প্রতীক ইজাজ

  ২২ জুলাই, ২০১৭

দেশেই আলোচনার পরামর্শ বিশ্লেষকদের

খালেদার লন্ডন সফরে সতর্ক আওয়ামী লীগ

প্রায় দেড় মাসের সফরে লন্ডন গেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চিকিৎসার পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলীয় ও নির্বাচনী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিএনপির বন্ধুরাষ্ট্র এবং ভারতসহ অন্যান্য কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে নির্বাচনী কূটনীতিক রাজনীতিও করবেন তিনি। যেহেতু দেশে ফিরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করার কথা রয়েছে; তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া-না নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও সেখানে হতে পারে বলে মনে করছেন দলের সূত্রগুলো। এমনকি নির্বাচনী রাজনীতিতে কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে; সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন মা-ছেলে। তারেক রহমান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় (২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা) হুলিয়া নিয়ে নয় বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে লন্ডনে রয়েছেন।

খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে এ মুহূর্তে বেশ সরগরম দেশের রাজনীতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতর-বাইরে তো বটেই; সফর নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে বিএনপির ভেতরও। সফরকে নিছক সফর হিসেবে দেখছে না দলটি। দলের কাছে এ সফর রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন-এ দুই ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জেনেছেন দলের নেতারা। তবে এই সফরের মধ্য দিয়ে আদতেই কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন মা-ছেলে, তা নিয়ে কিছুটা হলেও সন্দিহান দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বড় অংশ। ফলে তাদের মধ্যেও এক ধরনের হিসাব-নিকাশ ও সন্দেহ ডালপালা ছড়াচ্ছে।

বিশেষ করে খালেদা জিয়ার এই সফর নিয়ে বেশ সতর্ক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সফরের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন দলের নেতারা। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সেখানে খালেদা জিয়ার গতিবিধি ও সভা-সেমিনারের ওপর তীক্ষè নজর রাখছেন দলের শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে লন্ডনের কূটনৈতিক জোনগুলোতে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। কোথায় কী আলোচনা হচ্ছে, তাৎক্ষণিকভাবে সেসব তথ্য চলে আসছে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়ার লন্ডনে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করেই নতুন নির্বাচনী রাজনীতির কর্মসূচি নেওয়ার কথাও ভাবছে দলের হাইকমান্ড। সফরকে কেন্দ্র করে আপাতত দেশে বিএনপিবিরোধী বিশেষ কৌশলী রাজনীতির সিদ্ধান্ত হয়েছে দলের ভেতর। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার পর বিএনপির নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতির আভাসও মিলেছে দলের ভেতর।

খালেদা জিয়ার এই সফর নিয়ে কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। তারাও এই সফরকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন। তাদের মধ্যেও সফরকে ঘিরে নানা ধরনের সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে। তারা বিএনপিকে সতর্ক করে দিয়ে বলছে, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন ভন্ডুলের রাজনীতিতে গেলে বিএনপি আবারও ভুল করবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির ভেতর একটি অংশ বিদ্রোহ করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বলেও মত তাদের।

পাশাপাশি এই সফরকে হেলাফেলা না করে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলকে। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি মোকাবিলায় বিশেষ প্রস্তুতি থাকা উচিত। তবে বিশ্লেষকরা সব রাজনৈতিক দলকে বিদেশিদের দ্বারস্থ না হয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট দেশের ভেতর আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে মত দিয়েছেন।

গতকাল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরকেন্দ্রিক এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত ১৫ জুলাই লন্ডন সফরে গেছেন খালেদা জিয়া। চিকিৎসার পাশাপাশি সেখানে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঈদুল আজহা উদযাপন করে দেশে ফিরবেন বলে জানানো হয়েছে। সে হিসেবে খালেদা জিয়া যদি ৪২ দিন সেখানে থাকনে, তাহলে এটিই হবে তার সবচেয়ে দীর্ঘ বিদেশ সফর। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডন সফরে গিয়ে দেড় মাসের মতো ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীনরা। কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে সফরকে। সেখানে ছেলের সঙ্গে বৈঠক করে কী সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন, তার ওপর নির্ভর করছে দলের আগামী নির্বাচনী রাজনৈতিক সমীকরণ। ফলে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ক্ষমতাসীনরা।

খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরকে ক্ষমতাসীনরা যে সন্দেহের চোখে দেখছেন, তা দলের শীর্ষ নেতাদের গত কয়েক দিনের বক্তব্যেই উঠে এসেছে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে খালেদা জিয়ার এক মাসের জন্য লন্ডন যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। স্বয়ং দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশে যাতে নির্বাচন না হয়, সে লক্ষ্যে চক্রান্ত করছে একটি চক্র। সভায় তিনি এসব ষড়যন্ত্র নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার ও সতর্কভাবে কথা বলার নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার এক দিন পরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মামলার ভয়ে খালেদা জিয়া পালিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। তিনি এমনও বলেন, আমাদের শক্তির উৎস বাংলাদেশের জনগণ। বিদেশে বসে শেখ হাসিনাকে হটানোর ষড়যন্ত্র সফল হবে না। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করে কোনো লাভ হবে না। এমনকি চিকিৎসা করাতে নয়, ষড়যন্ত্র করতে খালেদা জিয়া লন্ডনে গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।

‘তবে সফরকে কেন্দ্র করে সতর্ক দল’-উল্লেখ করে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা যথেষ্ট সতর্ক। আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। ওনারা (খালেদা জিয়া) নির্বাচনে অংশ নিক, না নিক, নির্বাচন হবেই। যেহেতু মামলার কারণে মা-ছেলের আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত, তাই তারা দল নির্বাচনে যাক, তা চান না। তবে যদি তারা নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে দলের ভেতর একটা অংশ বিদ্রোহ করে নির্বাচনে অংশ নেবে।

আব্দুর রহমান আরো বলেন, খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর যে দুরভিসন্ধিমূলক, তাতে সন্দেহ নেই। এ নিয়ে জনমনেও আতঙ্ক ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সবাই মনে করছে, তারেকের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা করে খালেদা জিয়া নির্বাচন ভন্ডুল করতে পারেন। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, দলের (বিএনপি) ভেতরও মা-ছেলের এমন আলোচনা নিয়ে সমালোচনা ও ক্ষোভ রয়েছে। বিএনপি ভেতরের কথা, দলে শীর্ষ নেতাদের মতামত ও সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে মা-ছেলে মিলে দল চালাচ্ছে। এতে দলও ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই।

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সফর পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচি ঠেকাতে ক্ষমতাসীনদের প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বিএনপি দুই কেন্দ্র থেকে পরিচালিত। একটি কেন্দ্র খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়, অপরটি লন্ডনে তারেক রহমানের কেন্দ্র। তবে প্রতিবারই লন্ডন কেন্দ্র থেকে বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত আসে। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন ও ২০১৫ সালে সহিংস কর্মসূচির সিদ্ধান্তও লন্ডন থেকে এসেছিল। অথচ সেবার দলের বড় অংশই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। আমরা দেখেছি, লন্ডন থেকে অপেক্ষাকৃত কম গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত আসে। যেসব গোষ্ঠী রাস্তায় জ্বালাও-পোড়াও ও নানা ধরনের সহিংসতা ঘটায়, লন্ডন থেকে তাদের সক্রিয় রাখা হয় বলে ধারণা। ফলে এবারও সে রকম সন্দেহ আছে। এবারও যদি ফেরার পর বিএনপি লন্ডন কেন্দ্রের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহলে ধ্বংসাত্মক ও সহিংস কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে।

‘তাই সরকারের প্রস্তুতি থাকাই ভালো’ বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বিএনপি যদি আবার আগের রাজনীতিতে ফিরে যায়, তাহলে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যাবে। তাই সফরের ওপর নজরদারি রাখা উচিত। তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে যে, সেখানে কী ধরনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তাহলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যেতে পারবে। বিএনপিও সফল হবে না।

অবশ্য বিএনপি যে কেবল চিকিৎসা করাতেই লন্ডনে গেছেন, এমনটা বিশ্বাস করেন না অপর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রবীণ সাংবাদিক কাজী সিরাজ। তিনি বলেন, চিকিৎসা নীতির পাশাপাশি মনোনয়নসহ নির্বাচনের নানা সিদ্ধান্ত ও কূটনীতিও করবেন খালেদা জিয়া। বিএনপির পুরনো বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করার পাশাপাশি নতুন করে অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালাবে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাবে। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে থাকতে তাই করত। তবে সরকার যেটাকে ষড়যন্ত্র বলছে, সেটা আসলে ষড়যন্ত্র নয়; ক্ষমতায় আসার চেষ্টা। সবাই বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়।

‘তবে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধানে বিদেশিদের কাছে ধরনা না দিয়ে দেশের ভেতর ঝগড়া-বিবাদ, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই করা উচিত। বিদেশে গিয়ে, বিদেশিদের কাছে অভিযোগ করা ঠিক না’ বলেও মন্তব্য করেন কাজী সিরাজ।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
খালেদা,লন্ডন সফর,সতর্ক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist