মাকিদ হায়দার

  ২৬ মার্চ, ২০২০

চেয়ার

ঘরের ভেতরে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও পরিবেশটা ভালো লাগেনি, মাথার ওপরে পরীর ডানার মতো ধবধবে সাদা সিলিং ফ্যান অবিরাম ঘুরে চলছে, ঠিক বেকার যুবকদের মতো। ওর ঘোরা দেখে একবার মনে হলো, যেন ফ্যানটা আমার অনুজের মতোই একটা চাকরির ভীষণ প্রয়োজন, ওই ফ্যানটির মতোই অবস্থা কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমার নিজেরও ছিল। আমি ঘুরেছি শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি। দুই মাস আগে আমার চাকরি হয়েছে, একটু আগে যে ঘরটায় ঢুকেছি, সেই ঘরের মাঝেই ঘুরেছে সেই সাদা ধবধবে পরীর ডানার মতো ফ্যানটা।

আমার চেয়ার আর টেবিলের সম্মুখেই আছে বেশ কয়েক বছর আগের পুরোনো ক্যালেন্ডার। সেই ক্যালেন্ডারের একটি বিশেষ মাসের কয়েকটি বিশেষ তারিখের ওপরে কে যেন লাল কালিতে বৃত্ত এঁকে দিয়েছেন, যেমন একটি তারিখে পড়ে আছে আমার জন্মতারিখ। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, এখনো কেন ওই পুরোনো ক্যালেন্ডারটিকে ফাঁসির আসামিদের মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রশ্নটি একবার মনে হতেই, আমার ডানপাশে যে ভদ্রলোকটি বসেন তাকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হলো, কিন্তু তিনি তখনো অফিসে পৌঁছাননি, অতএব প্রশ্নটি আর করা হলো না।

ডানপাশের ভদ্রলোকের বয়স আমারচে অনেক বেশি, আর তিনি এই অফিসেও আছেন বেশ দীর্ঘদিন যাবৎ, স্বভাবতই আমার চেয়ার আর টেবিলের তুলনায় তার চেয়ার টেবিলের জৌলুস অনেক বেশি, দামি মেহগনি কাঠের বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল, সব টেবিলজুড়েই বিরাট বেলজিয়াম কাচ, অনেকটা বড়লোকদের বাড়ির জানালার মতো, টেবিলটার সঙ্গেই আছে একটা হুইলচেয়ার, যেদিকে ইচ্ছা ঘুরিয়ে নেওয়া যায় এবং ইচ্ছামতো একবার দক্ষিণ, একবার পশ্চিম হতেও মোটেই অসুবিধা হয় না। ঠিক বাচ্চাদের খেলনা মোটরের মতো, যেদিকে খুশি সেদিকেই নেওয়া যেতে পারে। পারে বলেই বোধহয় আমার ডানপাশের ভদ্রলোক ইচ্ছামতো একবার দক্ষিণ একবার পশ্চিম মাঝে মাঝে, উত্তর-পূর্বেও যান তিনি। তার গমনাগমনে কোথায় কোনো অসুবিধা নেই, যেহেতু তিনি এই অফিসের জন্মসূত্র থেকেই আছেন। স্বভাবতই তার টেবিলের ওপর একটি টেলিফোন থাকা দরকার। দরকার বলেই একটি টেলিফোনও সেখানে উপস্থিত। টেলিফোন সেটটির গায়ের রং লাল টকটকে, অনেকটা রক্ত চোষার মতো। কিন্তু আমার ডানপাশের ভদ্রলোকটি প্রায়শই বলে থাকেন।

ইচ্ছা ছিল, বসকে বলে মানুষের রক্তের মতো লাল একটি টকটকে সেট নেব।

কেন, এটা তো বেশ টকটকে।

টকটকে রক্তের মতো নয়, অনেকটা পুরোনো রক্তের মতো, ওই যে গুলিস্তানের কাছে একটি ভিক্ষুক বসে আছে, যার একমাত্র অবলম্বন কাটা ঘা দেখিয়ে উপার্জন করা, সেই ভিক্ষুকটাকে হঠাৎ করে সেদিন দেখে ফেলেছিলাম, মানে ওর কাটা ঘাটাকে, সেই ঘায়ের রং আর আমার টেলিফোনের রং প্রায় একই রকম। অতএব এটাকে বদলিয়ে...

এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল, টেলিফোন কানে লাগিয়ে তিনি সদম্ভে বললেন, আমি আবদুল হাদী বলছি, চিফ এক্সপোর্ট অফিসার। হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন, কালকেই জাহাজ চিটাগাং পোর্ট ছেড়ে চলে যাবে, অতএব এবারেকার শিপে... ... ...

সত্যি আমি লজ্জিত, আমার ডানপাশের চশমাধারী ভদ্রলোকটির নাম এতক্ষণে আমার মনে পড়ল, স্মরণশক্তি ভীষণ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এর আগে একবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, ১৫টি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোর যখন এত দিনেও কোনো চাকরি হলো না, চল আমরা গ্রামে ফিরে যাই। গ্রামের হাইস্কুল তো তোকে ডেকেছেও কয়েকবার। গেলে সবচাইতে বেশি ভালো হবে, কিছু তাজা শাকসবজি পাওয়া যাবে। বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছি, তোর স্মরণশক্তি আগের তুলনায় অনেক কম হয়ে গ্যাছে অথচ ছোটবেলায় ইতিহাস পরীক্ষায় সবচাইতে বেশি নম্বর পেয়েছিলি। আর সেই তুই... নিজেও মাঝে মাঝে লক্ষ করি, আমার স্মরণশক্তির নদীতে কোনো জোয়ার নেই, আছে শুধু ভাটা। অথচ আমার এই বয়সে হঠাৎ এ ভাটার লক্ষণ কেন? আর এই ভাটার উৎসটাইবা কোথায়? দেহের নদীতে যদি জোয়ার থাকত, তবে নিশ্চয়ই মালিকপক্ষ আমাকে ওই ভাঙা নড়বড়ে চেয়ার-টেবিলে বসতে দিত না। তবে কি আমি অক্ষম হয়ে গেলাম? আর মালিকপক্ষইবা কী ধরনের জীব, তাদের কী রুচির কোনো পরিবর্তন ঘটবে না? এত সুন্দর ঘর, মেঝেতে ফুল তোলা কার্পেট, দরজায় ওয়েলকাম লেখা, পাপোশ বিছানো, মাথার উওপরে সাদা পরীর ডানার মতো ফ্যান, ডানপাশে দামি চেয়ার-টেবিল, সেই টেবিলের ওপর রক্তের মতো লাল একটি টেলিফোন, Ñ আর সেই ঘরে কি না নড়বড়ে ব্রিটিশ আমলের চেয়ার আর টেবিল!

তবু বলব মালিকপক্ষের রুচি আছে, আমার আর হাদী সাহেবের জন্য যে পিয়নটিকে দিয়েছেন তার চেহারা, কথাবার্তা, চালচলন আমাদের মালিকের চেয়ে অনেক ভালো। তাই এক দিন দুপুরে যখন এই অফিসের অধিকাংশ কর্মচারী দুপুরের খাওয়া খেতে যায়, সেসময় জামসেদকে জিজ্ঞাসা করলাম,

আচ্ছা জামসেদ, এই চেয়ারটাকে বদলানো যায় না?

না স্যার, বদলানো যায় না।

কেন?

এই চেয়ারটার আগের রং লাল ছিল।

তার আগে?

তার আগে কালো ছিল। সবচে মজার ব্যাপারটা হলো, এই চেয়ারটার নিজস্ব কোনো রং নেই। এই ধরুন, আপনি যদি বলেন, চেয়ারটাকে রং করে দিতে হবে, মালিক কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রং করিয়ে দেবেন অথচ বদলিয়ে দেবেন না। এই কিছুদিন আগেও এই চেয়ার প্রসঙ্গে কথা হয়েছিল। এবার নাকি চেয়ারটাকে সবুজ রং দেওয়া হবে। দেখা যাক কতদূর কী হয়। কী বলেন স্যার! এটা ক্যামনতরো কথা যে, কাঠের নিজস্ব কোনো রং নেই?

এককালে হয়তোবা ছিল, এখন নেই, তবে আশা আছে, এইবার যদি সবুজ রং হয়, দেখতে কিন্তু সত্যিই অপূর্ব হবে।

বুঝলাম, না হয় চেয়ারটার, না হয় ওই দুরবস্থা, কিন্তু টেবিলটাকেও তো বদলানো যেতে পারে।

টেবিলটাকে যদি আপনার সম্মুখ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে আপনার সামনে তো আর কিছুই থাকে না, অফিসের কাগজপত্র, আমদানি-রফতানির হিসাবপত্র তখন সবগুলোই মাটিতে পড়ে থাকবে, আর মাটিতে পড়ে থাকা মানেই হলো সেগুলো ডাস্টবিনে যাওয়া।

ডাস্টবিনে যাওয়া মানে!

মানে, সকালে ঝাড়–দার, ঘর ঝাঁট দিতে এসেই... ওরা তো আর আপনাদের মতো শিক্ষিত নয়। আপনারা যা ফেলে দেবেন, ওরা তাই কুড়িয়ে নিয়ে যাবে। অতএব, টেবিলটাকে এখান থেকে কোনোবস্থাতেই সরানো যাবে না। আমাদের কথোপকথনের মাঝেই আমার ডানপাশ অর্থাৎ সেই আবদুল হাদী সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন, তাকে দেখে মনে হলো, তিনি যেন এইমাত্র দিগি¦জয় করে এলেন, সব জামা ঘামে ভেজা, চশমার কাচে ধুলো, মুখের দিকে তাকানোই যায় না। হাদী সাহেবকে ঘরে প্রবেশ করা দেখেই জামসেদ এক ফাঁকে বের হয়ে গ্যাছে। হাদী সাহেব সব ঘরটার মাঝে চশমার নিচ দিয়ে একবার কাকে যেন অথবা কী যেন খোঁজ করলেন, বেশ মনোযোগ সহকারেই, অতঃপর নিজেই সোজাসুজি গিয়ে দাঁড়ালেন সেই সাদা ডানাওলা ফ্যানের নিচে, কিন্তু যে স্পিডে ফ্যান ঘুরছিল, তাতে বোধকরি হাদী সাহেবের তৃপ্তি হচ্ছিল না বলেই তিনি ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিয়ে ফিরে এলেন, নিজের চেয়ারের কাছে এবং এমন সশব্দে বসলেন, মনে হলো তিনি যে দিগি¦জয়ে বেরিয়েছিলেন সেই বিজয়ে তিনি বিপক্ষ সৈনিকের কাছে পরাস্ত হয়ে ফিরে এসেছেন। এবার নিজের টেবিলে পা দুখানা তুলে দিয়ে বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ কী যেন ভাবলেন। এমন সময় সেই রক্ত রঙের টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভারটি কানে লাগিয়ে নিয়ে উত্তর করলেন, অপর পক্ষকে বললেন, ‘হাদী সাহেব তো আজকে অফিসে আসেননি, তিনি ছুটিতে আছেন’। রিসিভার যথাস্থানে রেখে দিয়ে টিপলেন কলিং বেল। এবার আর জামসেদ এলো না, এলো অন্য একটি লোক, লোকটির হাতে একটি টেলিগ্রাম। লোকটি জানতে চাইল, এই রুমে হাদী সাহেব কে? হাদী সাহেব এবারও বললেন, তিনি আজকে অফিসে আসেননি। অপরপক্ষ বলল, তার নামে একটি টেলিগ্রাম আছে। হাদী সাহেব পুনরায় বললেন, আমার হাতে দিয়ে দিন, আমি হাদী সাহেবের পাশের বাসাতেই থাকি, ওকে পৌঁছে দেব।

লোকটির প্রস্থানের পরে জামসেদ এলো, তিনি জামসেদকে জানালেন, এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। এতক্ষণে তিনি তার বামপাশের লোকটির সঙ্গে কথা বললেন অর্থাৎ আমার সঙ্গে। হাদী সাহেবের এহেন ব্যবহারে আমার ভীষণ কৌতূহল হয়েছিল এই ভেবে যে, তিনি কেন উপস্থিত থেকেও টেলিফোন এবং টেলিগ্রাম দুটোর বেলাতেই, নাম প্রকাশ এবং টেলিগ্রাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন? লোকটি কি মানসিক দিক থেকে অসুস্থ? না মানসিক ভারসাম্য হারানোর পূর্ব মুহূর্ত, বুঝে উঠতে বেশ একটু সময় লাগল। পানি খাবার পরে তিনিই প্রথমে মুখ খুললেন। জানেন হায়দার সাহেব, আবহাওয়া ভীষণ খারাপ।

আবহাওয়া খারাপ এ কথা আবার আপনাকে বলল কে, চারদিকে উজ্জ্বল দিন, চকচকে পয়সার মতো। আর আপনি বলছেন আবহাওয়া খারাপ।

আরে সে আবহাওয়া আর এ আবহাওয়া এক নয়।

আপনি কথাটা একটু পরিষ্কার করে বলুন।

এই অফিসের আবহাওয়া, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না।

য্যামন?

আমি আপনার জন্য একটু সুপারিশ করেছিলাম।

আমার জন্য কিসের সুপারিশ করেছিলেন আপনি।

আপনার ওই চেয়ারটাকে বদলিয়ে একটি নতুন চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করা হোক, এই কথাটিই সেদিন মালিকদের বলেছিলাম। তারা আমায় শোনালেন, ওই চেয়ারটি নাকি মালিকের বাবার আমলের। অতএব ওটাকে বদলানো সম্ভব নয়।

আচ্ছা চেয়ারটি যদি ভেঙে যায়, তাহলে।

তাহলে আবার সারানো হবে। ওই দেখুন না, ওর বাম পা ভাঙা। সেই ভাঙা আবার জোড়া দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু জোড়া দিয়ে কতকাল চলবে?

ওদেরকে সেটাই তো বোঝাতে পারলাম নাÑ যাক, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে বলুন?

সাড়ে তিনটেÑ আচ্ছা হাদী সাহেব, আপনি উপস্থিত থেকেই টেলিফোনে কাকে যেন বললেন...

বুঝতে পেরেছি আর বলতে হবে না।

বললাম কী জন্য, শোনেন তাহলে। আপনার চেয়ারটাতে মালিকপক্ষ একটা নতুন লোক বসাতে চাচ্ছেন এবং আজকে তারই মিটিং হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হচ্ছে না, কারণ হিসেব করে দেখা গ্যাছে, এই কয়েক মাসের ভেতরেই কোম্পানির প্রভুত ক্ষতি আপনি সাধন করেছেন বলে এই কোম্পানির মালিকপক্ষ মনে করেন, আর অন্যদের ধারণা আপনি কাজকর্মে সব চাইতে বেশি ফাঁকিবাজ। যার ফলে আপনাকে বোধহয়...

ঠিক আছে, কিন্তু আপনি টেলিগ্রামটা খুলছেন না কী জন্য।

টেলিগ্রাম না খোলার কারণ হলো, স্ত্রী গিয়েছে দেশের বাড়িতে, অসুস্থ শরীর। ডাক্তার বলেছিল, ভিটামিনের অভাব শরীরে। আর আমাকে বলেছিল, আমার নাকি জন্ডিস হয়েছে। আমি নিশ্চিত জানি স্ত্রী মারা গেছে। কিন্তু এই বুড়ো বয়সে...

হাদী সাহেব আর বলতে পারেননি, গলাটা ধরে এসেছিল। আর আমার এসেছিল কান্না। চাকরিটা বোধকরি আর রক্ষা করা গেল না, কিন্তু আমি এমন কিইবা অপরাধ করলাম! আমি শুধু বলেছিলাম এই পুরাতন চেয়ারটাকে বদলিয়ে একটি নতুন চেয়ারের প্রয়োজন। প্রয়োজনটা যে আমার ব্যক্তিগত ঠিক তাও নয়, আমার চাকরি যাওয়ার পরে যে ভদ্রলোক এই চেয়ারে বসবেন, তিনিও তো আমার মতো বলতে পারেন এই ভাঙা উইপোকা খাওয়া চেয়ারে আমি বসব না, আমি নতুন চেয়ার আর নতুন টেবিল চাই।

অফিস ছুটির পর বাসায় ফেরার পথে নিজেকে নিয়ে নিজেই বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ অনুশোচনা করলাম এই ভেবে যে, রাজনীতি তো বেশ ভালোই শিখেছিলাম। বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছি। লেখাপড়াও বেশ ভালোই জানি। অথচ আমি কেন এই আমদানি-রফতানি সদাগরী অফিসে এলাম? আমারই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আজ কত বড় বড় চাকরি করছে অথচ ওদের চেয়ে কোনো অংশেই আমি কম নই। আর হ্যাঁ আজ অবধি কোনো অন্যায়কে আমি প্রশ্রয় দিইনি আর কিইবা অন্যায় কথা বলেছি যে, তারা আমায় চাকরি থেকে বিদায় করে দেবে!

অনুশোচনার অর্থই হলো নিজেকে অতীতের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি তো ফিরে যেতে চাই না। এমনকি চাইনিও কোনো দিন। আমি শুধু মাঝে মাঝে ভাবি, আমার ভবিষ্যৎটা যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন না হয়ে যায়। একটা চাকরি যাবে, আরেকটা চাকরি আসবে, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। হঠাৎ অনুভবে টের পেলাম, কে যেন আমাকে এক অগ্নিকুন্ডের দিকে বারবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইছে। তাড়াতাড়ি ফিরে তাকালাম পেছনের দিকে। আরে, এ যে দেখছি রাস্তা মেরামত করছে কন্ট্রাক্টরের লোকেরা, রাস্তার পাশে বিরাট চুল্লিতে খই ভাজার মতো করে ছোট ছোট পাথরের নুড়ি ভাজছে তরল কালো পিচে, আর সেই চুল্লির আগুনের আঁচ যেন আমাকে টেনে নিচ্ছে তার বুকের গভীরে। একজন লোক তো বলেই ফেলল আরে সাহেব, আরেকটু হলেই তো আগুনের ভেতরেই প্রায় চলে গিয়েছিলেন। কী হবে প্রতিবাদ করে, তাই প্রতিবাদ করলাম না। এমনকি বললামও না, কেন তোমরা রাস্তার ওপর আগুনের চুল্লি জ্বালিয়েছ। প্রতিবাদ নিরর্থক হবে বলেই সোজা চলে এলাম পল্টন ময়দানে। এর আগেও তো প্রতিবাদ করে দেখেছি কোনো ফলই হয়নি। যেমন আমার চেয়ারটির কথাই ধরা যেতে পারে। আসলে আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত নয়, যেহেতু আমরা নি¤œ-মধ্যবিত্ত। আসলে ঈশ্বর লোকটিও কেমন যেন। আমাকে যদি বোবা বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠাতেন তাহলে আমি কোনো দিনই ওই ভাঙা চেয়ারটার জন্য প্রতিবাদ করতাম না। চেয়ারটা শুধু ভাঙাই নয়, চারটে পায়েই জোড়া কাঠ লাগিয়ে কোনো রকম দাঁড় করিয়ে রেখেছে। অথচ আমার বিশ্বাস ওই চেয়ার এক দিন না এক দিন... হ্যাঁ ভেঙে পড়াটাই আমি চাই, ভাঙলেই একটি নতুন চেয়ার আসবে, কিন্তু আমি সমেতে যদি চেয়ারটা ভেঙে পড়ে, তাহলে। তাহলে আর কী, হয় চাকরিটা যাবে, নয় নতুন একটা চেয়ারÑ সেটা কী আমাদের মালিক নেবেন আর নেবেনইবা কী করে, নিশ্চয় বুঝতে পারবেন, নতুন চেয়ার কিনে দেওয়ার অর্থই হলো, মালিকপক্ষকে অপমানিত করা। আজকাল আমার কী যে হয়েছে, সারা দিন ওই একই চিন্তা অথচ অফিসের অন্য কাউকেই কোনো দিন চিন্তিত দেখলাম না। তারা সবাই স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত বিশেষত আমার রুমের হাদী সাহেবকে সব সময়ই হাসতে দেখি। এই কিছুদিন আগে তিনি হাসতে হাসতে বললেন,

জানেন হায়দার সাহেব, আপনার চিন্তার কারণটা আমি ধরে ফেলেছি।

আমি বিশ্বাস করি না, আর আপনি কেমন করেইবা জানবেন আমার চিন্তার উৎসটা কী?

সাহেব সাইকোলজিতে এমএ পাস করেছি কি সাধে?

তার অর্থ এই নয় যে, মানুষের মনের খবর আপনি সব জানতে পারবেন।

আমি বলব আপনার ভাবনার বিষয়টা কাকে নিয়ে?

আচ্ছা বলুন দেখি।

ওই চেয়ারটাকে নিয়েই আপনার ভাবনা, কিন্তু ভাবনাটি অহেতুক।

কেন, অহেতুক কেন?

আপনার জ্ঞাতার্থে একটি কথা জানিয়ে দিই, ওই চেয়ার যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে। কেননা, চেয়ারটার বয়স আপনার আমার চেয়ে অনেক বেশি। চেয়ারটার ওপরে অনেক লোকের লোভ ছিল। অনেক লোক অনেকবার চেষ্টা করেছে ওটাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে, কিন্তু আজ অবধি কেউই ওটাকে নিয়ে যেতে পারেনি।

কারা কারা লোভ করেছিল ওই চেয়ারটির ওপরে।

এই ধরুন শক, হুন, দ্রাবিড়, আর্য, অনার্য, ইংরেজ, ফরাসি। তবে হ্যাঁ ইংরেজরা অনেক দিন বসে গেছে ওই চেয়ারটায়। ওই ব্যাটারা তিনটে পা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল। আর একটি পা, মানে যেটা শক্ত ছিল- এই কিছুদিন আগে মুঘল-পাঠানদের বংশধররাই ভেঙে দিয়ে গেল। তাতে কী, মেরামতের পর বেশ কয়েকজন বসেছে। কিন্তু তারা কেউই চেয়ার-টেবিলের জন্য আপনার মতো চিন্তিত হননি। আমি নিজের চোখে দেখেছি, কিন্তু কোনো দিন মালিকপক্ষের কাছে কোনো প্রকার অভিযোগও করেনি। ‘হঠাৎ এক দিন শুনলাম, আমাদের অফিসের অনেকগুলো লোক ওই চেয়ার আর টেবিল সম্পর্কে আলোচনা করছে। ও হ্যাঁ, ওই চেয়ারে যিনি বসলেন, তাকে এই অফিসের কর্মচারীদের ঠিকমতো খাওয়া-পরার ভার নিতে হবে, আর যদি না নিতে পারে তবে যেন তিনি ওই চেয়ারে না বসেন। এই কথা শোনার পরেই সেই ভদ্রলোক রাতারাতি পালিয়ে গেলেন।

অবশ্য যাওয়ার আগে আমাকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। এত দিন শুধু মানুষকে সান্ত¡নার বাণী শুনিয়েছিলাম, কিন্তু এখন মানুষ আর সান্ত¡নার বাণী শুনতে চায় না, তাই চেয়ারে বসবার উপায় আর আমার নেই, কিন্তু চেয়ার খালি পড়ে থাকেনি। ওই হিসাবরক্ষক সাহেব চলে যাওয়ার পরই এই কোম্পানিতে আপনার চাকরি হলো।

বুঝলাম, সব কথাই বুঝলাম। এখন আমার কী করণীয় তাই বলুন।

এখন আপনার করণীয়, চেয়ারটাকে নিজের পয়সায় মেরামত করে নিজের বসবার উপযোগী করে নেওয়া। পাছে আবার শক, হুন, দ্রাবিড়, আর্যদের দখলে চলে না যায়।

অনেকক্ষণ দুজনই চুপচাপ সময় কাটালাম। সাদা পরীর ডানার মতো ফ্যানটা ঘুরে চলছে। কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাদী সাহেব মৃদু হেসে পুনরায় বললেন,

আমরা সবাই সময়ের ক্রীড়ানক। তাই ঘরবাড়ি, স্ত্রী-পুত্র সময় বিশেষে কিছুই নয়। এ চেয়ার আর টেবিল ছেড়ে আপনার কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। মনে রাখবেন ওই চেয়ার আর ওই টেবিল, মনে রাখবেন শক, হুন... ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close