প্রতীক ইজাজ

  ১৬ জুলাই, ২০১৮

বিদায় আনন্দ-বিষাদের ফুটবল বিশ্বকাপ!

কাগজে-কলমে উৎসবটা শুরু হয়েছিল ১৪ জুন। কিন্তু তার রং ছড়িয়েছিল আরো আগে। ঘরে বাইরে নানা প্রস্তুতি। রংবেরঙের ফিকশ্চার। তারকা খেলোয়াড়দের ছবি। জার্সি। পতাকা। পছন্দের দেশের পতাকাখচিত হাতের ব্যান্ড। এমনকি টেবিলের ওপর বড় মানচিত্রের ওপর ঝুকে অংশ নেওয়া দেশগুলোর নানা তথ্য সংগ্রহ করতেও দেখেছি অনেককে। প্রিয় খেলোয়াড়দের অমর কীর্তি, খেলার বিচিত্র তথ্য মুখস্থ ছিল শিশুদেরও। দেশের দোকানগুলোতে টেলিভিশন বিক্রির হিড়িক পড়েছিল। ছোট-বড় সাধ্য অনুযায়ী কিনেছে ফুটবলপ্রেমি মানুষ। মুঠোফোনও বিক্রি হয়েছে বেশ। অন্য খাতের খরচ বাঁচিয়ে গিগাবাইট কিনেছে খেলা দেখার জন্য সাধারণ মানুষ। কুইজে অংশ নিতে সের দরে পত্রিকা কিনতেও দেখেছি পাঠকদের। টেলিভিশনের সামনে বসে তাৎক্ষণিক কুইজের উত্তর দিয়েছেন দর্শকরা। পত্রিকা অফিসগুলোর কুইজের বাক্স ভরে গেছে মুহূর্তেই। রোদে ঘেমে ক্লান্ত পাঠক ব্যাগ ভর্তি করে কুইজ নিয়ে আসতেন। মাস জুড়ে ঘরে ঘরে ছিল উৎসব। নিয়ম করে রাত ৮টায় ও ১২টায় ঠিক টেলিভিশনের সামনে বসে যেত পরিবারসুদ্ধ মানুষ। চেয়ার টেবিল সরিয়ে ঝকঝকে তকতকে মেঝে; ঘরোয়া স্টেডিয়াম। সঙ্গে আমন্ত্রিত স্বজনরা। খাবারেও উৎসব। পছন্দের দলের জার্সি গায়ে। তর্ক-বিতর্ক। নিজ দলকে খ্যাতির শীর্ষে তুলতে কত যুক্তি, তথ্য উপস্থাপন। সামান্য ভুলেও প্রিয় খেলোয়ার ও দলের প্রতি সে কি অভিমান, রাগ, বকা-ঝকা। আর গোল হলে তো কথায় নেই। সমর্থকদের বৃত্তাকারে নাচ। হৈহুল্লোড়। নির্ঘুম রাত নিস্তব্ধতা ভেঙে মেতে ওঠত উৎসবে।

ফুটবল উন্মাদনায় গোটা দেশ সেজেছিল নন্দিত সাজে। উৎসব ছিল শহরে, গ্রামে, আনাচে-কানাচে। পথে বের হলে যে কেউ অনায়াসে পেয়ে যেত উৎসবের বার্তা। আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড। চোখে পড়ে বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, কলম্বিয়া, সুইডেন। বাতাসে পত পত করে উড়ছে দেশগুলোর পতাকা। বারান্দার কার্ণিশে, ছাদে, গাড়ির পেছনে, কিংবা দোকানির ঝাপে পতাকা। রংবেরঙের পতাকা যত্রতত্র, রাস্তার দুপাশে, মিডিয়ানে, গাছের ডালে। দেয়ালে ছোপ ছোপ আকাশি সাদা রঙ। কোথাওবা হলুদে মাখামাখি। রাস্তায় বেরুলে চলাফেরা জার্সিই বলে দিত সেদিন কোন দেশের খেলা; মাঠ আলো করবে কোন তারকা। পোশাকের দোকানগুলোয় কাচ ভেদ করে উঁকি দিত জার্সি। নিজ পছন্দের দলের একটি জার্সি সংগ্রহে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা সমর্থকদের। হুমড়ি খেয়ে পড়া দোকানে, দরদামে। তারপর সে জার্সি যখন গায়ে ওঠত; চোখমুখ খেলতো আনন্দ আলোয়; উৎসবের দ্যুতি ছড়াতো বাতাসে! এদেশে বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে মানুষের যে আনন্দযোগ, তা বাঙালির হাজার বছরের সার্বজনীন উৎসবের অংশও বটে। আবেগ অনুভূতিও। খেলা চলাকালীন যে বিভাজন; খেলা শেষে জয়-পরাজয়ের আনন্দ-বিষাদ নিয়ে সেই সমর্থকদেরই আবার দল বেঁধে চায়ের দোকানে হুল্লোড়। ঘরে বিজিত দলের সমর্থক পরাজিত দলের সমর্থকের কথা ভেবে নিশ্চুপ; দৃশ্যমান আনন্দ বিসর্জন। এক দলের সমর্থক নির্দ্বিধায় জার্সি এনে দিচ্ছে অন্য দলের সমর্থককে। অফিসে কর্মস্থলে বাড়িতে সব পতাকাই পেয়েছে সমান গুরুত্ব। কে বড় মেসি না নেইমার, এমবাপ্পে বা লুকা মডরিচ, নাকি রোনালদো-সুয়ারেজ; সে তর্কের সমাধান নেই। মানুক আর না মানুক মনে মনে, তর্কে-বিতর্কে, যুক্তি-তথ্যে নিজ সমর্থিত দলের প্রিয় তারকাই বড়—এই অকাট্য সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত অনঢ় সমর্থকরা।

গোটা বিশ্বকাপের উন্মাদনা শেষ পর্যন্ত এদেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলেই এসে ঠেকে। প্রতিবারের মতো এবারও মূলত সমর্থনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এই দুই দলই। আবার দুই দলের দুই প্রিয় তারকা মেসি ও নেইমারকে নিয়েও মেতে ওঠেন দেশের মানুষ। মেসির দল আর্জেন্টিনা গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলে মাঠ চলে যায় ব্রাজিলের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। পরে যখন সেই ব্রাজিলও বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বেলজিয়ামের কাছে হেরে, সে রাতে আনন্দ দেখে কে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের। বেলজিয়ামের জয়ে আনন্দে নেচে ওঠে সে রাত। মূলত আর্জেন্টিনা সমর্থকদের বিজয় উল্লাসে ঘরে ঘরে দেখা দেয় আরেক উৎসব। পরে অবশ্য দুই প্রিয় দল আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ে ধীরে ধীরে এদেশে কিছুটা ফিকে হয়ে আসে বিশ্বকাপের আনন্দ। কার্যত বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায় বাংলাদেশ। অবশ্য বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দের রেশ ছিল শেষদিন পর্যন্ত। শেষের দিকে এসে সবমিলে ক্রোয়েশিয়ার পক্ষ নেই বেশিরভাগ মানুষ। মাঠের ও মনের নায়ক হয়ে ওঠেন লুকা মডরিচরা।

আনন্দ-বিষাদের বিশ্বকাপ হাস্যরসেরও খোরাক জুগিয়েছে এবার। ফাউল পেতে মরিয়া ব্রাজিলের নেইমারের অভিনয়শৈলী শেষ পর্যন্ত আর মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়, জনে জনে। এতে তার পক্ষে সমর্থকদের আবেগর পরিবর্তে অনুকম্পা, শেষ পর্যন্ত ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এ নিয়ে বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়ে ব্রাজিলের সমর্থকরাও। কোনঠাসাও হতে হয় তাদের। এমনকি ফ্রান্সের আরেক তরুণ তারকা এমবাপ্পের মধ্যেও সেই অভিনয়ের ছিঁটেফাঁটা ধরা পড়ে মাঠে। নিন্দার পাশাপাশি সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় এই দুই তারকাকে। বিশেষ করে নেইমারের অভিনয় নিয়ে শেষ পর্যন্ত মুখর ছিল বিশ্বকাপ আনন্দ।

বিষাদও ছুঁয়েছে এবার। আর্জেন্টিনা যেদিন বিদায় নেয়, মেসির বিষাদমাখা মুখ কাঁদিয়েছে সমর্থকদের। মেসিভক্ত শিশুদের কান্নায় কেঁদেছে বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্যরা। তারপরও বিশ্বকাপে শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার জার্সি পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা। মনে শক্তি জুগিয়েছে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মেসির সেই নান্দনিক গোলটি। অবশ্য ব্রাজিলের বিদায়েও মন খারাপ হয়েছে সমর্থকদের। বিশেষ করে শেষ ষোলতে নকআউট পর্বের প্রত্যেকটা খেলায় ছিল মন খারাপের। মূলত দুই দলের এদেশের ফুটবল প্রিয় মানুষ পরে বিভক্ত হয়ে পড়ে অন্যান্য দলে। ধীরে ধীরে সমর্থনের ব্যবধান কমতে থাকে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকরা শেষ অবধি এক জায়গায়ই, আবার আগের মতোই খেলায় মেতে ওঠে। ঘুরেফিরে পছন্দের তালিকা মিলতে থাকে। আর বিপত্তি বাধে সেখানেই। যেদিন যে দল বিদায় নিয়েছে, সে রাত কেটেছে মন খারাপের।

আনন্দ-বিষাদের বিশ্বকাপ কাল বিদায় নিল। মাস জুড়ে বহমান আনন্দস্রোত ও বিষাদের ক্ষত মুছে যাবে ধীরে ধীরে, ক্ষীণ হয়ে আসবে। মানুষ আবার কর্মব্যস্ত হয়ে পড়বে। কেবল স্মৃতি থেকে যাবে মনে। মেসির মুখ ভাসবে। নেইমার হাসাবে। মাস জুড়ে খেলাকে ঘিরে যে আনন্দ-বিষাদ স্মৃতি, তা এদেশের মানুষকে আবারও এক করবে আরেক কোনো উৎসবে, আনন্দযজ্ঞে। এদেশের মানুষ উৎসবপ্রিয়। সব উৎসবই আসে এক করতে। মিলাতে। রাশিয়া বিশ্বকাপও আমাদের সংহতির পথ দেখালো নতুন করে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ফুটবল বিশ্বকাপ,খেলা,রাশিয়া বিশ্বকাপ,কলাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist