শফিকুল ইসলাম খোকন

  ২৫ মে, ২০১৭

সংবাদপত্র, স¦াধীনতা ও দায়িত্বশীলতা

পুরনো কথা বারবার নতুন করে বলতে ভালো না লাগলেও কখনো কখনো বলতে হয়, কথায় বলে, ‘সাংবাদিকরা চতুর্থ রাষ্ট্র; সাংবাদিকরা জাতির বিবেক, জাতির আয়না, দর্পণ ইত্যাদি’। আর এই সাংবাদিকরাই সংবাদপত্র বা কোনো গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। একজন সংবাদকর্মী থেকে একজন সাংবাদিক; সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ। সংবাদপত্র থেকে জাতি তথা রাষ্ট্র উপকৃতই হয়। সংবাদপত্র যেমন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তার অবাধ বিচরণ ও স¦াধীনতাও যেমন থাকা দরকার, তেমনি দায়িত্বশীলতাও রয়েছে। সংবাদপত্র নৈতিকতার চর্চা করে। বিবেকের শাসন করে। সমাজ তথা রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথায় কীভাবে নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সংবাদপত্র।

মুসলমান রাজত্বকালে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হতো না, সব রাজনৈতিক বিষয়ক সংবাদ হাতে লেখা হতো এবং তা দেশের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীর কাছে প্রেরিত হতো। সব প্রদেশের সংবাদ একত্র করে স¤্রাটের কাছে যেত। এরূপ সংবাদ সংগ্রহের জন্য আলাদা বিভাগ ছিল। কানুন এ-জং নামক প্রাচীন পারস্য গ্রন্থে লেখা আছে, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬ খ্রি.) বাবর শাহ শিবিরে বসে সংবাদপত্র পাঠ করছিলেন। এমন সময় হিন্দু রাজারা এসে সন্ধির প্রস্তাব করেন। আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন, স¤্রাট আকবরের সময় প্রতি মাসে গভর্নমেন্ট গেজেটের মতো রাজকীয় সমাচারপত্র প্রচলিত ছিল। শাজাহান আগ্রার মহরম দরবারে বলেছিলেন, ‘এলাহাবাদের হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহের কথা সমাচার পত্রে পাঠ করে বিস্মিত ও বিষাদিত হলাম।’ স¤্রাট আওরঙ্গজেব ঔরঙ্গাবাদ নামক স্থানে জীবনলীলা সম্বরণ করেন, তার পীড়ার সমাচার ও বিবরণ দিল্লির ‘পয়গম-এ-হিন্দ্’ নামক ফারসি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে এই উপমহাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি স্থানীয় ইংরেজদের জন্য বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজর নামে দুই পাতার একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস, তার পতœী ও ইংরেজ বিচারকদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের দরুন এটিও দ্রুত বাজেয়াপ্ত হয়। ১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় শিক্ষক ও সংস্কারক গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন। ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে বাংলা মাসিক পত্রিকা দিগদর্শন প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ সালের ২৩ মে বেঙ্গল গেজেট প্রকাশের এক সপ্তাহ পর সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায় বাংলা সংবাদ কৌমুদী, ইংরেজি ব্রাহ্মিনিক্যাল ম্যাগাজিন ও ফার্সিতে মিরাত-উল-আকবর প্রকাশ করেন এবং তার নেতৃত্বে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সম্পাদকদের ঐক্যবদ্ধ চাপে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বিদ্যমান সংবাদপত্র আইন শিথিল করতে বাধ্য হন। ১৮৫৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলাযন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখান থেকে ১৮৬১ সালে ‘ঢাকা প্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। এ বছরেই দি জন বুল ইন দি ইস্ট (পরবর্তী নামকরণ দি ইংলিশম্যান) ইউরোপীয়দের ও ভারতে নীলকরদের শক্তিশালী মুখপত্র হয়ে ওঠে। ১৮৬৫ সালে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত পাইওনিয়র পূর্ণাঙ্গ সংবাদ পরিবেশনের জন্য খ্যাতি অর্জন করে। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভ্রাতৃগণ যশোরের ক্ষুদ্র গ্রাম ফুলুযা-মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন (পরবর্তীকালে কলকাতায় স্থানান্তরিত)। ১৮৮১ সালে যোগেন্দ্র নাথ বসু বঙ্গবাসী প্রকাশ করেন। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত বাংলা নীল দর্পণ নাটক ইউরোপীয় নীলচাষিদের নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরলে সরকারি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ফলত সরকার ১৮৭৬ সালে নীলকরদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে। অমৃত বাজার পত্রিকাসহ (যশোর) আরও কতিপয় স্থানীয় পত্রিকা নীলচাষিদের পক্ষাবলম্বন করে।

দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ নেন শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। ১৮১৮ সালে তাদেরই উদ্যোগে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি পত্রিকা। একই বছর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্র্য প্রকাশ করেন ‘বাঙাল গেজেট’, প্রথম বাঙালির মালিকানাধীন কাগজ। দ্বিতীয় বাঙালির কাগজটি ছিল রাজা রামমোহন রায়ের-‘সংবাদ কৌমুদী’। রামমোহন রায় ফারসি ভাষায় সাপ্তাহিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নাম ‘মিরাৎ উল আকবর’।

১৯৬৯ সালে প্রথম বাংলায়, পরে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় অমৃতবাজার পত্রিকা। জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের ভূমিকায় নেমেছিল এই পত্রিকা। পরবর্তী সময় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই স্বীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বের করেছিলেন। গান্ধীজী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পত্রিকার সম্পাদক বা পরিচালক ছিলেন। পরবর্তী সময় দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসকরা শুধু দমননীতি দ্বারাই সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি, তারা একই সঙ্গে সংবাদপত্রের মালিক ও সাংবাদিকদের কিনে নেওয়ার চেষ্টাও চালিয়েছিল। ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে শরৎচন্দ্র বসু এক বক্তব্যে ব্রিটিশ শাসকদের এই কৌশল তথ্যপ্রমাণসহ উন্মোচিত করেন। এ প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকার নামটিও চলে এসেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশেও মাত্র গুটিকয়েক পত্রিকা থেকে আজ অসংখ্য মাসিক, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দৈনিক পত্রিকা ইংরেজি ও বাংলায়। এখন সংবাদপত্র একটি শিল্প হয়ে উঠেছে। শত বছর আগ থেকে সংবাদপত্রের গুরুত্ব বহন করে আসছে। সেবা খাত থেকে এখন একটি শক্তিশালী শিল্প হিসেবে সংবাদপত্রের উত্তরণ ঘটেছে।

একটি দাবিদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে কি না-এ প্রশ্ন সবার মনে বাসা বেঁধে আছে। সংবাদপত্র একটি পণ্য। তা প্রকাশ বা পরিচালনা করতে পুঁজির প্রয়োজন। এতে যেমন লাভ আছে, তেমনি লোকসানের ঘানিও টানতে হয়। সংবাদপত্রকে ভালো লাগলে মানুষ তা টাকা দিয়ে কেনে। ভালো না লাগলে কিনে না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে বাংলাদেশের মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করার আগেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। দেশের অগ্রযাত্রার জন্য সংবাদপত্র যেমন প্রয়োজন তেমনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও প্রয়োজন। এর সঙ্গে সাংবাদিকের স্বাধীনতাও জরুরি। একজন স্বাধীনচেতা সাংবাদিক, যিনি কোনো পক্ষভুক্ত নন; তার জন্য প্রয়োজন ওরকম একটি সংবাদপত্র, সেখানে পেশাদারিত্ব চলবে, মালিকের হস্তক্ষেপ থাকবে না। আজকাল সংবাদপত্রের মালিকরাই সম্পাদক হচ্ছেন। সারাজীবন পেশায় কাটিয়ে দিয়ে তিনি একজন পুঁজির মালিকের অধীনস্থ হয়ে গেলেন। কিন্তু তাতে কী স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে? এভাবেই স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে।

সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে অনেকই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কখনোই অর্থবহ হয় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের মানবাধিকারেরই অংশবিশেষ। স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার উন্নয়ন ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। একটি দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হলে গণতন্ত্র বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আমেরিকার নির্বাচনে দু’বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেফারসন একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন, তাকে যদি সংবাদপত্রহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রের জগৎই বেছে নেবেন। শুধু তাই নয়, সংবাদপত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে সংবাদপত্রের কঠোর সমালোচনাও হজম করতে পেরেছিলেন জেফারসন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও তিনি সংবাদপত্রের প্রতি শ্রদ্ধা হারাননি। জেফারসন আবারও বলেন, ‘সংবাদপত্র যেখানে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং জনসাধারণ যেখানে পড়তে জানে সেখানে সবকিছুই নিরাপদ’।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ ধারায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চিন্তা এবং বিবেকের স্বাধীনতা দান করা হইল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সঙ্ঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অধিকারের এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

সংবিধানের ২ উপধারাটিকে বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও এখানেও কিছু শর্ত মানতে হবে। সেগুলো হলো-এমন কিছু খবরাখবর সংবাদমাধ্যমে আসতে পারবে না; যার জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না; যার জন্য বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। জনশৃঙ্খলা বিঘিœত হয়-এমন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। অশালীন এবং অনৈতিক কিছু খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না, সবসময় আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না, যার জন্য কেউ অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত হতে পারে। এসব শর্ত মেনে নিয়েই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়ে থাকে। এসব শর্তের লঙ্ঘন হলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ সংবিধানের এ ধারাটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পেছনে গভীর তাৎপর্য বহন করে। কারণ বাংলাদেশে এখন যতটুকু স্বাধীনতা বিদ্যমান, তার প্রায় পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সংবিধানে এ ধারাটি যোগ করে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে; তেমনি গোপনীয়তার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। মত প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়; যার জন্য একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। জানার অধিকার এবং গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সবসময় একটি ভারসাম্য রেখে চলতে হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে দেশের ও দেশের মানুষের স্বাধীনতা নেই, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবি কোনো অর্থ বহন করে কি-না? যে দেশে মানুষের স্বাধীনতা নেই, গণতন্ত্র নেই, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে কী করে? আর থাকলেই বা কতটুকু থাকবে? সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলে কেউ অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার চাইতে পারে, তার আশা-আকাক্সক্ষা-স্বপ্নের কথা প্রকাশ করতে পারে, স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য যারা সংগ্রাম করছেন, তাদের কর্মকা-ের বিবরণ প্রকাশ করে জনমত গঠন করতে পারে। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের পথটা সহজ হয়। যে স্বাধীন দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন নয়, সে দেশের মানুষ স্বাধীন নয়। পৃথিবীর বহু স্বাধীন দেশের মানুষ অপরাধীন। তারা শুধু দেখেই যাবে কোন প্রতিবাদ করতে পারবে না। তারা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে না। কর্তৃত্ববাদী সরকার সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা দিতে নারাজ। যদিও বহু কর্তৃত্ববাদী সরকার জনগণের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু মানুষ শুধু প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার প্রাণী নয়। অধিকার বঞ্চিত, মানবাধিকার লঙ্ঘিত মানুষ এবং কর্তৃত্ববাদী, স্বার্থবাদী দুর্নীতি-অনিয়মের সরকারের বিরুদ্ধে একমাত্র কথা বলার জায়গা হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। মানুষের স্বপ্নগুলোকে তুলে ধরার অর্থাৎ প্রকাশ করার অন্যতম প্রধান আধার বা পাত্র হল সংবাদপত্র। আধুনিক সংবাদপত্র শুধু সংবাদ প্রকাশের পাত্র নয়। রাষ্ট্রের বাস্তবতা এবং জনগণের স্বপ্ন-এই দুটি বিষয়ই তুলে ধরার কঠিন দায়িত্ব বর্তায় সংবাদপত্রের ওপর। আস্তে আস্তে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও কমে আসছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা বিশ্বজুড়েই নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে দিন দিন এ অবস্থা অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক দাবিদার রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক দল তথা সরকার পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের স্বাধীনতা। গত বছরের তুলনায় ভারত আরও তিন ধাপ পিছিয়ে ১৩৬ ন¤¦রে। আমেরিকা-ব্রিটেনও ক্রমশ হারাচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। তারাও দুই ধাপ পিছিয়েছে তালিকা থেকে। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া সমাজে ভালো কিছু আশা করা যায় না। সমাজের সবক্ষেত্রে অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য সংবাদপত্রের ভূমিকা পালন এখন অনিবার্য। সংবাদপত্রের শক্তিকে ব্যক্তিগত-রাজনৈতিক এবং কায়েমি স্বার্থে ব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে তাতে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা শঙ্কামুক্ত ভাবার উপায় নেই। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই প্রত্যাশিত। কিন্তু দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা এই শিল্পের জন্য লজ্জাকর এবং অপমানজনক।

সর্বোপরি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চালাতে হলে শুধু যে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব তা নয়, এখানে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। এ কারণে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব যেমন পাঠকের, তেমনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। সাংবাদিকরা কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করলে পৃথিবীর অবস্থা আরো খারাপ হতো। এক্ষেত্রে তরুণ ও উদীয়মান সাংবাদিকদের মেধা, বিদ্যা-বুদ্ধি-সততা এবং যোগ্যতার মাধ্যমে দেশ সেবায় দক্ষতার পরিচয় রাখতে হবে। সরকারকেও সংবাদপত্র তথা এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবহেলা আর দায়সারা নয়, নিজের দায়বদ্ধতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। রেডিও, টিভি আর অনলাইন যতই থাকুক না কেন গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রের গুরুত্বই প্রধান।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist