আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১৩ জুলাই, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ইন্টারনেট আসক্তি ও তরুণ সমাজ

হাতের অন্ধকারে আলোকিত পৃথিবী দেখা এবং ঘুম ঘুম চোখে রঙিন দুনিয়ায় প্রবেশ ইত্যাদি তারুণ্যকে ক্রমেই ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট আসক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলেন যে, মাদকের পরিবর্তিত সংস্করণ হচ্ছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বা ইন্টারনেটে অকারণে অতিমাত্রায় আসক্তি। মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বলছেন যে, একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি যারা শেয়ার করেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুদের সমবেদনা জানিয়ে থাকেন, এ ব্যাপারে উভয়ই অতিমাত্রায় ফেসবুক বা যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি। বলা হচ্ছে, সপ্তাহে ৩৮ ঘণ্টার বা এর বেশি যারা সামাজিকমাধ্যমে ডুবে থাকেন তারা আসক্ত। মাদক ছাড়া যেমন অনেকে থাকতে পারেন না তেমনি ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া থাকতে পারেন না! নেট সমস্যা বা কিছু সময়ের জন্য এসব মাধ্যম বন্ধ থাকলে হতাশায় রিঅ্যাকশ্যান দিয়ে পোস্ট দেন তাদেরকে মোটাদাগে আসক্ত বলা যায়! যেসব ফেসবুক ব্যবহারকারী একাকীত্বে ভোগেন, তারাই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বেশি স্ট্যাটাস দেন। প্রেম বা অন্যক্ষেত্রে ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বা যারা অযথা ফেবুতে তর্কে লিপ্ত হন বা প্রশ্ন ছুড়ে উত্তর আশা করেন তারাও ফেবু অতিমাত্রায় আসক্ত। দেখা যায় খেলা বা অন্যকিছুকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত চরিত্র হননে লিপ্ত থাকেন, পারস্পারিক মতামতে অসহিষ্ণু বা অযথা ইস্যু তৈরি করে পার¯পারিক বা অন্যের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে (যেখানে নিজের লাভ লোকসান নেই) গালিগালাজ বা চরিত্রহরণের চেষ্টা করে থাকেন অনেকে। ফেসবুকে অতিমাত্রায় আসক্তি হলে ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ অবস্থা সৃষ্টি হয়। এটা আমাদের দেশে অতিমাত্রায় হচ্ছে এবং ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। এ অবস্থা কিন্তু উন্নত বিশ্বে (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কান্ট্রিতে) বেশি নেই। কুরুচিপূর্ণ এ অবস্থা বাংলাদেশ এবং ভারতে বেশি। এটা ইন্টারনেটের অপব্যবহার বলা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে আমরা পারস্পরিক একটা অসহিষ্ণু স্টুডেন্ট কমিউনিটি তৈরি করছি।

যারা আসক্ত তাদের যে সমস্ত শারীরিক সমস্যা হয় বলে চিকিৎসকগণ বলে থাকেন তা হলোÑ পিঠে ব্যথা, মাথাব্যথা, মেরুদ-ে সমস্যা, ওজনে ভারসাম্য নষ্ট, ঘুমের ব্যাঘাত, চোখে ব্যথা বা কম দেখা ইত্যাদি। ইন্টারনেটের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ক¤িপউটার নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটায় এবং সেই সময়টুকুর জন্য নিজেরাই মূল্য পরিশোধ করে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আজ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সংবাদ, তথ্য, যোগাযোগ, কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, বিনোদন ইত্যাদি অনেক কিছুর জন্য মানুষ এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কেউ যদি ইন্টারনেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি আজকের যুগের একটি অত্যন্ত জটিল সমস্যা ও অভিশাপ। অন্যান্য নেশার মতোই এটি একটি সর্বনাশা নেশা, যা ব্যক্তির সামাজিক, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ইন্টারনেট ছাড়া থাকতে না পারা, বাদ দিতে গেলে দুশ্চিন্তা, বিষণœতা ও অন্যান্য সমস্যা আসা। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাভাবিক, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনকে ব্যাহত করা। ইন্টারনেট যদি হয় বিনোদনের প্রধান উৎস। ইন্টারনেটের ব্যবহার যারা লুকিয়ে রাখতে চান এবং তা নিয়ে মিথ্যা কথা বলেন। বাস্তব জীবনের চেয়ে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জীবন যাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায় ঘাড় ও কোমর ব্যথা, মাথাব্যথা এবং চোখে অস্বাভাবিক চাপজনিত সমস্যা হচ্ছে।

সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোনসহ নানা যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দেন ব্যস্ত বাবা-মায়েরা। এ থেকে সন্তানের মধ্যে প্রযুক্তি উপভোগ করার অভ্যাস জন্মায়। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সন্তানকে সবসময় ঘরে বন্দি রাখতে চান। নিজের চোখের সামনে দেখতে চান। সে ক্ষেত্রে তাদের হাতে মুঠোফোন-ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাত স্বস্তি অনুভব করেন, যা শিশু-কিশোরদের যন্ত্রের প্রতি আসক্ত করে ফেলে। বাবা-মা নিজেরাও সারা দিন ইন্টারনেটনির্ভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মগ্ন থাকেন। সন্তানরা এতে উৎসাহিত হয়। কখনো কখনো কিছু বিজ্ঞাপনের ভাষা ও উপাদান শিশুদের প্রযুক্তি বা গেমের প্রতি আসক্ত করে তুলতে পারে। ইন্টানেটে আসক্তি হলে, সময়ের জ্ঞান থাকে না, নেটে বসার জন্যে ঘুম বিসর্জন দেয়। অনলাইনে থাকাকালীন সময়ে কোনো কাজ করতে বললে ক্ষেপে যায়, নেটে বসতে না দিলে ক্ষিপ্ত হয়, হোমওয়ার্কের বদলে নেটে বসাকে গুরুত্ব দেয়, বন্ধুবান্ধব, এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, বাড়তি সময় নেটে কাটানোর ব্যাপারে মিথ্যে বলে, নতুন নতুন অনলাইন বন্ধু তৈরি হয়, পুরনো শখগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তি মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত শিশুরা খিটখিটে মেজাজের হয়, মিথ্যে কথা বলে, এবং সবার সঙ্গে অহেতুক তর্কে লিপ্ত হয়। এ ছাড়া স্কুলের রেজাল্ট দিনদিন খারাপ হতে থাকে। শিশুকে আত্মকেন্দ্রিক, অসহনশীল ও অসামাজিক করে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশে বাধা দিয়ে সৃষ্টিশীলতা নষ্ট করে দেয়, শিশুর শারীরিক খেলাধুলার সময় কেড়ে নেয়। এতে শিশুরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। শিশু শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দেয়। এতে শিশুর অস্বাভাবিক ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে বন্ধন কমিয়ে দেয়, সামাজিক যোগাযোগ কমিয়ে দেয়, শিশুর স্বাভাবিক আচার-ব্যবহারের ওপর প্রভাব ফেলে, ধীরে ধীরে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, জীবনের গুণগত মান কমে যায়। পড়ালেখাসহ সব কাজের গতি ও মান নিচে নামতে থাকে। হতাশা বা বিষণœতায় আক্রান্ত হতে পারে; ঘটাতে পারে আত্মহত্যা। বাবা-মার সঙ্গে দূরত্বের কারণে সন্তান ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই তাকে সময় দিতে হবে। নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া অভিভাবকদের কিছু টেকনিক জ্ঞান প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তাও আছে। ফেসবুক আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিলে তার একটি সময়সীমা বেঁধে দিন। সন্তানের সঙ্গে চুক্তিতে আসুন, যাতে নিয়মগুলো পালন করে।

শিশুদের ফেসবুকের আসক্তি কমাতে অভিভাবকেরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সন্তানকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। সন্তান কখন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে চলছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান। শিশুকে গুণগত সময় দিন। মা-বাবা নিজেরাও যতি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে সবার আগে নিজের আসক্তি দূর করুন। ফেসবুকের আসক্তি কমাতে স্কুলে স্কুলে সচেতনতামূলক প্রচার শুরু করলে এখনকার তরুণ প্রজন্মকে ওই কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করা যাবে। স্কুলগুলোতে কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। কর্মশালায় ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার কুফল নিয়ে আলোচনা, পাঠচক্র করা যেতে পারে। ইন্টারনেটের কুফল থেকে সন্তানদের বাঁচাতে বিকল্প হিসেবে খেলাধুলা বা পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদিন বিকেলে পড়া শেষে তাকে খেলাধুলার সময় দিতে হবে। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক গড়ে তুলুন। সব কিছু খোলামেলা আলোচনা করুন। তাহলে অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে। শিশুদের জন্মদিন কিংবা বিশেষ দিনে শিশুদের বই উপহার দিন। তাকে আস্তে আস্তে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বই পড়লে এক তো জ্ঞান বাড়বে অন্যদিকে ফেসবুকের আসক্তি কমবে। সম্ভব হলে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন মোবাইল। শিশুদের হাতে মোবাইল না দেওয়া গেলেই ভালো। ১৮ বছরের নিচের সন্তানের ইন্টারনেটের যাবতীয় পাসওয়ার্ড জানুন। তবে লুকিয়ে নয়, তাকে জানিয়েই তার নিরাপত্তার জন্য পাসওয়ার্ডটি আপনার জানা দরকার; এটি বুঝিয়ে বলুন। বাসার ডেস্কটপ ক¤িপউটারটি প্রকাশ্য স্থানে (কমন এরিয়া) রাখুন। শিশু যাতে আপনার সামনে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করে, সেদিকে গুরুত্ব দিন। নিরাপত্তামূলক অনেক সফটওয়্যার আছে। সেগুলো ব্যবহার করুন, যাতে আপনার বাসার সংযোগ থেকে কোনো নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে প্রবেশ না করে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist