এসএম মুকুল

  ২৫ মে, ২০১৭

গর্ব ভরা বাংলাদেশ-আশার আলোয় বাংলাদেশ

বাংলাদেশ পারে, বাংলাদেশ পারবে। তলাবিহীন ঝুড়ির কালিমা কাটিয়ে আশার আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ সারাবিশ্বকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা বাঙালি-আমরাই পারি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির স্বাধীনতার রূপকার মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন- তারই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অদম্য উৎসাহ আর বহুমাত্রিক উদ্যোগ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অচিরেই সে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। কৃষি ও শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটালাইজেশন, উৎপাদন, রফতানি, দক্ষতা, নারীর ক্ষমতায়ন সর্বোপরি দেশের তরুণ সমাজের মাঝে সম্ভাবনার বাংলাদেশ নিয়ে আশার জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। একই সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আপামর জনসাধারণ ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। বলতে দ্বীধা নেই, যে ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী সঙ্কট বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয় তার তুলনায় চলতি ১০ বছরে বাংলাদেশের উন্নতি সত্যিই ঈর্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। চলতি ১০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক ও মানসিক উন্নতি দেশের অর্থনৈতিক অর্জনের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যক্তি উদ্যোগ, সামাজিক উদ্যোগ, দেশের আপামর জনগণের মেধা, পরিশ্রম, সৃজনশীলতা, ধৈর্য্য ও সাহস দেশের উন্নয়ন ধারায় গতি সঞ্চার করেছে। তবে বলতেই হবে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু অর্জন তার অধিকাংশই দেশের সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের মধ্যে বিশেষত খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বাংলার কৃষক এবং উৎপাদন ও রফতানিতে বাংলার শ্রমিকদের অসামান্য অবদানকে স্যালুট জানাতেই হয়। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিদের অনন্য অবদান রয়েছে। নারীর অগ্রযাত্রা অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে নতুন আশাবাদ সৃষ্টি করেছে। তাছাড়াও ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের অবদান, পেশাজীবীসহ সর্বসাধারণের অনন্য অবদান দেশের সার্বিক উন্নয়নে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে ও সম্ভাবনার সবচেয়ে বেশি আশার জায়গাটি হচ্ছে তরুণ সমাজ। প্রায় পাঁচ কোটি তরুণকে যোগ্যতা অনুসারে কাজ দিতে পারলে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যাবে আগামী ১০ বছরে।

বাংলাদেশের শিল্প বিকাশে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিকূল পরিবেশ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যথেষ্ট সহনশীলভাবে দেশীয় শিল্প বিকাশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। বলা হয়ে থাকে, যদি কোনো দেশ উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় তাহলে সে দেশে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কেননা, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ এবং সরকারের শিল্পবান্ধব ভূমিকার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এক্ষেত্রে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদের বিনিয়োগ নীতিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ায় শিল্পায়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি দেশীয় শিল্প বিকাশকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশীয় শিল্পের ভিত্তি শক্তিশালী করেন। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঘাড় নাড়ালেও মালয়েশিয়ার উন্নয়ন ব্যাহত হয়নি। এ কথা কমবেশি সবারই জানা আছে, ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত মালয়েশিয়া ছিল দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। মাহাথির মোহাম্মদের মন্ত্রীদের কাছে ব্যবসায়ী সমাজের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারে মনোযোগী হন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল-আইন-শৃঙ্খলার অস্বাভাবিকতায় কেউ যেন ভীত সন্ত্রস্ত্র না হয়। বিনিয়োগকারী যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়েন। কর্মীদের উশৃঙ্খলতা ও দুর্নীতির কালো থাবা যেন উৎপাদন ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি না করে। বলা যায়, এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ মালয়েশিয়াকে বাণিজ্যবান্ধব রাষ্ট্র্রে পরিণত করে। ফলে দেখা গেছে, শুধু টিন ও রাবার রফতানিকারক দেশ মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে ইলেকট্রনিক, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি এমনকি মোটরগাড়ি রফতানিকারক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ, বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে মালয়েশিয়াকে দ্রুত শিল্পায়নে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা দাতা সংস্থার পরামর্শ এড়িয়ে দেশের জন্য যা মঙ্গলকর তা-ই করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। তারই ফলে মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে অনগ্রসরতার পাতাল থেকে সগর্বে আরোহণ করেছে অগ্রগতির শীর্ষ চূড়ায়।

আমাদের দেশেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। আমাদের উদ্যমী শিল্প-উদ্যোক্তারা তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ দেশীয় বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে ক্রমশ গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত করেছেন। মনে রাখতে হবে শিল্পের মালিক উদ্যোক্তা হলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেবল নিজের সম্পদ নয়-এসব শিল্প উদ্যোগের সঙ্গে লাখো কোটি মানুষের কর্মসংস্থান ও জনগণের বিনিময় সম্পৃক্ততা রয়েছে। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুধু মালিক বা উদ্যোক্তারা নন, লাভবান হয় দেশের মানুষ, সমাজ এবং রাষ্ট্রও। সরকারকে ভাবতে হবে একজন বেসরকারি উদ্যোক্তা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে সচেষ্ট রয়েছেন। সরকারের নিয়ম-বিধির যাতাকলে তিনি যদি একটি উদ্যোগও বন্ধ রাখেন তাহলে মানুষের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব কে নেবে? সরকার রাজস্ব পাবে কোত্থেকে? দেশের চাহিদা কিভাবে মিটবে? রফতানি আয় কিভাবে বাড়বে? এ কারণে দেশীয় শিল্প উদ্যোগগুলোকে অধিকতর সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। বেকার যুবসমাজকে কাজ না দিয়ে মাদককে না বলো স্লেøাগানে সংগীত কনসার্ট করলে লাভ হবে না। জঙ্গিবাদ নির্মূলের চেষ্টাও সফল হবে না। বরং তাদেরকে কাজ দিয়ে মাদক কিংবা জঙ্গিবাদের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার উপায় সৃষ্টি করাটাই উত্তম উপায়।

বিশ্বের অর্থনীতি বিশারদরাও বলছেন, বাংলাদেশ পরবর্তী ভারত বা চায়না হতে পারে। এজন্য দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের যথাযথ ব্র্যান্ডিং কৌশল নিতে হবে। বিশেষ করে টেক্সটাইল ও ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে প্রচুর সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। সম্ভাবনা আইটি শিল্প খাতেও রয়েছে। আমরা জানি, চীন একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ। সত্তর দশক থেকে চায়নারা রাষ্ট্রের কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা এ চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এটাই চায়না শিল্প বিপ্লবের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেন বিশ্লেষকরা। আশির দশক থেকে চীনে ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দিলে বাজার অর্থনীতির দ্রুত প্রসার ঘটে। চীন তার বাজার উš§ুক্ত করে দেয় বিদেশি পুঁজি ও টেকনোলজির জন্য। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ কিছু শিল্প এলাকা তৈরি করে দিলে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। যা চীনকে একটি কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে শিল্পনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করে। কম দাম, গ্রহণযোগ্য মান, প্যাকিং ও পণ্যের বৈচিত্র্যে চীন এখন একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রাধান্য বিস্তার করেছে। বলা হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে চীনে তৈরি হবে লাখো লাখো মাল্টি মিলিওনিয়ার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের ৩০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। যদিও বিশ্বের পণ্যবাজারে চীনের বিস্তৃতি এখন-‘ফুটওয়্যার থেকে আন্ডারওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার থেকে সফটওয়্যার পর্যন্ত’। তাই বিপুল বেগে বিকাশমান অর্থনীতির বিশালতায় চীনকে প্রায়ই দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়। উৎপাদন নীতির থিওরি হচ্ছে- দারিদ্র্য দূর করার উপায় হলো ভালো জিনিস সস্তায় উৎপাদন করে বিক্রি করা। চায়নারা সেটা করে দেখাতে পেরেছে। অথচ আমরা ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরাকে শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি না। জিঞ্জিরা দুই নম্বর বা নকল জিনিস তৈরির এলাকা হিসেবে পরিচিত। প্রশ্ন হলো যারা নিজেদের চেষ্টায় বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল পণ্য তৈরি করতে পারছে তাদেরকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কেন উন্নতমানের দেশীয় পণ্য তৈরির কাজে লাগানো যাচ্ছে না? ধোলাই খালের অশিক্ষিত শ্রমিকেরা যদি বিদেশি গাড়ির মেশিনারিজ পার্টস তৈরি করতে পারে তাহলে তাদেরকে কেন প্রশিক্ষিত করে ধোলাই খালকে শিল্প এলাকায় পরিণত করা যাচ্ছে না? সরকার প্রণোদনা দিলে এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবেন। তাছাড়াও দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিল্প পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে। সরকার না পারলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে তো পারেই। এভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুটির শিল্পগুলোকে বিকশিত হবার সুযোগ দিলে দেশের মানুষ বহুমুখি কর্মযজ্ঞে সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা। গ্রামের জিনিস শহরে আসবে-যাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। পরিকল্পিতভাবে সুযোগগুলোকে কাজে লাগালে চীনকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ।

বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশপাশের দেশগুলোকে তাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশকে মাধ্যম হিসেবে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা জানি মাত্র ৫০ বছর আগেও সিঙ্গাপুর ছিল একটি হতদরিদ্র দেশ। সে সময় সিঙ্গাপুরকে ‘কলোনি অব কুলিজ’ বলে উপহাস করত। সিঙ্গাপুরের মোট আয়তন মাত্র ৬১৬ বর্গকিলোমিটার। সিঙ্গাপুরে রয়েছে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। কিন্তু গত প্রায় পঞ্চাশ বছরেও সিঙ্গাপুরে জাতিগত বা ধর্মীয় কোনো দাঙ্গা হয়নি। সামান্যতম উস্কানিও সেখানে কঠোরভাবে দমন করা হয়। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য শুধু একটি গুদামঘর হিসেবে পরিচিত ছোট্ট সীমানা সিঙ্গাপুরই কালপরিক্রমায় মাথাপিছু আয় ৩০ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান নিজের লেখা বইতে বলেছেন, মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে পৃথক করে দিল, তখন মনে হলো, ‘ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি’। কিন্তু সেই অনিশ্চিত সিঙ্গাপুর দরিদ্র অবস্থান থেকে কত্ত ওপরে উঠে এসেছে তা রীতিমতো অভাবনীয়। ভাবা যায়, এখন দুনিয়াতে ‘সিটি স্টেট’ বলতে সিঙ্গাপুরকেই বোঝায়। সিঙ্গাপুরের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি। প্রতিবছর এখানে কয়েকশ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয়। এই সাফল্যের নেপথ্যে আরো একটি কারণ-সিঙ্গাপুরের জনগণ কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। তারা মালিক-শ্রমিক বিরোধ বাধতে দেয় না। আগেই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। সিঙ্গাপুরের লোকসংখ্যার তুলনায় শিল্প-কারখানার সংখ্যাও খুব বেশি নেই। বলা যায়, সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির নেপথ্যে মূলত বন্দরকে কেন্দ্র করেই। আমাদের বাংলাদেশেরও সমুদ্র বন্দর আছে। আমরা চাইলে এই বন্দরগুলোকে বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আর সত্যিই যদি তা পারা যায় তাহলে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী রাষ্ট্র্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

আমাদের এও জানা আছে, পৃথিবীর দ্রুত শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত জাপান। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে, গত পঞ্চাশ বছর আগে জাপানও অতি দরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল। জাপানের রাস্তাঘাটে ভিখারি ছিল। গাছের নিচে বসে চুল, দাড়ি কাটাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপান দারিদ্র্যসীমার নিচে স্থান পায়। জাপানিদের যথেষ্ট খাবার ছিল না। সবার ছিল দারিদ্র্যময় জীবন। সেই দারিদ্র্য অবস্থা থেকে প্রত্যয়ী জাপানিরা পৃথিবীর অতি উন্নত অর্থনৈতিক সীমারেখায় এসে পৌঁছেছে। জাপানিরা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে ‘অতি পরিশ্রমী’ হিসেবে বিদ্রƒপ শুনেছে। কিন্তু দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে পরিশ্রম করেছে। তাদের কোনো কুণ্ঠাবোধ ছিল না। কাজ তাদের ধর্ম-কর্ম। কাজের ক্ষেত্রে কোনো ছোট-বড় চিন্তা তাদের নেই। ঘন ঘন টাইফুন এবং ভূমিকম্পপ্রবণ পাহাড়ময় দ্বীপ দেশ জাপান। যার বাসযোগ্য ভূমি কম; প্রাকৃতিক সম্পদও সীমিত। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপানের ১০০ মিলিয়ন মানুষ ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল। একদিকে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা অপরদিকে বিধ্বস্ত শহর-দেশ-অর্থনীতি পুনর্গঠন ও আধুনিকীকরণ ছিল জাপানের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়ে কে বলতে পারত পরবর্তী চার দশকের মধ্যেই বিধ্বস্ত জাতিটি একটি আধুনিক জাপান গড়ে তুলবে! চল্লিশ বছরের মাথায় অর্থনীতিবিদের মূল্যায়ন-‘প্রতিকূলতাই জাপানিদের জন্য আশীর্বাদ’। একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ এলাকায় বিপুল জনগণের বসবাস ছিল জাপানিদের প্রথম আশীর্বাদ। বাঁচার তাগিদে প্রচ- রকমের কর্মপ্রেরণা ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল তাদের মধ্যে। কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকাটা ছিল দ্বিতীয় আশীর্বাদ। ফলে জাপান স্বাধীনভাবে সারা পৃথিবীর অঢেল সম্পদ আহরণে সচেষ্ট হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছিল তৃতীয় আশীর্বাদ। নতুন ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তারা শিল্পকারখানা গড়ে তুলল। অতি পরিশ্রমী জাতি হিসেবে জাপানিদের দুর্নাম জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে তামাম বিশ্বকে প্রমাণ করে দেখাল-সব সম্ভব।

সম্ভাবনার বাংলাদেশ নিয়ে আমরা কী ভাবছি। বাস্তবিক পক্ষে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে যে পরিমাণ অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হয়, বিনিয়োগের পরিমাণ সে হারকেউ ছুঁতে পারেনি। দেশের মানুষের সাধারণ সঞ্চয়কে কোনো সরকারই কাজে লাগাতে পারছে না। সাধারণ মানুষের সঞ্চয় বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম এখনো সামাজিক উদ্যোগ। এসব সামাজিক উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে পাল্টে যাবে দেশের চেহারা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আমাদের দেশীয় শিল্প বিকাশ নীতি বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শিল্প উদ্যোগ একটি সামাজিক, ব্যক্তিক, রাষ্ট্রীয় ও মনস্তাত্বিক বোধ পরিবর্তনের আন্দোলন। শুধু কৃষিনির্ভর দেশ পৃথিবীতে অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব। কাজেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প বিকাশ নীতিকে অগ্রাধিকারের মানসিকতায় নিয়ে আসার বিকল্প নেই।

কেননা, শিল্পকে বিকশিত হতে না দিলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বন্ধ হবে। ফলে সরকারের ওপর কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাপ বাড়বে। বাড়বে মাদকতা, ছিনতাই, অপহরণ, জঙ্গিবাদ, খুনসহ বহুবিধ অপরাধ। আর এসবের দায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা হিসেবে সরকারের ওপর পড়বে। এসব কারণে বাংলাদেশে কোনো সরকার একটানা ক্ষমতায় থাকতে পারে না। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যেকোনো সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়ন ১২-১৫ বছরের নিচে সম্ভব নয়। আমাদের দেশে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলে সামগ্রিকভাবে সব উন্নয়নের সুফল দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, ঢাকার বাইরে শিল্প স্থাপন করলেই বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ঢাকার বাইরে শিল্প গড়ে উঠলে রাজধানীর ওপর চাপ কমবে। খবরে প্রকাশ আমাদের দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রথমত, অর্থ কেন পাচার হয় সে কারণটি আগে খুঁজে বের করতে হবে এবং তার পথ বন্ধ করতে হবে। কালো টাকা আয়ের পথ বন্ধ করতে হবে। আরেকটি বিষয় ভাবতে হবে, কালো টাকা বলে যে টাকাকে দেশের মাটিতে সহজে বিনিয়োগ করতে দেয়া হচ্ছে না সে টাকাই পাচার হয়ে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম, লন্ডন আমেরিকা আর সিঙ্গাপুরে বাঙালি পাড়া এমনকি বিজনেস গড়ে উঠছে। মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যদি বাংলাদেশের দুর্নীতির বা কালো টাকাকে সাদা করার ক্ষেত্রে তাদের দেশে বাণিজ্যের সহজ সুযোগ করে দিতে পারে তাহলে আমার দেশ বাংলাদেশ কেন ১০ বছরের জন্য বিনা বাধায় রেলওয়ে, পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন ও জেলা পর্যায়ে বাণিজ্য বিকাশে সুযোগ করে দিতে পারবে না সেটাই বোধগম্য নয়। ভাবা যায়, ১০ বছরে পে পরিমাণ টাকা পাচারের মাধ্যমে গেছে তা দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসতে পারত মধ্য আয়ের দেশ হতে ১০ বছরও লাগত না। তাহলে কালো হোক, ভালো হোক-দেশের টাকা দেশের মাটিতে গড়াগড়ি খেলেও দেশ ও জনগণের লাভ। সরকারের দরকার উন্নয়নের চাকা ঘুরাতে দেশে শিল্প বিকাশে এসব টাকা অবশ্যই নির্দিষ্ট মেয়াদে সহজে বিনিয়োগের সুবিধা দেয়া। তবে কালো টাকা উপার্জনের পথও বন্ধ করা দরকার।

সরকারের উচিত ছোট ছোট উদ্যোগগুলোকে জাতীয়করণের মাধ্যমে শিল্প বিকাশের পথকে প্রশস্ত করা। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে দেশের শিক্ষিত ও বেকার তরুণ-তরুণীরা এগিয়ে এসেছেন। আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় তারা বড় আকারের শিল্প না গড়ে প্রথমে ক্ষুদ্র আকারের শিল্প গড়ে তুলেছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের পুঁজি সরবরাহ করছে এনজিওসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের খাতগুলো চিহ্নিত করে সেখানে পুঁজি ও পণ্যের বাজারজাতকরণের সুবিধা প্রদান করলে বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ-তরুণীরা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে।

বাংলাদেশে যেসব সম্পদ রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেই দেখা দেবে আশা জাগানিয়া সম্ভাবনা। আমাদের সম্ভাবনার ক্ষেত্র অনেক। অনেক ক্ষেত্রে দেশের মানুষ স্ব-প্রণোদিত হয়ে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা এ সমস্যার মধ্য দিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। বারবার এদেশের জনগণ প্রমাণ করেছে, নিজের চেষ্টা, শ্রম আর মেধা দিয়ে আমরা জয় করতে পারি অসাধ্যকেও। আমরা প্রত্যয়ী জাতি। আমরা সম্ভাবনার স্বপ্নকে নিয়ে যেতে পারি সমৃদ্ধির পথে। সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ আমরাই গড়ব।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist