নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৫ মে, ২০১৭

টেকসই কৃষি উন্নয়নে খামার যান্ত্রিকীকরণ

দেশে প্রতিবছর গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রায় ১৪ শতাংশ শস্য বিনষ্ট হয়, যার পরিমাণ ৪৯ লাখ টন। খামার যান্ত্রিকীকরণ করা গেলে সেটি কমিয়ে ৫ শতাংশে আনা সম্ভব। এতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার শস্য অপচয় রোধ করা যাবে। এ ব্যাপারে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির বক্তব্য হলো-গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের উৎপাদনের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। শস্য উৎপাদনের পর নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদনে বড় ধরনের ফারাক তৈরি হচ্ছে। এসব দূর করতে খামার যান্ত্রিকীকরণ করার কোনো বিকল্প নেই। তবে সরকারের একার পক্ষে সারা দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিস্তার ঘটানো সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থা একযোগে কাজ করলে স্বল্পসময়ে এর সুফল পাবে কৃষক। খামার ‘যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে খামার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে সরকার। ফলে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, টেকসই কৃষি উন্নয়ন, কৃষকপর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, শস্য নিবিড়তা বাড়ানো, শস্য অপচয় কমানো এবং কৃষকদের সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। উৎপাদন পর্যায় থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত যাতে শস্য নষ্ট না হয়, ফলন হ্রাস না পায় সেজন্য খামার যান্ত্রিকীকরণের এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য হাতে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প। এতে ৫০টি জেলার ২০০ উপজেলায় ৩২ হাজার খামারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ১ থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার শস্য অপচয় রোধ হবে। একই সঙ্গে ১৩ হাজার স্থানে কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও খামার যন্ত্রপাতির শুমারিও করা হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। আধুনিক দেশীয় কৃষিযন্ত্র সম্প্রসারণ ও সহজলভ্য করার মাধ্যমে সময়মতো চাষাবাদ, উপকরণের যথাযথ ব্যবহার এবং ন্যূনতম সময়ে কম অপচয়ে শস্য আহরণের ক্ষেত্রে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এছাড়া স্থানীয় প্রযুক্তি সম্প্রসারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ২০১০ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের আওতায় ৬০ শতাংশ ভর্তুকিতে দেশের মাত্র ১৯ জেলায় ৪০টি উপজেলায় কৃষকদের মধ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি দেওয়া হবে। ক্ষুদ্র ঋণের প্রসার, চাতাল ও চালকল স্থাপন, গার্মেন্টস এবং নির্মাণকাজে শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদার কারণে গ্রামাঞ্চলে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এতদিন যারা কৃষি শ্রমিকের কাজ করত এখন তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে রিকশা-ঠেলাগাড়ি চালিয়ে বেশি অর্থ আয় করছে। অনেকে রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রির কাজ করছে। কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পেশারও পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। কৃষি শ্রমিকের সংকট, মজুরি বৃদ্ধি এবং একই জমিতে বহুবিধ ফসল চাষের কারণে কৃষিতে যন্ত্রপাতির চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। আগে ডিসেম্বর মাসে আমন ধান কাটার পর চাষিরা জমি ফেলে রাখতেন। এপ্রিল-মে মাসে আউস বা পাট চাষ করতেন। কেউ কেউ পাট ও আউস ধান কাটার পর আবার আমন ধানের চাষ করতেন। তখন ভুট্টা, গম, বোরো ধান, আলু, শীতকালীন শাকসবজি, তেলবীজ ও ডালজাতীয় ফসলের এত চাষাবাদ ছিল না। বর্তমানে আমন ধান কাটার পর এক দিনও অপেক্ষা করে না কৃষক। ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে জমি চাষ করে তাড়াহুড়ো করে ওই জমিতে গম, আলু, ভুট্টা, সরিসা প্রভৃতি ফসলের চাষ করে। এখন আর কেউ গরু-মহিষ দিয়ে জমি চাষ করে না। গ্রামাঞ্চলে ভাড়ায় প্রচুর ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার পাওয়া যায়। অনেক বড় কৃষকের নিজস্ব পাওয়ার টিলারও রয়েছে। কৃষি কাজে মান্দাতার আমলের কাঠের লাঙল-জোয়ালের পরিবর্তে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়লেও তার পুরোটাই প্রায় আমদানিনির্ভর। জমি চাষ, বীজ বপন, আগাছা দমন, সেচ প্রদান, বালাইনাশক প্রয়োগ, ফসল কাটা, মাড়াই, ঝাড়াসহ বিভিন্ন কাজে স্থানীয়ভাবে তৈরি কৃষি যন্ত্রের ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে দেশে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেও তার সুফল পাচ্ছে না সাধারণ কৃষক। এসব প্রযুক্তির বাস্তব ব্যবহার দৃশ্যমান হচ্ছে না মাঠে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত অনেক এগিয়ে রয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও কৃষক দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও খরচ অনেকটা কমাতে সক্ষম হয়েছে। দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে সরকারি নীতিমালার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন দেশের কৃষি প্রকৌশলীগণ। তাঁদের কথা-কৃষি যন্ত্রপাতির সুফল কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হলে গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে এবং স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বারি ও ব্রির হিসাব মতে, বর্তমানে দেশের মোট আবাদি জমির শতকরা ৯০ ভাগ চাষ হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এ কাজে প্রায় সাড়ে চার লাখ পাওয়ার টিলার এবং ৪০ হাজার ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে। কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফসল মাড়াই। এ কাজে বারি ও ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহারের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। দেশে উৎপাদিত ধান, গম, ভুট্টা, কলাই ও সরিসা প্রভৃতি শস্য মাড়াই কাজে যন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে বীজ বপন, ফসল কাটা ও মাড়াই কাজে যন্ত্রের ব্যবহারে বাংলাদেশের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। সঠিক সময়ে ধান, গম, ভুট্টা ও আখ কাটাই কৃষকের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে কৃষককে হারাতে হচ্ছে পরবর্তী ফসল। কৃষিকাজের মধ্যে সবচেয়ে শ্রমনির্ভর কাজ হচ্ছে বীজ বা চারা রোপণ, আগাছা দমন ও ফসল কাটা। মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ে বীজ রোপণ এবং ফসল কেটে ঘরে তুলতে কৃষকের বেশ সংকটে পড়তে হয়। ওই সময়ে কৃষি শ্রমিকের মজুরি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কখনো কখনো দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে বিলম্বে বীজ রোপণের জন্য ফলন কম হয়, পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পায় এবং আগাম ফসল বিক্রি করতে না পারার কারণে প্রত্যাশিত মূল্য থেকেও কৃষক বঞ্চিত হয়। আবার ফসল কাটার সময় শ্রমিক সংকটের কারণে মাঠে শস্যের অপচয়ও বেড়ে যায় অনেক। কখনো কখনো বিলম্বে ফসল কাটা ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে উৎপাদিত শস্যের একটি বিরাট অংশ নষ্ট হয়ে যায়। গত দুই দশক ধরে চীন থেকে স্বল্প দামে আমদানি করা ক্ষুদ্র সেচ যন্ত্রের ব্যবহারে বাংলাদেশের কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আবাদ ও ফলন বেড়েছে বোরো ধান ও শাকসবজিসহ রবি ফসলের। বগুড়া, রংপুর, যশোর, শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেচপাম্প, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের খুচরা যন্ত্রপাতি তৈরির বেশকিছু কারখানা গড়ে উঠার কারণে দেশে খামার যান্ত্রিকীকরণ কাজের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ৩২ ধরনের কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে, যার মধ্যে ১৬টি যন্ত্র মাঠে ব্যবহার উপযোগী। এসব যন্ত্রের একটি হলো পাওয়ার টিলারচালিত বেড পান্টার। এ যন্ত্রের সাহায্যে ঘণ্টায় প্রায় দুই বিঘা জমি চাষ, বেড তৈরি, বীজ রোপণ ও মই দেওয়া সম্ভব। এ পদ্ধতিতে গম, ভুট্টা, আলু, মুগ, তিলসহ বিভিন্ন সবজি কম সময় ও খরচে বপন সম্ভব। বারির একটি কৃষিযন্ত্র হলো স্বচালিত শস্য কর্তন যন্ত্র। এ যন্ত্রের সাহায্যে ঘণ্টায় প্রায় দুই বিঘা জমির ধান, গম, কাটা সম্ভব, যা হাতে কাটতে চারজন শ্রমিকের পুরো দিন লেগে যায়। দেশে প্রতিবছর ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কৃষি শ্রমিক হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কট আরো প্রকট হবে। ব্রি উদ্ভাবিত ছয়টি যন্ত্র কৃষিকাজে ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও সে সুবিধা কৃষকের কাছ থেকে অনেক দূরে রয়েছে। এক্ষেত্রে বারি ও ব্রির প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানসম্মত যন্ত্র তৈরির দক্ষতার অভাব ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা কম দায়ী নয়। একটি কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে ধান অথবা গম একসঙ্গে কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তা ভরার কাজ করা সম্ভব। কিন্তু এ যন্ত্রটি আমদানি করতে হবে। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো যন্ত্রটি ব্যবহারোপযোগী রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো এখনও আমাদের গ্রাম এলাকায় গড়ে ওঠেনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি যে প্রকল্প গ্রহণ করেছে, সেই প্রকল্পের আওতায় কম্বাইন হারভেস্টার, রাইচ ট্রান্সপ্লান্টার ও ট্রাক্টর দেওয়া হবে, যার পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এ প্রকল্পের সুফল দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয় প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ছাড়া কৃষির যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের খ- খ- ছোট জমিতে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনেক অসুবিধা রয়েছে। তা সত্ত্বেও কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট থেকে দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে জমির আয়তন, কৃষকের আর্থিক অবস্থা, আবহাওয়া, কৃষকের চাহিদা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে দেশে ব্যবহার উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন এবং দেশীয় কারখানায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎপাদন করে স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় শুধু আমদানিনির্ভর কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়ে টেকসই কৃষি উন্নয়ন, ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি, শস্য অপচয় রোধ এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনোটাই সম্ভব হবে না।

লেখক : কৃষিবিদ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist