ছায়াহীন। এমন একটি সড়কই বেছে নিতে পারি। হতে পারে ঢাকার অদূরে কিংবা অনেক দূরে। আবার নতুন কোনো সড়কও হতে পারে। পর্যায়ক্রমে রেল সড়কের পাশেও এমন বর্ণচ্ছটা তৈরি করা যেতে পারে। এমন একটি পুষ্প বিন্যস্ত পথকে ঘিরে প্রাথমিক পর্যায়ে উৎসবটি হতে পারে দু’দিনব্যাপী।

কোনো জাতীয় উৎসব মানেই সম্প্রীতির মেলবন্ধন। আর পুষ্প উৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই সম্প্রীতি ও সৌহার্দের সেতুবন্ধন আরও অটুট হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃতির প্রতি আমাদের দরদ যেমন বাড়বে তেমনি ভাবনার পরিধি আরও বিস্তৃৃত হবে।

লেখক : প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক তরুপল্লব

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist