কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭

চট্টগ্রামের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

ছাত্রনেতা থেকে শ্রমিক আন্দোলনে, এরপর অসম সাহসিকতায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য। তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিয়ে। প্রগতিশীল সব আন্দোলনে ছিলেন অগ্রভাগে। বহুবার কারাবন্দি হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবু মাথানত করেননি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির কিংবদন্তি। ছিলেন চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় ‘চট্টলবীর’। চট্টগ্রামের স্বার্থে তিনি নিজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছেন। অসহায়, দুস্থ মানুষের যিনি ছিলেন কা-ারি। সেই মহিউদ্দিন চৌধুরী আর নেই। চট্টগ্রামে তার বিকল্প নেতা নেই, তার শূন্যতা পূরণ করার মতো ব্যক্তিও সেখানে এখন আর নেই। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের একটি অধ্যায়ের সমাপ্ত হলো।

গত বছরের ১ ডিসেম্বর নিজের ৭২তম জন্মবার্ষিকীতে সাংবাদিকদের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘টিল ডেথ, আই উইল ডু ফর দ্য পিপল অব চিটাগং, চট্টগ্রামের মানুষকে আমি ভালোবাসি। সারাজীবন দরিদ্রের সন্তান, সেবকের সন্তান, সাধারণ পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার জন্য কাজ করেছি। অন্যায়-অবিচার দেখলে এখনো কথা বলি। যত দিন বেঁচে থাকব চট্টগ্রামের মানুষের জন্য কাজ করব।’ কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের ‘প্রাণ’ ছিলেন তিনি।

১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরীর বাড়িতে জন্ম নেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বাবা রেল কর্মকর্তা হোসেন আহমদ চৌধুরী এবং মা বেদুরা বেগম। ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ করেননি। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মহিউদ্দিন। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন মেজো। বাবা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। বাবার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশোনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, কাজেম আলি ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হয়ে ছিলেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে। সেখানের পাঠ না চুকিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। বছর না ঘুরতেই কমার্স কলেজ, আর শেষমেশ সিটি কলেজ। সিটি কলেজই তার বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের সূচনা।

একাত্তরে গঠন করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। গ্রেফতার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন। স্বাধীনতার পর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ পান। সান্নিধ্যে আসেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর। পাক বাহিনীর কাছে গ্রেফতার হন অনেকবার। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দীর্ঘ চার মাস। সেই নির্যাতনের চিহ্ন শরীরে বহন করেছেন। ভারতের এক মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে শহীদ মহিউদ্দীন ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। বেঁচে থাকার কথা ছিল না তার। শহীদ ভেবে বাবা ছেলের নামে দিয়ে ছিলেন ফাতেহা। এরই মাঝে এক দিন মানসিক রোগীর নাটক করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে বের হন মহিউদ্দিন। পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দিন। ক্ষমতার মোহ একচুলও স্পর্শ করেনি তাকে।

পঁচাত্তরে জাতির জনকের হত্যার পর প্রতিশোধ নিতে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’। ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হয় তাকে। কলকাতায় পাড়ি জমান। অল্পের জন্য মহিউদ্দিন ধরা পড়া থেকে বেঁচে যান আর মৃত্যুবরণ করেন সাথী মৌলভী সৈয়দ। তার লক্ষ্য ছিল সামরিক জান্তা, খুনি মোশতাককে সামরিকভাবেই পরাস্ত করা। কিছুদিন পরেই দলের নির্দেশে মত পরিবর্তন করে আবার সক্রিয় হন প্রকাশ্য রাজনীতিতে। ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন। চট্টগ্রামে আওয়ামী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন মহিউদ্দিন। দেশে এসেই একের পর এক হুলিয়া। সামরিক বাহিনীর হাতে নির্যাতন আর কারাভোগ। তখন জিয়া ক্ষমতায়। তরুণ ছাত্রনেতা মহিউদ্দিনের ভয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তটস্থ থাকতেন। এমনকি আওয়ামী লীগের ভেতরেই একটা অংশ ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম থেকে দলবল নিয়ে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা এরশাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন। চট্টগ্রামে স্বয়ং জান্ত প্রধানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে চক্ষুশূল হন সরকারের। ফলে আবারও রাজনৈতিক বন্দি। তত দিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার প্রিয় নেতা হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। রাজাকার আর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ে অসহায় জনতার পাশে দাঁড়ানো, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং গরিব-দুঃখীর কথা বলে মহিরুহে পরিণত হন আজকের মহিউদ্দীন।

পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে অনেক কিছু পেলেও কখনো সংসদ সদস?্য হতে পারেননি মহিউদ্দিন। ১৯৯৪ সালে প্রথমবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রার্থী হয়েই বিজয়ী হন। ২০০০ সালে দ্বিতীয় দফায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০০৫ সালে তৃতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন। তার মেয়াদে নগরের পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ‘অনন্য দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। ২০০৬ সালের ২৭ জুন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মহিউদ্দিন। সর্বশেষ নির্যাতিত হন সাবেক ওয়ান ইলেভেনের শাসনামলে। দুই বছর কারাবন্দি থাকেন। এ সময়ই তিনি হারান আদরের মেয়ে ফওজিয়া সুলতানা টুম্পাকে। শত মানসিক নির্যাতনও টলাতে পারেনি তাকে। চেষ্টা করেও দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি তাকে।

২০১৪ সালের নভেম্বরে হওয়া কমিটিতেও তিনি সভাপতি পদ পান। বয়সের ভার নিয়ে আমৃত্যু পালন করেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বারবার দল এবং সরকার বিভিন্ন পদের জন্য প্রস্তাব থাকলেও চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে চাননি অন্য কোথাও।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

"
প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চট্টগ্রাম,একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি,মহিউদ্দিন চৌধুরী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist