বদরুল আলম মজুমদার

  ২৪ আগস্ট, ২০১৭

লক্ষ্য জাতীয় নির্বাচন

দল-জোট বদলে ব্যস্ত ইসলামী দলগুলো

নির্বাচন সামনে রেখে ছোট বড় প্রায় শতাধিক ইসলামী দল এখন রাজনীতির মাঠে সক্রিয়। এদের অধিকাংশই আগে বড় প্ল্যাটফরম নিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক ফায়দার জন্য গড়েছেন ছোট ছোট দল। নতুন দলের বড় নেতা হয়ে এমপি মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেন অনেকে। মাঠ পর্যায়ে এখন তারা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে কাজ করছেন। বিশেষ করে কোন দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নিলে সংসদে আসন পাওয়া যাবে এসব হিসাব কষছেন তারা।

দেশের অধিকাংশ ইসলামী দল বিএনপি ঘেঁষা- এমনটা ধরা হলেও তা কাটতে শুরু করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভোটের অঙ্ক বিবেচনায় সরকারও দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান হচ্ছে—নিজেদের পক্ষে নিতে না পারলেও দলগুলো যাতে আর বিএনপির পক্ষে দাঁড়াতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাছাড়া ইসলামী দলগুলোও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দরকষাকষির পর্যায়ে রয়েছে। বিএনপির পক্ষে নেই—এমন অবস্থা বোঝানোর জন্য দলগুলোও নিজেদের মতো করে আলাদা হয়ে যাচ্ছে জোট থেকে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত ২০-২৫ বছরের ভোটরে রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোর অবস্থান বরারবই বিএনপির পক্ষে ছিল। বলতে গেলে, জামায়াতসহ যেসব ইসলামী দল দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছে, তারা সব সময় নিজেদেরকে আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। আওয়ামী লীগ ইসলামের পক্ষের দল নয়, এমন আবহ তৈরি করে বারবারই তাদের ভোটকে ‘ক্যাশ’ করত বিএনপি। নির্বাচন আসলে দেখা যায়, দলগুলো মাঠ পর্যায়ে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষেই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বার বার। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে সরকারি দল। দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকায় বিএনপির অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে। বিএনপির এমন নাজুক পরিস্থিতি দেখে ইসলামী দলগুলোও নিজেদের অবস্থান বদলে সক্রিয় হয়। তাছাড়া এসব ইসলামী দলকে ধরে রাখার মতো কোনো পজিটিভ রাজনীতিও বিএনপি করতে পারেনি।

সম্প্রতি এমনই ১২টি দল নিয়ে গঠিত হতে যাচ্ছে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স অথবা বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় এই জোট মুক্তযুদ্ধের সরকারের হাতকে শক্তিশালী করার প্রত্যয়ে গড়ে উঠছে। সমঝোতা করে ক্ষমতাসীন দলের ‘নৌকা’ প্রতীকেই ভোট করার অভিপ্রায় এই জোটের উদ্যোক্তাদের। জোটের সমন্বয় করছেন গণতান্ত্রিক ইসলামিক মুভমেন্ট নামের একটি দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. নূরুল ইসলাম খান, যিনি এক সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা ছিলেন। পরে নিজে একটি দল গঠন করেন। সরকারের সঙ্গে থাকা ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী নতুন এই জোটের চেয়ারম্যান হতে পারেন। জোটের শীর্ষ নেতারা একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২০টি আসনে নৌকা প্রতীকে নিজেদের প্রার্থী দিতে চান। শোনা যায়, ২০ আসন পাওয়ার গোপন সমঝোতার ভিত্তিতেই এ জোট সরকারের সঙ্গে থাকবে। এ জোটের দলগুলো হলো বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা জাফরুল্লাহ খান আমীরে শরীয়ত, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, গণতান্ত্রিক ইসলামিক মুভমেন্ট চেয়ারম্যান মো. নূরুল ইসলাম খান, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) চেয়ারম্যান আলমগীর মজুমদার, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ প্রধান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী) চেয়ারম্যান হাসরত খান ভাসানী, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) চেয়ারম্যান, আ. মালেক চৌধুরী, জমিয়তে হিজবুল্লাহ বাংলাদেশ—নেতৃত্বে মাওলানা শাহ মোস্তাকিম বিল্লাহ সিদ্দিকী ও মেজো পীর শর্শীনা দরবার শরীফ, পিপলস জাস্টিস পার্টি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম হায়দার আলী ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের।

এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক ইসলামিক মুভমেন্ট চেয়ারম্যান, মো. নূরুল ইসলাম খান বলেন, এদলগুলো এক সময় চারদলীয় জোটের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের পরে জোট থেকে বেরিয়ে অনেকে আলাদা এলায়েন্স করেছে। এই প্রক্রিয়ায় থাকা দুই থেকে তিনটি দল আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেও আগে কোনো জোটে ছিল না। তাছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ ভেঙে কয়েক টুকরা হওয়ার পর ‘নজুন প্রজন্ম’ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জোটে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, বলা যায়, বিএনপি জোট ছেড়ে আসা দলগুলোকে সঙ্গী করেই একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমরা নতুন প্ল্যাটফর্ম করতে যাচ্ছি, নৌকার সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের ভোট বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখতে পারব।

ইসলামী দলগুলো কেন ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বিএনপির প্রতি হতাশা থেকেই ইসলামী দলগুলো নিজেদের মতো করে ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে। এসব দলের নেতারা ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধার লোভে সকাল বিকাল দল ভাঙে আর গড়ে। তাছাড়া ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মাঝে যথেষ্ট অনৈক্য রয়েছে। এ জন্য ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ায় তারা পক্ষ পরিবর্তন করছে ঘন ঘন। তবে এতে করে দলগুলোর অবস্থাও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী দল হচ্ছে জামায়াত। তারা বর্তমানে বিএনপি জোটের সঙ্গেই আছে। তবে দলটির সঙ্গে বিএনপির ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে চলছে বিচার বিশ্লেষণ। তবে জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে বিএনপির প্রকাশ্যে মেলামেশা বন্ধ রয়েছে অনেক দিন থেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়ায় হতাশ বিএনপি। তাছাড়া আগামী নির্বাচনে জামায়াতের ব্যপারে কোন নীতিতে এগোবে, এমন অবস্থান পরিষ্কার করতে না পারায় জামায়াতও বিএনপির প্রতি হতাশ।

বিএনপিতে আগামী দিনে জামায়াতের অবস্থান কি হবে সেটা এখনো পরিস্কার নয়। তাছাড়া নির্বাচনে জামায়াতের বেশ কিছু নেতা স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিতে পারেন, এমন হিসেবও দলটির রয়েছে। জামায়াত নির্বাচন করতে পারবে না। এমনটা ধরে নিয়ে বিএনপিও নিজেদের মতো করে আসন ওয়ারী মনোনয়ন চূড়ান্তের পথে হাঁটায় মূলত দুই দলের দ্বন্দ্ব এখন তুঙ্গে। তবে জোটের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিষয়টি নিয়ে আরো বসবেন বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে জামায়াতকে।

জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা জানান, গত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে প্রার্থী নিয়ে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সরাদেশে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও কেন্দ্রীয়ভাবে জামায়াত বিএনপির সম্পর্ক বা প্রার্থিতা কেমন হবে সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়নি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের দলের নেতারা বার বারই বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু সেটা আর কত দিন।

দলের একটি সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটে থাকা অন্য ইসলামী দলগুলোও বিএনপির আচরণে ক্ষুব্ধ। তারা চায় আগামী নির্বাচনের বিএনপি তাদের কতটুকু কি দিবে তা এখনই চূড়ান্ত করতে। তবে বিএনপি মনে করছে নির্বাচনের একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলবে দলটি। বিএনপি জোটের বাইরে থাকা অন্য দলের সঙ্গেও নির্বাচনী সমঝোতা তৈরি করতে চায়। এক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতে চায় না বিএনপি।

অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন রয়েছে ৫৮ দলীয় জোট। এ জোটেও ভিড়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ইসলামী দল। তবে ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থ ত্যাগ করতে না পারায় ইসলামী দলগুলো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি দলের জন্ম অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে। তবে দীর্ঘ দিনের এ পথচলায়ও দেশের মানুষের কাছে তারা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন বা অবস্থান গড়ে নিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থ।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় নির্বাচন,রাজনীতি,ইসলামী দল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist