প্রতীক ইজাজ

  ১৬ আগস্ট, ২০১৮

মোবাইলের নতুন কলরেট

লাভ-লোকসানের হিসাব চলছে

দেশে মোবাইল ফোনের নতুন কলরেট নির্ধারণ করেছে সরকার। গত সোমবার মধ্যরাত থেকে নির্ধারণ করা এই নতুন কলরেটের বিষয়টি ইতোমধ্যেই সব মোবাইল ফোন অপারেটরকে জানিয়ে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সে অনুযায়ী, অপারেটরগুলো নতুন রেট কার্যকরের উদ্যোগ শুরু করেছে।

নতুন কলরেট অনুযায়ী, এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে (অফনেট) বা নিজস্ব অপারেটর (অননেট) ব্যবস্থা তুলে নিয়ে যেকোনো অপারেটরে কথা বলার খরচ প্রতি মিনিট সর্বনিম্ন ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে; সর্বোচ্চ কলরেট নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি মিনিট ২ টাকা। অর্থাৎ এখন থেকে আর অফনেট ও অননেট রইল না। এতদিন একই অপারেটরে ফোন করলে, অর্থাৎ গ্রামীণ থেকে গ্রামীণ বা রবি থেকে রবিতে ফোন করলে সর্বনিম্ন কলরেট ছিল ২৫ পয়সা ও এক অপারেটর থেকে অন্য যেকোনো অপারেটরে ফোন করলে কাটা হতো সর্বনিম্ন ৬৫ পয়সা। সর্বোচ্চ চার্জ এখনকার মতো আগেও প্র্রতি মিনিট ২ টাকাই ছিল।

নতুন কলরেট নিয়ে বিটিআরসি, অপারেটর ও গ্রাহকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিটিআরসি ও অপারেটরগুলো নতুন কলরেটের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, নতুন নির্ধারিত কলরেট অনুযায়ী, গ্রাহকরা সুবিধা পাবেন বেশি। আগের তুলনায় কলরেটও কমছে। আগে অন নেটে সব মিলে খরচ মিনিট প্রতি পড়ত ৪০ পয়সার মতো। আর অফনেটে খরচ ছিল ৯০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৪৫ পয়সার মতো। নতুন নির্দেশনায় অননেট কলের খরচ ৫ পয়সা বাড়লেও অফনেট কলের খরচ প্রায় ৫০ পয়সা কমে যাবে। তবে গ্রাহকদের অভিযোগ আগে যেখানে ২৫ পয়সায় কথা বলা যেত এখন তা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। এর ফলে মোবাইলে তাদের কথা বলার খরচ বেড়ে গেল।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ভালো-মন্দ দুটো দিকের কথাই বলছেন। তাদের মতে, সর্বনিম্ন কলরেটের নিম্নমাত্রা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৪৫ পয়সা হওয়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে তারা এ কথাও বলছেন, নতুন কলরেটের কারণে কলরেট কমল প্রায় ৬৫ শতাংশ। অফনেট ও অননেটের মধ্যে দামের যে বৈষম্য ছিল তা দূর হলো। মোবাইল নম্বর পোর্টাবিলিটি বা এমএনপি চালু হলে গ্রাহক আরো উপকৃত হবেন। নেটওয়ার্ক পছন্দে তাদের অবাধ স্বাধীনতা থাকবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, গ্রাহকদের সুবিধার জন্য অনেক গবেষণা করে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আগে গ্রামীণফোন থেকে অন্য অপারেটরে কথা বললে কলরেট ছিল অনেক বেশি। এখন যার সঙ্গেই কথা বলা হোক, কলরেট একই ৪৫ পয়সা।

‘আরেকটা সুবিধা হলো’- উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা আরো বলেন, যারা একটু দুর্বল অপারেটর তারা একটু শক্তিশালী হতে পারবে। আগে গ্রামীণ থেকে বাংলালিংক নম্বরে কথা বললে ৬০-৭০ পয়সা হতো। আর গ্রামীণফোন থেকে গ্রামীণফোনে কথা বললে ২৫ পয়সা হতো। সারা বিশ্বে মোবাইল কলরেটের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা আছে। আমরা অনেক দিন ধরে স্টাডি করছিলাম। এর ফলে এখন অন্য অপারেটরগুলো ব্যবসা করতে পারবে।

‘তবে কোনো কোনো অপারেটর যেমন গ্রামীণফোন থেকে গ্রামীণফোনে ২৫ পয়সা কলরেট ছিল, তাদের একটু অসুবিধা হবে’ বলে স্বীকার করেন বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ‘কিন্তু সার্বিকভাবে গ্রাহকের সুবিধাই হবে’ বলে মনে করেন তিনি।

মিশ্র প্রতিক্রিয়া গ্রাহকদের : সাধারণ গ্রাহকরাও মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। একপক্ষ অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে বলেছেন, আগে এফএনএফ (ফ্যামিলি অ্যান্ড ফ্রেন্ডস) থাকায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নির্দিষ্ট খরচে অনেকক্ষণ কথা বলা যেত, এখন সেটা কমে যাবে। কলরেট বেড়ে যাওয়ার কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আরেকপক্ষের মত, ভিন্ন অপারেটরে কলরেট কমে যাওয়ায় পেশাগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম খরচ হবে।

নতুন কলরেটে খুশি অপারেটররা : নতুন কলরেটের ফলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে মনে করছে অপারেটরগুলো। অপারেটর সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে দেশে দুই ধরনের কলরেট চালু আছে, অননেট ও অফনেট। অননেট হলো একই মোবাইল নেটওয়ার্কে কল করার (কথা বলার) পদ্ধতি এবং অফনেট কল হলো এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে ফোন করা। নতুন নিয়মে এই অননেট ও অফনেটের কলরেট পদ্ধতি আর থাকছে না। ৪৫ পয়সা হলো নতুন কলরেটের ফ্লোর প্রাইস (ইউনিফায়েড ফ্লোর প্রাইস)। এই রেটের কমে কোনো মোবাইল নম্বরে কল করা যাবে না। তবে মোবাইল ফোন অপারেটররা তাদের পছন্দমতো রেট সাজিয়ে নতুন কলরেট গ্রাহকদের অফার করতে পারবে। কলরেটের সর্বোচ্চ সীমা হবে ২ টাকা, যা আগেও ছিল।

সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে অপারেটর কোম্পানিগুলো। এ ব্যাপারে বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এটি গ্রাহকদের নেটওয়ার্ক বেছে নেওয়া ও একই কলরেটে অননেট ও অফনেট কল করার স্বাধীনতা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রা আরো সহজ করতে ভূমিকা রাখবে, যা আগে সম্ভব ছিল না। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চূড়ান্ত আদেশ পেয়েছি এবং সব ধরনের নির্দেশ মেনে এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

নতুন কলরেট প্রসঙ্গে মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন বলেন, আমরা কলরেট সংক্রান্ত বিটিআরসির চিঠি পেয়েছি। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অপারেটররা বলেছে, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে গ্রাহকরা সুফল পাবে। আগে অননেট কলের সর্বনিম্ন সীমা ২৫ পয়সা হলেও গ্রাহকদের গড় খরচ হতো ৩৯-৪০ পয়সা। আর অন্য অপারেটরে (অফনেটে) কলের সর্বনিম্ন সীমা ৬৫ পয়সা হলেও গ্রাহকের খরচ হতো ৮৯ পয়সা থেকে ১ টাকা ৪০ পয়সার মতো। নতুন কলরেট চালুর ফলে একই অপারেটরে কলের খরচ ৫ পয়সা বাড়লেও অন্য অপারেটরে কলের ক্ষেত্রে খরচ কমবে ৪৫ থেকে ৫০ পয়সা। মূলত গ্রাহক সংখ্যায় ছোট অপারেটরের গ্রাহকরা এই সুবিধা পাবেন।

‘তবে এটা ঠিক নতুন কলরেটের কারণে গ্রাহকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘমেয়াদে এটা গ্রাহকদের জন্য ভালো হবে। কারণ তারা কোনো নেটওয়ার্কে কথা বলছে সেটা নিয়ে আর ভাবতে হবে না’- যোগ করেন অপারেটর সংশ্লিষ্টরা।

ভালো দেখছেন বিশেষজ্ঞরাও : বিশেষজ্ঞরা নতুন কলরেটের কারণে টেলিযোগাযোগ খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মনে করছেন। তারা বলেন, এর ফলে মোবাইল ফোনের অননেট ও অফনেট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে কারসাজি ছিল, সেটি দূর হলো। এতদিন এই অননেট ও অফনেটকে কাজে লাগিয়ে কম খরচে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করেছেন। আবার অননেট ও অফনেট নিয়ে অপারেটরদের মধ্যেও ছিল কারসাজি।

‘বিশেষ কওে বেশি গ্রাহক রয়েছে এমন অপারেটররা আগের কল রেটের সুবিধা পেয়েছেন। অন্যদিকে, কমসংখ্যক গ্রাহক নিয়ে যেসব অপারেটর আছেন তারা দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। ভয়েস কলের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের উদাহরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অননেট ও অফনেটের ভিন্ন সর্বনিম্ন মূল্যের কোনো নজির নেই। এসব বিষয় পর্যালোচনা করেই সরকার নতুন এই কলরেট নির্ধারণ করেছে’- বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ঠিকই; কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বাজার প্রতিযোগিতামূলক হবে। কোনো বিশেষ কোম্পানি যেন বাজারে তাদের প্রভাব খাটিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করতে না পারে তা নিশ্চিত করতেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। বিশ্বের সব দেশেই মোবাইল ফোনে সর্বনিম্ন কলরেট নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করা হয়।

কি আছে নির্দেশনায় : বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া উইং) মো. জাকির হোসেন খান জানান, গত সোমবার রাত ১২টা ১টা মিনিট থেকেই নতুন কলরেট কার্যকর করতে বলা হয়েছে। এতদিন একই অপারেটর বা অন নেট কলের জন্য প্রতি মিনিটে সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা এবং অন্য অপারেটর বা অফনেটে কথা বলার জন্য ৬০ পয়সা খরচ হতো। আর সর্বোচ্চ ট্যারিফ ছিল ২ টাকা। অন্যদিকে, অন নেট কলের জন্য গ্রাহকদের প্রতি মিনিটে সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা এবং অফনেটে ৬০ পয়সা খরচ হয়। আর প্রতি মিনিটের সর্বোচ্চ কলরেট ২ টাকা। এ ছাড়া মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো অননেট এবং অফনেট গ্রাহকদের জন্য পৃথক ট্যারিফ অফার করতে পারবে না। নতুন কলরেট চালুর আগেই গ্রাহকদের রিচার্জ করা অর্থ, টক টাইম বা এয়ার টাইম এবং সব রেগুলার প্যাকেজ, অফার ও বান্ডেলগুলো নতুন জারি করা ট্যারিফ প্ল্যানের আওতায় সমন্বয় করতে হবে অপারেটরদের, বিষয়টি গ্রাহককেও জানিয়ে দিতে হবে। তবে গ্রাহকের সুবিধার্থে চালু করা প্যাকেজ শেষ হওয়ার পরে নতুন নির্দেশনা চালুর সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
লাভ,লোকসান,হিসাব
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close