জাহাঙ্গীর আলম

  ১৩ জুলাই, ২০১৮

নিবন্ধ

জমজম কূপের গোড়ার কথা

জমজম কূপ মক্কার পবিত্র কাবাঘরের পূর্বপাশে অবস্থিত। মহান আল্লাহ তায়ালার মহিমা। তিনি কিই না করতে পারেন, তা এ সমস্ত নিদর্শন না দেখলে উপলব্ধি করা যায় না। হজের মৌসুমে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এখান থেকে পান করছেন। শুধু তাই নয়, এ জমজম কূপের শুরু থেকে আজ অবধি মক্কা-মদিনা শরিফের জনসাধারণ ও অগণিত তীর্থযাত্রী পান করছেন এবং সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু পানির স্তর একটুও কমছে না বরং একই রকম আছে। মনে হয় মহাসমুদ্র থেকে পানি উত্তোলিত হচ্ছে এবং ব্যাপক উত্তোলনের পরও পানির স্তরের পরিবর্তন হচ্ছে না।

আল্লাহ পাকের কী অসীম রহমতের ধারা! হাজার হাজার বছর আগের ঘটনা, কিন্তু কালের বিবর্তনে কোনো পরিবর্তন নেই। চাহিদা অনুযায়ী পানি উত্তোলিত হচ্ছে; কিন্তু কমতি নেই। হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) সহ বিবি হাজেরাকে প্রস্তরময় পাহাড়-পর্বতঘেরা জনমানবশূন্য মক্কার এক উপত্যকায় আল্লাহর নির্দেশে নির্বাসনে পাঠানো হলো। সেখানে না ছিল মানুষ, না ছিল আহার্যের কোনো ব্যবস্থা এবং না ছিল পানীয়জলের ব্যবস্থা। একবার ভাবুন তো! কেমন স্বামী আর কেমন স্ত্রী! যে স্ত্রী দুগ্ধপোষ্য শিশুপুত্রসহ সুনিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেখানে থেকে গেলেন। স্বামীর আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, কোনো বাদানুবাদও করলেন না। স্বামীর কাজকে শুধু সমর্থনই করলেন না, হাসিমুখে গ্রহণ ও পালন করলেন।

মহান আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা যে কত গভীরে প্রোথিত ছিল, তা ধারণার অতীত। আল্লাহর নিকট নিজেদেরকে এভাবে সমর্পণ করতে পেরেছিলেন বলেই তো সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত তাদের ত্যাগের মহিমাকে আদর্শ করে রেখেছেন আমাদের জন্য। ত্যাগের মহিমায় চিরভাস্বর হয়ে আছেন হজরত ইব্রাহিম (আ.), বিবি হাজেরা ও হজরত ইসমাঈল (আ.)। পিপাসায় কাতর বিবি হাজেরা প্রাণ ওষ্ঠাগত দুগ্ধপোষ্য শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর জীবন সংশয়, দুশ্চিন্তায় অধির হয়ে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে পানির অন্বেষায় বের হলেন। পার্শ্ববর্তী সাফা পাহাড়ে, আরোহণ করে পানির জন্য চতুর্দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিলেন। হ্যাঁ, ওই যে অদূরে অন্য একটি পাহাড়ের চূড়ায় চিকচিক করছে পানি! ভালোভাবে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন, হ্যাঁ ঠিক পানিই তো! ওই পাহাড়ের (মারওয়া) উদ্দেশ্যে ছুটলেন। একদিকে পানি লক্ষ করছেন আর একদিকে নিচে রেখে আসা নিজের শিশুপুত্রের দিকে খেয়াল রাখছেন। দুই পাহাড়ের মাঝে বিবি হাজেরা, শিশুপুত্র আড়াল হয়ে পড়ছে তাড়াতাড়ি দৌড়ে পার হলেন পানির জন্য। কিন্তু হায়! পানি কোথায়?

প্রখর রৌদ্র তাপে প্রস্তরময় বালুকণা রাশিতে যে মরীচিকার সৃষ্টি হয়ে পানির মতো দেখাচ্ছিল। আবার তাকালেন চতুর্দিকে, দেখতে পেলেন ফেলে আসা সাফা পাহাড়েই তো পানি! আবার ফিরলেন সাফা পাহাড়ের দিকে। পানির আশায় এভাবে একবার, দুইবার নয়, সাত সাত বার দুই পাহাড়ে ছুটলেন। স্রষ্টার প্রতি কী গভীর আস্থা, পানি মিলবেই। আর যদি না-ও মেলে, এভাবেই প্রাণ বিসর্জন দেবেন স্রষ্টার উদ্দেশ্যে। তাতেও সুখ, পরম প্রাপ্তি। দুই পাহাড়ে সপ্তমবার ছোটাছুটির পর দেখতে পেলেন হজরত ইসমাঈলের পাদদেশে পানি। বিবি হাজেরা তাড়াতাড়ি এসে শিশুপুত্রের কাছে দেখেন, হ্যাঁ ঠিকই পানি! শিশুপুত্রের খেলাচ্ছলে পায়ের গোড়ালির আঘাতে আঘাতে পানি আসছে। মা হাজেরা তো অবাক। মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে পানি যাতে গড়িয়ে যেতে না পারে আশপাশ থেকে প্রস্তর ও বালু এনে চার পাশে বৃত্তাকারে পানি যতটুকু গড়িয়েছে ততটুকু বাঁধ দিয়ে আটকালেন এবং পানিকে জমজম অর্থাৎ থাম থাম বললেন। তখন আল্লাহ পাকের নির্দেশে পানি স্থিতি হয়ে গেল। এ হল জমজম গোড়ার কথা।

আল্লাহ তায়ালার প্রতি অবিচল আস্থা ও ত্যাগের মহিমাকে গৌরবান্বিত করে রাখার জন্য এবং বিশ্ববাসীর নিকট এর মাহাত্ম্য অনুকরণীয় করে রাখার জন্য মহান রাব্বুল আলামিন মা হাজেরার দৃষ্টান্তকে হজ ও ওমরাহকারীদের জন্য (হজের রোকন হিসেবে) ওয়াজিব করেছেন। মহান আল্লাহর কুদরত ও রহমতের নিদর্শনাবলি পরিদর্শনে মুমিন হৃদয় আল্লাহর প্রতি আরো বেশি নত হয় এবং মহান স্রষ্টার মহিমা, কুদরত, তার মাহাত্ম্য ও সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর করুণা অনুধাবন করা সহজ হয়। ধর্মীয় স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলি দর্শনে ঈমান ও আকিদা আরো বলিয়ান হয়। সুতরাং, এবারকার হজ ও ঈদুল আজহার ফরিয়াদ উল্লেখিত স্থানের রহমত ও বরকত আমাদের সবার যেন নসিব হয়।

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist