দ্যুতিময় বুলবুল

  ২৫ মে, ২০১৭

সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা

সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ সংবাদপত্র। কারণ, দর্পণে যেমন কোনো বস্তুর প্রকৃত রূপ ফুটে উঠে-তেমনি সমকালীন বিশ্ব চরাচরের চলমান গতি-প্রকৃতি, ঘটনাপ্রবাহ, জীবনচিত্র ও দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় সংবাদপত্রে। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক উন্নয়ন-অগ্রগতি, সত্য-সুন্দর এবং ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। এ জন্যই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্যালারিতে উপস্থিত সংবাদ প্রতিনিধিদের লক্ষ করে রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বোঝাতে এডমন্ড বার্ক সংবাদপত্রকে ‘ফোর্থ স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

সংবাদপত্র আজ পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। কেননা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বসহ সব জাতীয়-আন্তর্জাতিক কর্মকা- ও সামাজিক-মানবিক অধিকার অর্জন ও সংরক্ষণে সংবাদপত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সংবাদপত্রের তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জনগণ তথা পাঠককে চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ব্যষ্টিক ও রাষ্ট্রীক ভূমিকা নির্ধারণে সংবাদপত্র পথিকৃত হিসেবে কাজ করে। তাই সংবাদপত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে আমেরিকার দু’বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেফারসন এক সাংবাদিককে লিখেছিলেন, তাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র-এ দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেবেন।

সাংবাদিকতা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও মানবিক চেতনা বিকাশের কেন্দ্র এবং নীতি-নৈতিকতা, দায়-দায়িত্ব ও বুদ্ধি-বিবেকের আধার। তাই সৃজনশীল গণমাধ্যম ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে সংবাদপত্র অগ্রগণ্য। তবে সবচে’ ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাহসী, সংবেদনশীল ও নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ ও গণসম্পৃক্ত সার্বক্ষণিক পেশা সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল দল নিরপেক্ষ সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদপত্র যতবেশি নিরপেক্ষ হবে এবং সাংবাদিকরা যত বেশি নির্ভীক ও সৎ হবে দেশ ও জাতির তত বেশি মঙ্গল হবে। আর সেজন্যই তো সাংবাদিকদের সমাজের অতন্দ্র প্রহরী বা ‘গেট কিপারস’ বলা হয়। তবে আভিধানিকভাবে সংবাদপত্রের এসব বৈশিষ্ট্য হলেও, অনেক সংবাদপত্র ও সাংবাদিক নানা স্বার্থে উল্টাপথে হাঁটেন বা অপসাংবাদিকতায় মেতে ওঠেন, এমন প্রমাণও ভূরিভূরি।

সংবাদপত্র জগতের ঘটনাবহুল তথ্য নিয়ে প্রতিদিন হাজির হয় মানুষের কাছে, আধুনিক সভ্যতার বাহন হিসেবে। প্রতিদিন প্রভাতের সূর্যের মতো রাতের অন্ধকার কেটে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করে পাঠকের মনোজগৎ। সংবাদপত্র জীবন-জগতের প্রতিদিনের খবরাখবর দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে যেমন সহজ, সমৃদ্ধ ও গতিশীল করেছে, তেমনি সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীক সার্বিক অগ্রগতি ও মানবিক চেতনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকাশ ও বিকাশে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। আর এ কারণেই আধুনিক যুগকে ঞযব ধমব ড়ভ ঘবংি ঢ়ধঢ়বৎং বলা হয়। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের গঠনশৈলীতে নানা বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দৈনিক, সাপ্তাহিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাম্মাসিক ও বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকায় রাজনীতি-অর্থনীতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিনোদন-খেলাধুলা প্রভৃতি বিষয়ে নানা খবরাখবর প্রদান ও আলোচনা-সমালোচনা, পর্যালোচনা-পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়।

সভ্যতার বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে বৈশ্বিক অগ্রগতির হাত ধরে। শিক্ষা ও সভ্যতার অগ্রগতিতে সংবাদপত্র আজ অপরিহার্য অঙ্গ। বিশ্বের সবক্ষেত্রে মানবম-লীর এগিয়ে চলার সারথী সংবাদপত্র। আসলে, সংবাদপত্র হচ্ছে বিশ্বে জনমত গঠনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। সংবাদপত্রে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, চাহিদা, অভাব-অভিযোগ উঠে আসে। তাই সংবাদপত্রকে বলা হয়, ঘবংি ঢ়ধঢ়বৎ রং ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ঢ়ধৎষরধসবহঃ ধষধিুং ংবংংরড়হং.

সংবাদপত্রের জন্ম গণতন্ত্রহীন সমাজে। তখন সংবাদপত্রের দায়িত্ব ছিল সমাজকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করা। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে তুলে ধরা। মানবিক চেতনা জাগ্রত করা। তবে যুগের হাওয়ায় পাশ্চাত্যসহ বিশ্বের নানা দেশে কম-বেশি গণতন্ত্র আজ প্রতিষ্ঠিত হলেও, অনেক দেশেই গণতন্ত্র আজও অধরা। আবার কোথাও কোথাও ছদ্ম-গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এখনও লড়ছে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংবাদপত্র স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করলেও, বিপর্যস্ত কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্রের যথাযথ ভূমিকা পালন করা খুব কঠিন। সেখানে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের দায়িত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। গণতন্ত্রকামী মানুষের পাশাপাশি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয় গণমাধ্যমকেও। আর সেজন্য সাংবাদিক ও তার প্রতিষ্ঠানকে নানা ঝুঁকি নিয়ে এগোতে হয়। এ সময় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের নাগরিক অধিকার এবং মানবতার পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে স্বৈরসরকার বা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। স্বৈরসরকার বিরোধিতা রাষ্ট্র বিরোধিতা না হলেও, স্বৈরশাসকরা কৌশলে রাষ্ট্রকে সংবাদপত্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায়। তবে গায়ে পড়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারের বিরোধিতা না করে সরকারের গঠনমূলক কাজের প্রশংসা করা নিরপেক্ষ সংবাদপত্রে কর্তব্য। জাতীয় স্বার্থে সরকারের নীতি ও কাজের সমর্থন দেয়া সংবাদপত্রের দায়িত্ব।

যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগেই রোম নগরীতে সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু। বলা যায়, বিশ্বখ্যাত রোমান রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারই হলেন সংবাদপত্রের উদগাতা। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে নিহত হওয়ার ৫ বছর আগে তিনি ‘অ্যাকটা ডায়ারনা’ প্রকাশ শুরু করেন। এই নামটির বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘ঘটনা-বিবরণী’ বা ‘ঘটনা-প্রবাহ’। তবে প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে প্রকৃত সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয় ইউরোপে। ষোড়শ শতকে ইউরোপে প্রথম যে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় তার নাম ‘নোতিজিয়ে স্ক্রিতে’। ১৫৫৬ সালে এই কাগজটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রটি পুরোপুরি ছাপার জন্য চালু হয়ে গেছে। গুটেনবার্গের (১৩৯৭-১৪৬৮ খ্রিঃ) আবিষ্কৃত মুদ্রণযন্ত্র থেকে সিসার টাইপ কিংবা কাঠের ওপর খোদাই করা হরফে ছাপা হওয়া সংবাদপত্র দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ বিশ্বের বিস্ময় ‘কম্পিউটার’ জগতে প্রবেশ করেছে। সংবাদপত্র আজ ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হাতের মুঠোয় মোবাইল সেটের পর্দায় পাঠকের ইচ্ছায় দৃশ্যমান।

সংবাদপত্রের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীনে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। মুঘল আমলে মুসলিম শাসনেও ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হতো না। রাজনৈতিক সংবাদ হাতে লেখা হতো এবং তা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারীর কাছে পাঠানো হতো।

তবে এই উপমহাদেশে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত সত্যিকারের পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’। এটা একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক। জেমস আগস্টাস হিকি নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। হিকির গেজেট প্রকাশের ৩৮ বছর পর, ১৮১৮ সালে বাংলা সংবাদপত্রের অভ্যুদয় ঘটে। ‘দিকদর্শন’ নামের আদি বাংলা সাময়িক পত্রটির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন একজন ইংরেজ। তার নাম জন ক্লার্ক মার্শম্যান। তিনি বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম সম্পাদক। বাংলাভাষার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালের ২৩ মে।

‘দিকদর্শন’ প্রকাশের এক মাস পর, উইলিয়াম কেরির সম্পাদনায় এই বিখ্যাত বাংলা সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। সমাচার দর্পণ বাংলা সাংবাদিকতার গোড়াপত্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। সমাচার দর্পণ প্রকাশের পক্ষকালের ব্যবধানেই প্রথম বাঙালি সম্পাদিত পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গালা গেজেট’ প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এবং প্রকাশক হরচন্দ্র রায়। পত্রপত্রিকার ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়, এই উপমহাদেশের ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষাতেই সংবাদপত্রের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। উপমহাদেশীয় সাংবাদিকতায় বাঙালিরাই পথিকৃত।

বাংলাদেশের আজকের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে প্রথম সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল রংপুর থেকে, ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’। সেটা ১৮৪৭ সালের আগস্টে। ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ঠিক একশ’ বছর আগে। কালের যাত্রায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ আমাদের সংবাদপত্র বৈশ্বিক মানে পৌঁছে গেছে। এখন বাংলাদেশে অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মিডিয়াভুক্ত সব ধরনের পত্রিকার সংখ্যা ২৮১০টি। তবে দৈনিক পত্রিকা ৫২৮টি। এর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ২৪৫টি এবং মফস্বল থেকে ২৮৩টি। আর বিশ্বব্যাপী দৈনিক খবরের কাগজের সংখ্যা এখন প্রায় সাত হাজার (২০০৭ সালে ছিল ৬,৫৮০টি)। এখন একদিনে পত্রিকা বিক্রি হয় অন্তত ৪শ’ মিলিয়ন কপি। ২০০৭ সালে বিক্রি ছিল ৩৯৫ মিলিয়নেরও বেশি।

অনেকে মনে করেন বেতার, টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ার কারণে এখন প্রিন্ট মিডিয়ার গুরুত্ব ও প্রাধান্য কমে যাচ্ছে। তবে এটা কেউ কেউ মানতে রাজি নন। কারণ, সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা ও নেপথ্য কারণ এবং সংবাদের পেছনের সংবাদ খুঁজতে সংবাদপত্রের বিকল্প নেই। তারা মনে করেন, সাংবাদিকের জন্য সংবাদপত্রই উৎকৃষ্ট স্থান। অবশ্য এটা সত্য যে, ইউরোপ-আমেরিকায় প্রিন্ট মিডিয়ার চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, তবে এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচার সংখ্যা এখনও বাড়ছে।

২০১২ সালের এক পরিসংখ্যান বলছে, ওই বছর এশিয়ায় দৈনিক পত্রিকার সার্কুলেশন বেড়েছে ১.২%, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ৩.৫% এবং ল্যাতিন আমেরিকায় বেড়েছে ০.১%। আর যদি গত ৫ বছরের পরিসংখ্যান নেই, তাহলেও সংবাদপত্রের ভালো চিত্র পাওয়া যায়। যেমন, এ সময় এশিয়ায় সার্কুলেশন বেড়েছে ৯.৮%, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ১০.৫% এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে বেড়েছে ১%। ওয়াল্ড প্রেস সার্ভের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বিশ্বে মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিক্রি বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে ভারতসহ এশিয়ার সংবাদপত্রগুলো।

এশিয়ার মধ্যে কাগজে ছাপানো সংবাদপত্র সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে দক্ষিণ এশিয়ায়। এখানে ছাপানো দৈনিক পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়ছে। মনে করা হচ্ছে, ছাপানো সংবাদপত্রের এই সার্কুলেশন বৃদ্ধি আরও কয়েক বছর চলবে। সুতরাং, দক্ষিণ এশিয়ায় সংবাদপত্রের এখনও ভয়ের কিছু নেই। বলা যায়, এটা প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে থাকার সুফল। দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও ইন্টারনেট সবার কাছে পৌঁছায়নি। সংবাদ পাওয়ার বড় ভরসা এখনও দৈনিক পত্রিকা। মানুষের আয় বাড়ছে। শিক্ষিতের হার বাড়ছে। এতে পত্রিকার সার্কুলেশনও বাড়ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে সংবাদপত্রগুলো বিক্রি ও বিজ্ঞাপন মিলে প্রায় ১৭৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা এককভাবে পুস্তক প্রকাশনা, সংগীত বা চলচ্চিত্র শিল্পের আয়ের চেয়ে বেশি। এই সময়ে সংবাদপত্র বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ৯২ বিলিয়ন ডলার। আর ৮৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে বিজ্ঞাপন থেকে।

অবশ্য বিপুল খরচ, অধিক লোকবল, বেতন-ভাতার চাপ, বিজ্ঞাপন নির্ভরতা, অতিরিক্ত সময় ব্যয় এবং অনলাইন ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার প্রসারসহ নানা কারণে উন্নত বিশ্বে এখন প্রিন্টিং বা ছাপানো পত্রিকা প্রকাশনা হ্রাস পাচ্ছে। আর এ জন্য উন্নত দেশগুলোতে মিডিয়ায় বিনিয়োগকারী বা প্রকাশ করা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া তথা টেলিভিশন বা অনলাইনের দিকে ঝুঁকছেন। তবে ইউরোপ-আমেরিকার পাঠকদের মধ্যে পত্রিকার কদর কিছুটা হ্রাস পেলেও বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে তার ছোঁয়া লাগেনি। তাই এখনো দৈনিক পত্রিকা এখানে বেশ জনপ্রিয়। টেলিভিশন বা অনলাইন পত্রিকা নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে তুলনামূলকভাবে ছাপানো সংবাদপত্রের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।

তবে যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে সাংবাদিকতার সামনে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। সাংবাদিকের রিপোর্ট তৈরির যে ফাইভ ডব্লিউ ওয়ান এইচ ফর্মুলা, সেই ফর্মুলা এখন চলছে না। কারণ, এই ডিজিটাল যুগে কখন কোথায় কী ঘটছে, তা খুব তাড়াতাড়ি ইন্টারনেট ও বেতার-টিভির সৌজন্যে দ্রুত সবাই জেনে যাচ্ছেন। সকালবেলায় পত্রিকা পাঠকের কাছে সেটা পুরনো বা বাসি খবর। তাই এই বিষয়টি সাংবাদিকতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। কারণ, যে তথ্য জানা হয়ে গেছে, সাংবাদিক তা আর জানতে চাইবে না, বাড়তি কিছু চাইবে। পাঠককে নতুন কিছু দিতে ঘটনার বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান চালাতে হবে। যে তথ্যগুলো এখনো জানা যায়নি, সেগুলো বের করে আনতে হবে। শুধু তথ্য দিলে হবে না, তথ্যগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে, ব্যাখ্যা দিতে হবে। কথা বলতে হবে ঘটনার ভেতরের-বাইরের, চারপাশের পক্ষের-বিপক্ষের মানুষের সঙ্গে, নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে। এখন সাংবাদিকতাকে হতে হবে বিশ্লেষণী ও ব্যাখ্যামূলক; প্রতিটা খবরই হতে হবে অনুসন্ধানমূলক।

সাংবাদিকদের আশা করা ঠিক নয় যে, সব পাঠক সব বিষয়ে আগ্রহী হবে। অধিকাংশ পাঠকের সিরিয়াস বিষয়ে আগ্রহ কম থাকে। একুশ শতক নিউজ বিজনেসের নয়; ট্রাস্ট বিজনেসের, অর্থাৎ আস্থার ব্যবসার যুগ এটা। তাই প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে দরকার আধুনিক শিক্ষা ও চিন্তা-চেতনা সমৃদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগামী সাংবাদিক। যারা সব সময় তথ্য ও তত্ত্বে এগিয়ে থাকবেন, ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করবেন, তথের প্রমাণ ও অনুসন্ধানে সদা ব্যস্ত থাকবেন। ভালো সাংবাদিক ছাড়া ভালো সংবাদপত্র হবে না। কিন্তু এখনো আমাদের সমাজে সৎ, শিক্ষিত ও ভালো সাংবাদিকের বড় অভাব। ভালো সাংবাদিক বেশি দরকার, যারা সবকিছু ভালোভাবে যাচাই-বাছাই

করবেন, সঠিক তথ্য ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে আনবেন।

আসলে সংবাদমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সৎ, সত্যনিষ্ঠ, পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রকে প্রমাণ করতে হবে কারও প্রতি পক্ষপাত নেই, কারও বিরুদ্ধে বা কারও পক্ষে কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। সেটা সম্ভব হলেই সর্বস্তরের পাঠক সেই পত্রিকাকে গ্রহণ করবেন। গণমাধ্যমকে সব সময় মনে রাখতে হবে, সেই অন্যকে সুন্দর ও সঠিক পথে প্রভাবিত করবে। কিন্তু নিজে কখনো ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। অন্যায়-অসত্যের কাছে নতি স্বীকার করবে না।

অধিকাংশ গণমাধ্যমের পক্ষে এই কাজটা খুব কঠিন। কারণ, গণমাধ্যমের সঙ্গে ক্ষমতাবানের স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব থাকে। কিন্তু সেটাকে অতিক্রম করে সংবাদপত্রকে পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। অনুপ্রেরণা জোগাতে হয়। তাই বিরুদ্ধ পরিবেশেও সংবাদপত্রকে শক্ত হয়ে জনতার পক্ষে দাঁড়াতে হয়। জনমত গড়তে হয়। রাষ্ট্র বা সরকার জনমতের কাছে নত হয়। তাই জনতার স্বার্থে সংবাদপত্র ও সাংবাদিককে এগোতে হয় অবিরাম, অবিরত।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist